Also read in

ভারতে করোনা নিয়ে শত কড়াকড়ির মধ্যেও নিজামুদ্দিন মরকজ নজর এড়িয়ে গেল! দায়ভার কার?

সাত দিনের দুঃসহ উদ্বেগ এক মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল আশঙ্কার গভীর গর্তে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হঠাৎই পালটে গেল গোটা চালচিত্র। অসমে এখনও একটিও পজিটিভ মেলেনি, পরিসংখ্যানের এই খড়কুটো হঠাৎ যেন তলিয়ে গেল আশঙ্কা, হতাশা আর মৃত্যুভয়ের অতল গহ্বরে। এবং আমি টের পাই, করোনা আতঙ্ক ছাপিয়ে দ্রুত, ভীষণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে বিদ্বেষের বিষবাষ্প। মেরুকরণের বিষাক্ত ভাইরাস।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় শিলচর মেডিক্যালে একজনের লালারসের নমুনা পজিটিভ জানা যায়। তখনও মানুষটির পরিচয় জানা যায়নি। শুধু এটুকু জানা যায় যে, তিনি বদরপুর শ্রীগৌরী এলাকার। এবং তিনি গুয়াহাটি গিয়ে হাতিগাঁওয়ে ছিলেন। ব্যস, তক্ষুনি, ঠিক তক্ষুনি রেডক্লিফ সাহেবের ভূত ধারালো ছুরি দিয়ে মেরুকরণের মানচিত্রটা স্পষ্ট দেগে দিলেন।

আগের রাতেই টিভির ব্রেকিং-এ নিজামুদ্দিনের বাংলেওয়ালি মরকজে তবলিগ জামাতের ‘ভয়াবহ’ খবরে মেরুকরণের প্রেক্ষাপট রচিত হয়ে গিয়েছিল। শুধু কনফার্মেশনটুকু বাকি ছিল। বদরপুর হাতিগাঁও নিজামুদ্দিন কানেকশন সেটুকু পূর্ণ করে দিল। এই দুর্যোগের প্রহরে শুরু হয়ে গেল ঘৃণা বিদ্বেষের তুমুল উদগীরণ।গোটা মুসলিম সমাজকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। তবলিগ মানে কী, মুসলমান সমাজে তবলিগ কতটুকু স্বীকৃত, তবলিগের গ্রহণযোগ্যতা মুসলমান সমাজে আছে কি না, এ সব না জেনেই কিছু মানুষ সোশাল মিডিয়ায় মুসলিমদের এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী করতে শুরু করে দেয়। এতে বিপর্যয় কাটবে না, বরং সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ালে প্রশাসনের পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া অসম্ভব হয়ে উঠবে, এই বোধটুকুও যেন ততক্ষণে কর্পূরের মতো উবে গেছে।

করোনা-কাউন্টডাউন – ডে-১: “তা হলে কীভাবে ব্যবস্থা হবে আমার মায়ের প্রেশারের ওষুধ”

আসলে এরও দুটো কারণ আছে। ব্যক্তিগত বলুন বা সামূহিক, বিপর্যয়, এমনকী বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিলেও মানুষ এর দায় এমন কারোর ঘাড়ে চাপাতে চায়, চেতনে অবচেতনে যার প্রতি বিদ্বেষ রয়েছে। যেমন, করোনা চিন থেকে ছড়িয়েছে, এর জন্য পাশের বাড়ির কোনও বামপন্থী, এমনকী তথাকথিত লিবারেল মানুষকেও দু’চার কথা শুনিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যেন চিনের ভাইরাসের জন্য এই ‘সেকু-মাকু’ই দায়ী। আসলে অসহায়তা যে ক্ষোভ-ক্রোধ-হতাশার জন্ম দেয়, মানুষ এর জন্য কাউকে দায়ী করে তা ভেন্টিলেট করতে চায়। এটা কোনও মতেই অস্বীকার করা যায় না যে আমাদের দেশ বা সমাজে হিন্দু মুসলিমের মধ্যে একটা বিদ্বেষের প্রাচীর রয়ে গেছে। শুধু হিন্দু মুসলিম কেন, ভাষা, অঞ্চল, জাতপাতের বিভেদও রয়েছে, এবং পরিস্থিতির রকমফেরে এর অমানবিক বহিঃপ্রকাশও ঘটে। যেমন, বরাক উপত্যকার এক ব্যক্তির শরীরে করোনার ভাইরাস পাওয়া গেছে শুনে গুয়াহাটিতে আমার এক আত্মীয়াকে তার বন্ধু ফোনে বলেছে, এই বরাকর বঙালকেইটার বাবেই অসমত করোনা সোমাল।

এবার উলটো দিকটা দেখা যাক।

পরিচিত মুসলিমদের কাছে শুনেছি তাঁদের সমাজের কিছু মানুষ সোশাল ডিস্টান্সিং ও লকডাউনের পেছনে বিজেপি সরকারের হাত রয়েছে বলে মনে করে। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে অধিকাংশ মুসলিম মানুষই সোশ্যাল ডিস্টান্সিং ও লকডাউন মেনে চলছেন। কিন্তু সব কিছুতে বিজেপির জুজু দেখা কিছু কট্টর মুসলিম তাঁদের ঠাট্টা পর্যন্ত করেছে। এমনিতেই মুসলিম সমাজে শিক্ষার হার অনেক কম। না হলে ভাবা যায়, লকডাউন চলার সময়ই কাটিগড়ার নুননগর গ্রামে দল বানিয়ে ফুটবল খেলা হচ্ছে, আর তা দেখতে উপচে পড়ছে ভিড়! ফলে এই অশিক্ষিত অংশকে ধর্মের দোহাই দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধাচরণে প্ররোচিত করা সহজ।
মুসলিম বন্ধুদের কাছেই এ সব কথা শুনেছি। কিন্তু মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পরিস্থিতি পালটে গেল। এই মুসলিম বন্ধুদেরই অনেকে মনে করছেন, মুসলিম সমাজ ও ধর্মকে হেয় করার জন্য নিজামুদ্দিন পর্ব টেনে আনা হচ্ছে। শ্রীগৌরীর ওই তবলিগি ভদ্রলোক আদৌ পজিটিভ কি না, এই প্রশ্নও তুলছেন কেউ কেউ। তাঁদের যুক্তি, ওই লোকটি নয় মার্চ নিজামুদ্দিনে গিয়েছিলেন, পজিটিভ হলে চৌদ্দদিন অর্থাৎ ২৩ তারিখের মধ্যে ধরা পড়ে যেত। এবং ২৯ তারিখ তিনি যখন শিলচর মেডিক্যালে এলেন, ততদিনে তাঁর রোগ বড় আকার নিয়ে নিত।

“লকডাউনের জাবড়ামি”: অরিজিৎ আদিত্য

প্রশ্ন হচ্ছে, নিজামুদ্দিনের নাম জড়িয়ে যাওয়ার পর আমার এই বন্ধু বা পরিচিতদের এই সুরবদলের কারণটা কী? এঁরা কেউ কিন্তু তবলিগি পন্থায় বিশ্বাসী নন, অনেকেরই তবলিগ সম্পর্কে এলার্জি রয়েছে। কিন্তু তারপরও তাঁরা মনে করছেন, শুধু মুসলিম বলে তবলিগ সদস্যদের দায়ী করা হচ্ছে। এর কারণ একটাই। সংখ্যালঘুর সহজাত ডিফেন্স মেকানিজম। নিজামুদ্দিন পর্ব সামনে আসার পর মেইনস্ট্রিম মিডিয়া থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়ায় যেভাবে পরোক্ষে-প্রত্যক্ষে মুসলিমদের দায়ী করা হচ্ছে, তাতে আকাশে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন মুসলিমরা। করোনা ত্রাস ডিঙিয়ে যেভাবে মেরুকরণের প্রেক্ষাপট দ্রুত তৈরি হয়ে যাচ্ছে তাতে বড় বিপদের অাঁচ পাচ্ছেন মুসলিমরা। একটি কালরোগের সঙ্গে তাঁদের ধর্মকে জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে অনেকে যেমন ভাবছেন আবার অনেকে মানসিকভাবে ভেঙেও পড়েছেন। ভয়টা ঠিক সেখানেই। নিজের ধর্মকে কালিমামুক্ত করতে তাঁরা যদি কোনও অপরিনামদর্শী মন্তব্য করেন বা কিছু করে বসেন তাহলে লকডাউনের ওপর খাড়ার ঘা পড়বে। নিজামুদ্দিন পর্বের জন্য কিছু অত্যুতসাহী যেভাবে পুরো মুসলিম সমাজকেই গালিগালাজ করছেন, তাঁদের বুঝতে হবে৷ এতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তাঁদের বুঝতে হবে, এই শিলচরের মসজিদগুলোয় জুম্মার নামাজ হয়নি। এই উপত্যকার মুসলিম ধর্মগুরুরা লকডাউন মেনে চলার ডাক দিয়েছেন। মানুষ প্রজাতির অস্তিত্বই আজ গভীরতম সংকটে। দোষারোপের সময় নয় এটা। এখনও যদি আমরা তা উপলব্ধি করতে না পারি তা ‘ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না’ বলে যে কথা আমরা বলে অভ্যস্ত, সেটা বলাও বাতুলতা হবে, কারণ ইতিহাস লেখার লোকও হয়তো থাকবে না।

যে নিজামুদ্দিন মরকজ বা তবলিগ জামাতকে নিয়ে এতো হুলুস্থুলের মধ্যে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। করোনা ভাইরাস নিয়ে বিশ্ব জুড়ে ত্রাহি ত্রাহি রবের মধ্যেই ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ শ্রীপেটালিং মরকজে বিশ্ব সম্মেলনের আয়োজন করে। সেখানে জমায়েত হয়েছিল যারা তাদের মধ্যে ৬০০ জনের করোনা ভাইরাস পজিটিভ ধরা পড়ে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় একসঙ্গে এতজনের সংক্রমণ আর হয়নি। এরপর ১৮ মার্চ থেকে ইন্দোনেশিয়ার মাকাস্সরে জমায়েতের ডাক দেওয়া হয়। কিন্তু ইন্দোনেশিয়া সরকার তা বাতিল করে দেয়। লাহোরেও দেড় লক্ষ লোকের জমায়েত হয়েছিল, তবে পাকিস্তান সরকার তা বাতিল করে দেয়। সেখানে হাজির দেড় লক্ষ লোকের মাধ্যমে করোনা ছড়ানোর খবর রয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতে করোনা নিয়ে এতো কড়াকড়ির মধ্যে নিজামুদ্দিন মরকজের ওপর কেন নজর দেওয়া হলো না? অমিত শাহের পুলিশ বনাম কেজরিওয়াল সরকারের অহং-এর সংঘাত কি এর কারণ?

নিজামুদ্দিনের ওপর নজর রাখার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। নিজামুদ্দিন মরকজের আমির মওলানা সাদ। ইউটিউবে নিজামুদ্দিন মরকজের জমায়েতে ভাষণের যে অডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে, ধারণা করা হচ্ছে, এটা মওলানা সাদের কণ্ঠ। সরাসরি লকডাউন ও সোশ্যাল ডিস্টান্সিং অমান্য করার আহ্বান রয়েছে ওই ভাষণে৷ বলা হয়েছে, মুসলিমদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করতেই সোশাল ডিস্টান্সিঙের ছক কষেছে সরকার। বলা হয়েছে, আল্লাহ মুসলিমদের করোনার হাত থেকে রক্ষা করবেন। ফলে সোশ্যাল ডিস্টান্সিং মানার কোনও প্রয়োজন নেই।

থেকে সাইরাং/ প্রবাসে দৈবের বশে – লিখছেন‌ অরিজিৎ আদিত্য

দিল্লির বুকে বসে মরকজে এমন ভাষণ দেওয়া হচ্ছে, অথচ পুলিশ গোয়েন্দা কিচ্ছুটি টের পেল না! এর দায় কার? গণআবেগে পুলওয়ামা কাণ্ডে গোয়েন্দা ব্যর্থতার বিষয়টি চাপা পড়ে গিয়েছিল, এবারও করোনা আতঙ্কে ঠিক একইভাবে ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে দিল্লি পুলিশ ও কেজরিওয়াল সরকারের ব্যর্থতা।

হ্যাঁ, ব্যর্থতাই বটে। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা তবলিগ সদস্যদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠেছে বারবার। উঠেছে আমেরিকা, ফ্রান্স, স্পেনের মতো দেশে। ফ্রান্সে মুসলিম সন্ত্রাসীদের আশি শতাংশই তবলিগের। এফবিআই-র সহকারী ডিরেক্টর মাইকেল হেইমবাগ স্পষ্ট বলেছিলেন, আল কায়দার সঙ্গে তবলিগের সদস্যদের যোগ রয়েছে। ৯/১১ হামলায় যারা ধরা পড়েছিল তাদের মধ্যে তবলিগের এক সদস্যও ছিল। আমেরিকান ফরেন পলিসি কাউন্সিলের রিপোর্টে বলা হয়েছে, জিহাদিদের পরোক্ষ সমর্থক তবলিগ সারা বিশ্বে ইসলাম কায়েম করতে চায়।

১৯২৭ সালে ভারতের মেওয়াটে তবলিগের প্রতিষ্ঠা করেন মহম্মদ ইলিয়াস। উদ্দেশ্য একটাই, কোরানের বিধি মেনে সাচ্চা মুসলমান গড়ে তোলা। স্বাধীনতা আন্দোলনের ওই উত্তাল সময়ে তেমন আমল পায়নি তবলিগ আন্দোলন। দেশভাগের তোড়জোড় শুরু হতেই তবলিগের শক্তি সঞ্চয় শুরু হয়ে যায়। ১৯৪৭-এ দেশ ভাগ হওয়ার পর তবলিগ পাকিস্তানে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান মিলিয়ে তবলিগের মানচিত্র তখন যথেষ্ট বিস্তৃত।

মৃত্যুকে ছাপিয়ে জন্মে জয়গান জীবনের: লিখেছেন অরিজিৎ আদিত্য

তবলিগের একটি বিশেষত্ব হল, রাজনীতি থেকে এই সংগঠন দূরত্ব বজায় রাখে। কোরান মেনে ইসলাম অনুসরণই তবলিগের একমাত্র অভীষ্ট। কিন্তু পাকিস্তানে রাজনীতিতেও পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে তবলিগের। নওয়াজ শরিফের বাবা তবলিগ জামাত ছিলেন। নওয়াজ প্রধানমন্ত্রী হয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে তবলিগকে জড়াতে শুরু করে দেন৷ বেনজির ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে সামরিক অভুত্থানের যে চেষ্টা হয়েছিল তাতে তবলিগ জামাতও জড়িত ছিল। আশ্চর্যের বিষয়, সংবেদনশীল এই সময়ে দেশের রাজধানীতে তবলিগের ওই সম্মেলনে করোনা আক্রান্ত দেশ থেকে জামাতিরা ভিড় জমালেও পুলিশ গোয়েন্দারা ভাতঘুমে। বিমানবন্দরেও যে কী পরীক্ষা হলো খোদায় মালুম।

প্রসঙ্গত নিজামুদ্দিন মরকজ হচ্ছে তবলিগ জামাতের আন্তর্জাতিক সদর দফতর। বর্তমান আমির মওলানা সাদ হচ্ছেন প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ইলিয়াসের প্রপৌত্র। ২১৪ টি দেশের একশ কোটি মুসলিম তাঁর অনুগামী। কী আশ্চর্য, এমন এক প্রভাবশালী ধর্মগুরু করোনার মতো মারণব্যাধিকে উপেক্ষা করে তাঁর অনুগামীদের অন্ধত্বের দীক্ষা দিলেন ধর্মের দোহাই দিয়ে। এ তো আসলে ধর্মের সঙ্গে না-ইনসাফি। মুক্তার আব্বার নকভি ঠিকই বলেছেন—–নিজামুদ্দিনে যা হয়েছে তা আসলে তালিবানি অপরাধ। এক অক্ষমনীয় পাপ।

খুব শুনি, করোনা-উত্তর পৃথিবী হবে এক অন্য পৃথিবী। আমি কায়মনোবাক্যে তাই প্রার্থনা করি। প্রার্থনা করি, করোনা-কালবেলা মন্থন করে এমন এক ধরিত্রী জেগে উঠুক যেখানে প্রাতিষ্ঠানিকতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে ধর্ম হবে মানবতার ধর্ম।

হুবাই না ইতালি! নিক্তিতে মাপার দায় ঘরমুখো ভিড়ের

Comments are closed.