টেট্ বনাম উচ্চশিক্ষা : একটি চ্যালেঞ্জ
বরাক উপত্যকা এমন এক স্থান যে এখানের যেকোন বিষয়ের পর্যালোচনা করার আগে স্বাভাবিকভাবেই দর্শন বদলে যায়, হয়তো এটা আমাদের জন্মগত দুর্ভাগ্য! আসামে ২০১২ সালে প্রথম টেট পরীক্ষা হয়, সেই টেট পরীক্ষা অনেক মেধাবী ছাত্রের উচ্চশিক্ষার যাত্রা স্তব্ধ করে দিয়েছিল, তারপর ২০১৪ সালে মিডিয়াম টেট হয় এবং সেই একইভাবে দুরন্ত গতিতে এগিয়ে যাওয়া কিছু ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রদের শিক্ষার যাত্রায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় এই টেট। ইদানীং টেটের প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে অনেক নব প্রজন্মের মেধাবীদের। এই আকর্ষণ ইতিবাচক না নেতিবাচক? টেট কি তবে উচ্চশিক্ষার জন্য অভিশাপ? না টেট বেকারত্ব দূরীকরণের একমাত্র উপায়? আপনি কি এই দ্বন্দ্বে আছেন? তবে আপনার কি করা উচিত? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অনেকেই এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে পড়েন। তাই নৈব্যর্ক্তিক দৃষ্টিতে এই বিষয়ে পর্যালোচনার জন্যই আজকের এই লেখনী। স্বাভাবিকভাবেই এসব বিষয়ে কথা বলতে গেলে লেখা অনেক লম্বাচওড়া হয়ে যায়, তবুও চেষ্টা অবশ্যই থাকবে সংক্ষেপে প্রকাশ করার।
টেটে এতো আকর্ষণ কেন? এর উত্তর সোজা ভাষায় দিতে হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ তুলে ধরতে হয়:
আসামে বিগত তিন দশক ধরে সরকারি চাকরিকে পুরো উধাও করে রাখা হয়েছিল। অগপর দশ বছর তো রাজনৈতিক ক্যাডারদেরও ভাগ্যে চাকরি মিলেনি, এসময়ে প্রচুর সংখ্যক গ্রাজুয়েট, পোস্ট গ্রাজুয়েটের সংখ্যা রাজ্যে বৃদ্ধি পায়। কংগ্রেস আমলের প্রথম দশবছর শুধুমাত্র রাজনৈতিক লাঠি হিসাবে ব্যবহৃত ব্যক্তিবিশেষের ভাগ্যে চাকরি জুটেছে, বড় মাপের কোন নিয়োগ এসময় হয়নি, বিভিন্ন বিভাগের বিভিন্ন সময় খালি হওয়া ২০/২৫ টি বা ৫০/১০০ টি পোস্টের চাকরি শুধুমাত্র চ্যানেল কেন্দ্রিক ও অর্থের প্রাধান্যে হয়েছে, মেধার কোন প্রশ্নই আসেনি। এই দুই দশকে আসামে শিক্ষিত বেকারদের হার চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। তখন এই শিক্ষিত বেকারদের একটি বিরাট অংশ রাজ্যের বিভিন্ন প্রাইভেট স্কুলে অত্যন্ত নূন্যতম বেতনে কর্মরত ছিলেন, কিছু সংখ্যক রাজ্যের বাইরে বিভিন্ন কোম্পানিতে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হলেও বাকি একটি অংশ বিভিন্ন ছোটখাটো ব্যবসা বাণিজ্যে নিজেদেরকে মানিয়ে নেন। এমতাবস্থায় ২০১২ সালে কংগ্রেস সরকার টেটের আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিলে এই স্থিতিশীল শিক্ষিত বেকাররাই এই টেটের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করেন এবং অনেক সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি চাকরি লাভ করেন। অনেক উচ্চশিক্ষিত মেধাবী ব্যক্তি বিশেষ জীবনের শেষ লগ্নেই নিজেদের মূল্যায়ন হয়েছে ভেবে আবেগ আপ্লুত ছিলেন। তপ্ত মরুভূমিতে এক পশলা বৃষ্টি হলে যে আনন্দ হয় টেটের এই চাকরিগুলো সেই পরিবেশের সৃষ্টি করে এবং মানুষের অন্তত এই বিশ্বাস জন্মে যে ভালো পড়াশুনা করলে বিনা টাকায় চাকরি হবে। এই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ২০১৪ সালে আবার বৃহৎ সংখ্যক প্রার্থী টেটে বসে এবং তখনও অনেকেই চাকরি অর্জন করে। স্বাভাবিকভাবেই এই পরিবেশ বরাক উপত্যকায় এক নতুন মোড় নেয় ও টেটের প্রতি আকর্ষণ জন্মায়।
বড় বড় মহানগর গুলোতে শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের যথেষ্ঠ সুযোগ আছে, বিভিন্ন বড় কোম্পানি, হাসপাতাল, বাণিজ্যিক শিল্প প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিতে মোটামুটি শিক্ষিতরাই একটা ভালো কর্মসংস্থান পেয়ে যান। কিন্তু দুর্ভাগা আসামের বিভিন্ন অঞ্চল বা বরাকে উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ করার পরও নিরাশ হয়ে দিন কাটানো ছাড়া বিকল্প কিছু থাকে না। অনেক গরীব ছাত্ররা যদিও ডাক্তার, বা বড় মাপের ইঞ্জিনিয়ার হয়ে কর্মসংস্থান পেয়ে যায় তবে এসব ঘটনা শুধুমাত্র উদাহরণ হিসাবেই প্রযোজ্য। সামগ্রিকভাবে মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিতদের করুণ হাল একমাত্র ভুক্তভোগীরাই অনুধাবন করতে পারবেন। অনেক কারণে অধিকাংশ বেকারদের জন্য রাজ্য বা দেশের বাইরে গিয়ে কর্ম করার পরিবেশ থাকেনা। তাই এক হাহাকার অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে টেট দিয়ে চাকরি পাওয়ার সহজলভ্যতা অনেকের কাছে একমাত্রই বিকল্প হয়ে দাঁড়ায়।
ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং বা পাব্লিক সার্ভিসের পড়াশুনায় যথেষ্ট খরচ বহন করতে হয় ও দীর্ঘদিন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়, এই দীর্ঘদিন পড়াশুনা ও দেখাশোনার দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করে যাওয়ার যোগ্যতা সব অভিভাবকদের থাকেনা (ব্যতিক্রম আছে)। ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি লাভের পর এই যোগ্যতা অনুযায়ী দেশে কর্ম সংস্থানের চরম সংকট বেড়েই চলেছে, ডাক্তারি পদের সংখ্যা অত্যন্ত নূন্যতম। কমার্স গ্রেজুয়েটদের যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও বরাকে এরা সুপার ফ্লপ। পাব্লিক সার্ভিসে এক্সট্রা অরডিনারি ও জিনিয়াসরাই বাজিমাত করে থাকে তাই নিম্ন ও মধ্যশ্রেণীর মেধাবীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ একদম শূন্যের কোটায়, এই শূন্যের কোটা পূরণের জন্য সরকারের কাছেই অন্য কোন পরিকল্পনা নেই। তাই এসব বেকাররা শুধু টেট পাশ করে চাকরি পাওয়ার স্বপ্নতেই বিভোর।
হাইস্কুলে ও হাইয়ার সেকেন্ডারিতে হাজার হাজার পোস্ট খালি। কিন্তু সরকারের কোন হেলদোল নেই, তাই মাস্টার ডিগ্রি ও বিএড করেই কেউ কেউ বসে আছেন বা নূন্যতম টাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়াচ্ছেন। আমাদের এই অনুন্নত বরাকে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত টিকে থেকে বিএড ডিগ্রি নেওয়া পর্যন্ত একজন বেকার কতটা আর্থিক সংকটে পড়াশুনা করে তার দুর্দশা বর্ণনার প্রয়োজন নেই। তাই অনেকেই টেট দিয়ে নিম্ন প্রাথমিকের চাকরির ক্ষেত্রে নিজেকে নাই মামার চেয়ে কানা মামার অবস্থায় রেখেছেন।
তবে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, এই চাকরির লোভে অনেক উচ্চবিত্ত পরিবারের মেধাবীরাই ফেঁসে গেছে, যারা নিরবিচ্ছিন্নভাবে পড়াশুনা চালিয়ে গেলেও কোন সংকটের সম্মুখীন হতনা, তবে এদের সংখ্যা অনেকটা নয়। আর কিছু মধ্যবিত্তের মেধাবী ছাত্ররা জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে হয়তো অনেকটা সক্ষম হতো, কিন্তু চাকরির কমফোর্ট জোনে এই মেধাগুলোও থমকে গেছে। তবে এই টেটের চাকরি একটা বিরাট সংখ্যক পরিবারে স্ট্যাবিলিটি দিতে সক্ষম হয়েছে, যার ফলস্বরূপ এই পরিবারগুলো তাদের নতুন প্রজন্মকে টেটের গণ্ডির বাইরে গিয়ে অন্য চিন্তায় পরিচালিত করতে সক্ষম হচ্ছে যার অনেক বাস্তব উদাহরণ সমাজে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
উপরোক্ত এই বিস্তারিত আলোচনা থেকে নবপ্রজন্মের যারা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া, যারা টেট নিয়ে দন্দ্বে আছেন তারা সমাজের অনেকটা বাস্তব পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন বলে আশা করা যায়। তাই আজ জনগণকে অত্যন্ত সচেতন হয়ে এগোতে হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেহেতু সবকিছু পালটে যাচ্ছে, প্রতিযোগিতা বাড়ছে, কর্মসংস্থান কমছে, তাই এই জীবনযুদ্ধে অন্তত বরাকের পড়ুয়াদের অলরাউন্ডার হওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নেই। টেটকে তুচ্ছ ভেবে এড়িয়ে গেলে আফসোস করার পরিস্থিতি এসে যেতে পারে, কারণ ২০১২ ও ২০১৪ তে উচ্চশিক্ষায় একাগ্রতা নিয়ে থাকা একাংশ পড়ুয়ারা বর্তমান প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছেন। আর টেটকে চরম প্রাধান্য দিয়ে উচ্চশিক্ষায় অনীহা আনলে জীবনে চরম বিপদ ধেয়ে আসতে পারে। কারণ বর্তমান সময়ে টেট পাশ করলেই চাকরির কোনও নিশ্চয়তা নেই এবং অদূর ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষিতদের দোয়ারে অনেক ভালো কিছু কড়া নাড়ার অনেক সম্ভাবনা রয়েছে।
তাই কেতাবি পড়াশুনার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিজন পড়ুয়াদের প্রতিটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসা দরকার। শুধু টেট নয়, নিজেদের প্রতিভার সঠিক আকার দেওয়ার জন্য সবরকমের কেন্দ্রীয় ও রাজ্যিক স্তরের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসার লক্ষ্যে সব সময় নিজেদেরকে প্রস্তুত করে তোলা দরকার, স্যোসাল মিডিয়ায় একটু কম সময় কাটিয়ে পড়াশুনায় সময় বেশি ব্যয় করলে লাভবান হওয়া যাবে। টার্গেট বা ইচ্ছা বড় রাখা উচিত, টেট থেকে পরীক্ষা শুরু করলেও এপিএসসি ও ইউপিএসসসির স্বপ্ন দেখা দরকার যুব সমাজের। উভয় দিক বজায় রাখতে পরিশ্রম ও কষ্ট বেশি করতে হবে তা স্বাভাবিক, তবে এই জটিল জীবনে এটাই সফলতার একমাত্র সূত্র। সামান্য কিছু পাওয়ার আত্মতুষ্টিতে না ভোগে জীবনে নিজেকে ব্যস্ত রেখে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করাই বাঞ্ছনীয়।বলা যায়, চলমান প্রক্রিয়ায় সূর্যকে হারানোর ভয় থাকেনা, তবে স্তব্ধ হয়ে গেলে অন্ধকার আক্রমণ করে বসে।
Comments are closed.