জীবনের ধ্রুবতারা
জীবনের ক্যানভাসে কত রঙ মাধবীর! ডিমের কুসুমের মতো ভোরের সূর্যকে দেখেছে সে। দেখেছে কৈশোরের সবুজ শ্যামলিমায় ভরা দিনগুলি। প্রথম যৌবনের রক্তাম্বরী রূপ। তারও পরে সাদা থান কাপড়ে ঢেকে রাখা শরীর। কালো অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া মন।সবই তো নিজে দেখেছে, অনুভব করেছে মাধবী। সব রঙ এখন শুকিয়ে কেমন যেন লেপটে রয়েছে শরীর, মন জুড়ে। এক অদ্ভুত থমকে যাওয়ার সময়। অকালে মরে যাওয়া ক্ষণজন্মা বাসনা।
তবে হারিয়ে যায়নি সেই মূল্যবান ক্ষণগুলির চিত্র। পাতা ওল্টালে ঠিক দেখতে পায় সে বাবার আঙুল ধরে হেঁটে যাচ্ছে বাড়ির সামনের মাঠে। মাঠে পৌঁছে হাত ছেড়ে দিতেন। বলতেন, ‘যাও এবার খেলা করো। ওই যে দুটো প্রজাপতি ছোট গাছটির পাতায় বসেছে, তাদের ধরো তো দেখি!’ প্রজাপতির পেছনে ছুটত মাধবী। হাতের নাগালের মধ্যে পেয়েও যখন ধরতে পারতো না, তখন কান্না জুড়ে দিয়ে বাবার কাছে ছুটে আসত। বাবা বলতেন- ‘ হারতে নেই মা। আবার গিয়ে ধরত দেখি। ঠিক পারবে।’ বাবার মুখের ‘হারতে নেই মা’ কথাটি যেন এখনও শুনতে পায় সে।
মাধবীর বয়স পাঁচ পের হতেই বাবা সতীনাথ চাইলেন মেয়ের হাতে খড়ি দিতে। দাদু বলেছিলেন, ‘মেয়েদের আবার হাতে খড়ি হয় নাকি? তারা হল মায়ের জাত। সংসার ধর্ম পালন করবে, বিয়ের পর পতিসেবা করবে, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা যত্ন, সন্তান পালন – নিয়েই থাকতে হবে। মেয়েকে এত লেখাপড়া শেখানোর দরকার নেই।’ তবে সতীনাথ তা শোনেননি। বলেছিলেন- ‘বিদ্যার দেবী সরস্বতী। তবে মেয়েরা বিদ্যালাভ করবে না কেন? বৈদিক যুগে অপালা, বিশ্ববারার মতো নারীরা বৈদিক শ্লোক রচনা করেছিলেন। উপনিষদে গার্গী, মৈত্রেয়ীর মত প্রাজ্ঞ ও ভবিষ্যৎদ্রষ্টাদের নামোল্লেখ রয়েছে। আবার লীলাবতী, খনার মতো বিদূষীরাও ছিলেন। মেয়েরা বিদ্যালাভে তো বঞ্চিত ছিল না!’ বাবার কাছে হার মানলেন দাদু।ঘটা করে হাতেখড়ি হয়েছিল।
মাস্টারমশাই খুব যত্ন করে পড়াতেন। সতীনাথকে বলতেন,’ লক্ষীমেয়ে আপনার। লেখাপড়ায়ও মনোযোগ রয়েছে। শ্বশুরবাড়িতে খাতির যত্ন পাবে, দেখবেন।’ সতীনাথ মনে মনে খুশি হলেও মুখে বলতেন, ‘সবই ভাগ্য। কাকে কখন কোথায় টেনে নিয়ে যায়, কে জানে!’ বাবার এই কথাও ঠিক মনে রয়েছে মাধবীর।
মাঘব্রত করে সই বানিয়েছিল চিত্রাকে। পাঁচ বছর ধরে মাঘ মাসে এই ‘সই’ পাতানোর অনুষ্ঠানের দিনগুলি ছিল খুব আনন্দের। সাবিত্রী মাসির মেয়ে চিত্রার সঙ্গে নিত্যদিন পুতুল খেলা চলত। এক পাড়ায় থাকার সুবাদে নিত্য – যাওয়া আসা চিত্রার। মনে পড়ে উঠোনে আঁকা ব্রতমন্ডল। গোলাকার সূর্য, অর্ধচন্দ্র; মাঝখানে অয়ন-মন্ডল। প্রথম বছরে একটি গোলাকার আলপনা, দ্বিতীয় বছরে দু’টি, তৃতীয়তে তিন; চতুর্থতে চারটি আর পাঁচ বছরের ব্রতে পাঁচটি। চালের গুঁড়োর সঙ্গে হলুদ, সিঁদুর,ধানপোড়ানো তুষ, শুকনো বেলপাতা গুঁড়ো মিশিয়ে মা-মাসিরা সুন্দর আলপনা আঁকতেন। মাধবীও কোন সময় লেগে যেত আলপনা আঁকতে। সেই স্মৃতি এখনো তাজা রয়েছে মাধবীর। সই’য়ের বিয়ে হয়ে যায় এর ক’বছর পরেই। শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার আগে চিত্রা বলেছিল ‘ভালো থাকিস সই’।
হ্যাঁ, ভালো থাকতে চেয়েছিল মাধবী। ঘোড়ায় চড়ে রাজপুত্র এসে নিয়ে যাবে- এই স্বপ্ন সে দেখেছিল। বিয়ের সন্ধ্যায় বরযাত্রী আসার পর পিসতুতো বোন শান্তা এসে বলে গেল- ‘ তোর রাজপুত্রকে দেখে এলাম। রাজপুত্রই বটে! তোর পছন্দ হবেই। তোর শ্বশুর মশাইকে দেখলাম। কিছু ছেলে ছোকরাও রয়েছে, তোর দেওর-টেওর হবে সম্ভবত। বন্ধু হতে পারে রাজপুত্রের।’
মাধবী জানতে চায়, ‘মা কি করছে রে?
‘জামাই বরণের ধুম চলছে, মাসি মহাব্যস্ত এখন। আমি যাই, আলাপ জমাতে হবে না রাজপুত্রের সঙ্গে!’
সাত পাকের সময় পা কাঁপছিল মাধবীর। বুক কেমন ধুকধুক করছে যেন! শুভদৃষ্টির সময় কি যে হল, চোখের পাতা খুলতেই চায় না!ভিড়ের কে একজন বললে- ‘শুভদৃষ্টি হবে। বউদিদি ডাগর চোখখানা মেলে দিন, দাদা অপেক্ষায় রয়েছে, আমরাও।’ মাধবী চোখ মেলে দেখলো রাজপুত্রকে। অবাক চেয়ে রইল। সেই মুহূর্তের কথা কোনও দিন ভুলতে পারবে না মাধবী।
বাসর ঘরে মাধবী জড়তায় আচ্ছন্ন হয়ে রইলো। মৃন্ময় ঘরে আসতেই পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো। মৃন্ময় বললে-‘এ কি! এখন আবার প্রণাম কেন? মাধবী নিরুত্তর। মৃন্ময় বললে,’ছবিখানা আগে দেখেছিলাম, সাক্ষাতে দেখতে পেয়ে আরো ভালো লাগছে।’
‘নিন, এবার বিশ্রাম করুন। সারাদিন তো খুব ধকল গেছে। উপোস করেছিলেন বুঝি! কষ্ট হয়েছে নিশ্চয়ই। আমি তো মাঝেমধ্যে ব্রত করতে গিয়ে উপোস থাকি, তাই অতটা অসুবিধা হয়না। কিন্তু পুরুষ মানুষের তো এমন অভ্যাস নেই, তাই বলছি।’
‘না,না। শুভ কাজের জন্য সামান্য কষ্ট ভোগ করতে আমার কোনও অসুবিধা নেই’। মৃন্ময়ের কথা ভাল লাগে মাধবীর।
সংসার শুরু হয় এভাবেই।ক’মাস যেন কয়েক মুহুর্ত মাত্র! মৃন্ময় স্থির করলে, একদিন শিকারে যাবে, অনেকদিন যাওয়া হয়নি। বললে- ‘এবার একদিন শিকারে যাব, অনেকদিন হল হরিণ শিকার হয়নি। হরিণের মাংস খেয়েছো?’ মাধবী অকপটে বলে- ‘না। কেমন খেতে? হাসে মৃন্ময়। বলে- ‘আজ তাহলে হরিণ শিকার করবোই।’
শিকারের পোশাকে দারুন লাগছিল মৃন্ময়কে। বলেছিল, ‘এই সাজে খুব ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে রাজপুত্র।’ মৃন্ময় বলে -‘তুমি যে রাজরানী। তাই আমাকে তো রাজপুত্র হতেই হবে’।
কিন্তু রাজরানী হতে পারল কই মাধবী! জঙ্গলে সর্পাঘাতে প্রাণ চলে যায় মৃন্ময়ের। বাঁশের মাচায় শায়িত মৃন্ময়ের সামনে গিয়ে যখন দাঁড়ায়, তখন চারিদিকে কোলাহল। কেউ একজন বললে-‘ ওই যে এসেছে অলুক্ষনে বউটা। ওটাই খেয়েছে তার স্বামীকে।’ সেই কণ্ঠস্বর চেনে মাধবী। পিসিশাশুড়ি একদিন বলেছিলেন- ‘ঘরে লক্ষ্মীর পা পড়েছে গো, সুন্দরী বউ পেয়েছে মৃন্ময়।’ আজ তার কপালে জুটেছে অলক্ষ্মীর তিলক। অঝোরে চোখের জল ফেলা ছাড়া কিছু করার ছিলনা মাধবীর।
সাদা থান কাপড় পরা মাধবী যখন বাপের বাড়ি এলো, তখন বাবা-মা দাদু কারোর মুখে কোনও কথা নেই। পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো মাধবী। সতীনাথ মেয়ের জিনিসপত্র নিঃশব্দে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মাকে ঝাপসা দেখেছিল সে। পা এগোতে চায় না। জোর করে শরীরটা টেনে নিয়ে যায় মায়ের কাছে। মা-মেয়ের কান্না যেন থামতেই চায়না!
সরলা মাসি এলেন দুদিন পর। মাধবীকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করলেন। তারপর মাধবীর হাতে হাত রেখে বললেন- ‘দেখো মেয়ে, ভগবানের কী ইচ্ছা তা তো জানিনা! তবে নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে হবে। বাবা-মা চিরকাল থাকবেন না; তা সত্যি। নিজের পায়েই দাঁড়াতে হবে তোমাকে। আমি যেরকম তোমার মেসোর অসময়ে চলে যাওয়ার পর হাত পা ছেড়ে বসে থাকিনি অন্যের ভরসায়, তোমাকেও তাই করতে হবে। আমি যে সেবা কেন্দ্রে অনেক বছর কাজ করেছি, সেখানে নার্সিংয়ের কাজ পাইয়ে দেব। ডাক্তার হালদার খুব ভালো মানুষ। একটা সুযোগ নিশ্চয়ই করে দেবেন।
কুসুম আপত্তি করেনি। ডাক্তার হালদার যেন দেবতার আরেক রূপ। মায়ার বাঁধনে জড়ালেন মাধবীকে। সুযোগ করে দিলেন নার্সিং ট্রেনিংয়ের। সেই সুযোগ হাতছাড়া করেনি মাধবী। সরকারি হাসপাতালে চাকরি জুটে যায়। জীবনকে নতুন করে সাজানোর চেষ্টা করে সে।
সিস্টার মাধবী। এই নতুন পরিচয় নিয়ে বড় ভাল লাগছিল মাধবীর। অকালে মরে যাওয়া সুখ নতুন রূপে এসেছে জীবনে। পরের সেবা করার সুখ নিজের ব্যক্তিগত সুখের চেয়ে অনেকগুণ বেশি- এই অনুভূতিতে তৃপ্ত তার মন। কোনও পিছুটান নেই। কেবল এগিয়ে যাওয়া।
এই এগিয়ে যাওয়ার পথে নানা হাতছানি। কোনওটা ভালো, কোনওটা মন্দ। পা ফসকালেই ছন্দ হারিয়ে যাওয়ার ভয়। নিজের ছোট্ট পৃথিবীর পরিবৃত্তে আপন খেয়ালে থাকতে চায় মাধবী। এই সময়ে ডাক্তার অনিমেষ তার ধ্রুবতারা। এমন নিঃস্বার্থ সেবাব্রতে কেউ রয়েছেন বলে জানা নেই মাধবীর। রোগী অন্তপ্রাণ এই মানুষটিকে দেখলে বড় মায়া হয় তার। মনে হয় এই আত্মভোলা মানুষটির পাশে দাঁড়ানোর কেউ কি নেই? বাড়ির লোকজন, নিকট আত্মীয় কেউ কি তার জন্য ভাবেন না! এত ধকল সইবেন কি করে ডাক্তার অনিমেষ!
এক অজানা ভাইরাস এসে দিশেহারা করেছে পুরো বিশ্বকে। মারণ রোগ এতটাই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যে তাকে আটকানোর কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না গবেষকরা। ডাক্তার অনিমেষ সেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের একজন। মাধবী দেখতে পায় গবেষণার কাজে মগ্ন অনিমেষ যেন নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিতে চাইছেন। ল্যাবের কাজে দিনরাত ভুলে কাজ চলছে অনিমেষের। মাধবী যখনই সুযোগ পায় ডাক্তার অনিমেষকে খেয়াল রাখার চেষ্টা করে। অনিমেষের ভালো লাগে মাধবীর খেয়াল রাখার বিষয়টি। বলেন- ‘তোমার নিজের খেয়াল রাখো। আমার জন্য ভেবোনা। ঈশ্বর আমাকে শক্তি দেবেন। এই অসুখের নিরাময়ের পথ যে খুঁজে বের করতেই হবে আমাদের।’
মাধবীর জীবনের ক্যানভাসে নতুন রঙের ছোঁয়া লেগেছে বুঝি! সে কি তবে খুঁজে পেয়েছে তার জীবনের ধ্রুবতারাকে!
লেখক মনোমোহন মিশ্র কুড়ি বছরের অধিক সময় ধরে লেখালেখির সঙ্গে জড়িত। কবিতা, গল্প, রম্য রচনার বই ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি হিন্দি কবিতার অনুবাদও করেছেন। বর্তমানে তিনি অসমের শিলচর থেকে প্রকাশিত ‘গতি’ দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক।তাছাড়া লেখক একজন তবলাবাদক ও শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত রয়েছেন।
Comments are closed.