কোটি কোটি টাকা খরচ করেও এনআরসির কাজে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা এই প্রক্রিয়াকে একটা গোঁজামিলে পরিণত করেছে"- সুস্মিতা দেব
সন ২০১৪, মোদী-ঢেউ সমগ্র ভারতবর্ষের রাজনৈতিক মানচিত্রকে পাল্টে দিলেও শিলচরে উনি স্রোতের বিপরীতে সাঁতরে পার হয়েছিলেন। আর তখন থেকেই দলে এবং জাতীয় রাজনীতিতে শুরু হয় উত্তরণ সুস্মিতা দেবের। বাবার হাত ধরে রাজনীতিতে প্রবেশটা অনেক সহজ হলেও ইতিমধ্যে তিনি এক স্বতন্ত্র পরিচিতি তৈরি করে নিয়েছেন। সেনিটারি ন্যাপকিন নিয়ে আন্দোলনের সফল নেত্রী, কংগ্রেসের মুখপাত্র, সারা ভারত মহিলা কংগ্রেসের সভানেত্রী এবং সক্রিয় সংসদ সদস্য হিসাবে তার পরিচিতি ‘সন্তোষ মোহন দেবের কন্যা’ পরিচয়কে ছাপিয়ে গেছে। দলের মধ্যেও তিনি অন্যতম শীর্ষ স্থানেই আছেন। কংগ্রেস নেতৃত্ব তাকে শশী থারুর, পি চিদাম্বরম প্রমুখদের সাথে ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের ইস্তাহার কমিটিতে নির্বাচিত করেছে।
জাতীয় পর্যায়ে দল যেখানে ব্যালটের মাধ্যমে দিল্লিতে ফিরে আসার প্রয়াস করছে, নিজের কেন্দ্রে সুস্মিতাকে এনআরসি সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে হচ্ছে। জাতীয় নাগরিক পঞ্জীর চূড়ান্ত খসড়া থেকে ৪০ লাখ লোকের নাম বাদ পড়ায় নাগরিকত্ব নিয়ে বিতর্কে প্রায়শই রাজ্য নেতৃত্ব এবং জেলা নেতৃত্বের মতামতে আসমান-জমিন ফারাক দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া, এই প্রথমবার প্রাক্তন সহকর্মী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা তার বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রচারে নামছেন। মাঝেমধ্যে গৌতম রায়কে নিয়েও গুজব চলছে।
Barakbulletin.com এর সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি নির্বাচনী প্রস্তুতি এবং অন্যান্য বিষয়ে জানিয়েছেন। সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ তুলে ধরা হলো :
আপনি কি মনে করেন রাজ্য সরকার এনআরসির এই প্রক্রিয়ায় জনগণের কথা ভাবছে, তাদের দুঃখ কষ্টের খেয়াল রাখছেন?
আমি সুপ্রিম কোর্টকে শ্রদ্ধা করি, কিন্তু আমি বলতে ভয় পাইনা যে এনআরসির কাজে নিযুক্ত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার দ্বারা এই প্রক্রিয়াটি একটা জগাখিচুড়িতে পরিণত হয়েছে। শত শত কোটি টাকা খরচ হচ্ছে, সব উন্নয়ন মূলক কাজ ফেলে আধিকারিকরা এনআরসির কাজে লেগে আছেন। কিন্তু এতসবের পরেও দেখা যাচ্ছে একটা পরিবারের কয়েকজনের নাম চূড়ান্ত তালিকায় আছে আবার কয়েকজনের নেই, যা খুবই অবাস্তব। রাজ্য সমন্বয়ক প্রতীক হাজেলা প্রতিনিয়ত এবং খেয়ালখুশি মতো প্রয়োজনীয় নথির ব্যাপারে গোলপোস্ট পরিবর্তন করে চলেছেন; ফলে সাধারণ জনগণ ভুগছেন। আমি সন্দেহ করছি যে, এনআরসি-ছুটদের সংখ্যা ৪০ লাখ ইচ্ছাকৃতভাবেই করা হয়েছে যারা বিদেশিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে, তাদেরকে খুশি করার জন্য। এটা একটা ষড়যন্ত্র এবং বাঙালিরাই বৈষম্য মূলক আচরণের শিকার।
৪০ লাখ লোক আজ প্রায় রাষ্ট্রহীন, সবার এই আইনি লড়াই লড়ার ক্ষমতাও নেই; ওদের ভবিষ্যৎ কি হতে পারে?
আমি খুবই নিশ্চিত যে আমাদের সংবিধান সবাইকে বেঁচে থাকার অধিকার দিয়েছে, এমনকি বিদেশিদেরও। যথেষ্ট আইনি সহায়তা না পেলে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র লক্ষ লক্ষ লোকদের রাষ্ট্রহীন নাগরিক তৈরি করবে। বাংলাদেশ ওদের ফিরিয়ে নেবেনা, তাহলে ওরা কোথায় যাবে! সরকারের তরফ থেকেই আইনি সহায়তার ব্যবস্থা করা উচিত । ভারতবর্ষে শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে কোন যুৎসই আইন নেই। বিজেপি সরকার দ্বারা আনীত নাগরিকত্ব বিলেও নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারে সঠিক সংস্থান নেই এবং এটা অসংবিধানিক হিসেবে আদালতে আটকে যেতে পারে। এটা ইচ্ছে করেই খুব বাজে ভাবে তৈরি করা হয়েছে ।
বলা হচ্ছে,এনআরসির সাথে ডি-ভোটার ইস্যুর সরাসরি কোনো যোগাযোগ নেই । কিন্তু দুটোতেই সাধারণ নাগরিকদের চূড়ান্ত হেনস্থা হতে হচ্ছে। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে এই ব্যপারে আপনার প্রতিক্রিয়া কি? সাংসদ বা বিধানসভার সদস্য হিসেবে ভূমিকাই বা কী ?
আমি মনে করি,এই ডি-ভোটারের ধারণাটা একেবারেই অসাংবিধানিক। জনগণকে আইনি সহায়তা দেওয়াটাই আমার ভূমিকা হবে, কিন্তু দল হিসেবে আমরা সকল নাগরিকের পাশে দাঁড়াবো। যারা ২০১৪ এবং ২০১৬ সালে ভোট দিয়েছিল, জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমি তাদের কাছ থেকে দূরে সরতে পারিনা। বিগত নির্বাচনগুলোতে যারা ১৪ জন এমপি এবং ১২৬ জন এমএলএ নির্বাচিত করেছিল, সেই ভোটাররা ভারতীয়।
আমি রাজনীতিকে ক্ষমতা প্রদর্শনের হাতিয়ার হিসাবে নেই না। আমি আমার দলের মাধ্যমে জাতির সেবা করছি। আমি আমার জনগণের প্রতিনিধি, তাদের শাসক নই।
আপনি শিলচর থেকে নির্বাচিত সাংসদ, সম্প্রতি গৌতম রায় আমাদের প্রতিনিধিকে বলেছিলেন যে তিনি দলীয় টিকেট পেলে শিলচর থেকে লোকসভা নির্বাচনে দাঁড়াতে পারেন। কংগ্রেসের ভেতরে এই নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্ব হলে কে চূড়ান্তভাবে বিবেচিত হবে?
নির্বাচনে টিকিট চাওয়ার অধিকার সবারই আছে এবং এই নিয়ে দলীয় হাইকম্যান্ড সিদ্ধান্ত নেবে। হাই কম্যান্ডের যে কোনো সিদ্ধান্ত আমি মেনে নেব।
আপনাদের একসময়ের কংগ্রেসকর্মী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ২০১৬ সালে দল ত্যাগ করার পর এই উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজনৈতিক মানচিত্রে অনেক পরিবর্তন হয়ে গেল। গৌতম রায়ের ক্ষেত্রেও কি এরকম একটা সম্ভাবনা আছে?
বিশ্ব শর্মার দল ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে আমি অনৈতিক বলে মনে করি। গৌতম রায় একজন বর্ষীয়ান নেতা, উনার ব্যাপারে আমি কোনো অনুমান ভিত্তিক কিছু বলতে চাই না। কংগ্রেসে থেকে তিনি অনেক কিছু পেয়েছেন, তিনি কেন কংগ্রেস ত্যাগ করবেন!
যদি ধরে নেওয়া যায় যে , ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে আপনি গৌতম রায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, তাহলে তাকে ব্যালটে পরাজিত করতে আপনি কতটুকু স্বচ্ছন্দ বোধ করবেন?
একজন দায়িত্বশীল রাজনৈতিক হিসেবে আমি অনুমানের ওপর চলি না। সর্বাবস্থায়ই, আমি যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড়াই তার সাথে আমার কোন ব্যক্তিগত শত্রুতা থাকে না, এটা আদর্শের লড়াই। তাছাড়া, হার জিত এর ব্যাপারটা কাছাড়ের জনগণের ওপরই নির্ভর করবে।
খবরে জানা গেছে, আগামী লোকসভা নির্বাচনে শিলচর কেন্দ্র থেকে কবীন্দ্র পুরকায়স্থকে বিজেপি প্রার্থী করা হতে পারে। কবীন্দ্র পুরকায়স্থ এবং গৌতম রায় এই দুজনের মধ্যে আপনি প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে কাকে প্রবলতর হিসাবে মনে করেন?
আমি মনে করি, এই প্রশ্নের উত্তর আমি ইতিমধ্যে দিয়ে দিয়েছি।
আপনি জাতীয় রাজনীতিতে বেশ ভালোভাবে জড়িয়ে আছেন । স্যানিটারি ন্যাপকিন ইস্যুই হোক বা মুম্বাইয়ের স্থানীয় ব্যাপার সেপার হোক, আপনি খুবই ব্যস্ত। জাতীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সাথে আপনি কি স্থানীয় রাজনীতি এবং দলীয় কর্মীদের যথেষ্ট সময় দিতে পারবেন?
আমার প্রাথমিক কর্তব্য হচ্ছে সাম্প্রদায়িক এবং ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলো, যা ইদানিংকালে ভারতবর্ষে খুব মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা। আমার নির্বাচনী এলাকার জনগণই আমার প্রাথমিকতা এবং আমি দুটো কাজই দায়িত্ব সহকারে পালন করে চলেছি। সাংসদ এই সাক্ষাৎকারটি ইংরেজিতে দিয়েছিলেন এবং তা বাংলায় ভাবানুবাদ করা হয়েছে। তাই অনুবাদে শব্দের কিছুটা তারতম্য হতে পারে।
Comments are closed.