সদরঘাট সেতু নির্মাণ: বরাক নদীর হাজার ঢেউ প্রতিহত করে স্থির দাঁড়িয়ে আছে
বরাক নদীর উপরে নতুন সদরঘাট সেতুর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হলো শনিবার সকালে। শিলচরের সাংসদ সুস্মিতা দেব এবং আরো অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালের উপস্থিতিতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের গরিমা বৃদ্ধি পেল।
স্থাপত্যের দিক দিয়ে তো বিশাল বটেই, শোভার দিক দিয়েও সেতুটি মন কাড়ার মতো। বিশেষভাবে নীল আলো নিয়ে রাতে সেতুটি অপূর্ব সুন্দর দেখায়। এই যে হাজার ঢেউকে প্রতিহত করে সেতুটি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তা সম্ভব হয়েছে হাজার শ্রমিকের কঠোর পরিশ্রম এবং দুর্দান্ত প্রকৌশলের জন্য।
২০১৪ সালে সরকারের আমন্ত্রণে টেন্ডার জমা দিয়ে নির্মাণ সংস্থা ডিটুএস মোট ৬৭ কোটি টাকার সেতু নির্মাণের প্রকল্পটি হাতে পেয়েছিল। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে জমি সংক্রান্ত সমস্যা, অনেক বছর ধরে এখানে বসবাসকারী জনগণের বাসস্থানের সমস্যা সহ আরো বিভিন্ন জটিল সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে এই নির্মাণ সংস্থাকে। এখানে বসবাসকারী অনেক বাসিন্দারা শুধু কোর্ট পর্যন্তই পৌঁছাননি, আদালতে এব্যাপারে মামলাও দায়ের করেন। তাই কার্যত সেতুর কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে, জানালেন ‘ডিটুএস’র চিফ ইঞ্জিনিয়ার যোগিন্দর সিং।
তবে জমি সংক্রান্ত বিষয় কিংবা আইনি সমস্যাই শুধু ইঞ্জিনিয়ার এবং শ্রমিকদের কাজের পথে একমাত্র চ্যালেঞ্জ ছিল না। পুরো গ্রীষ্ম জুড়ে বিশেষ ভাবে বর্ষাকালে বরাক নদীর জল বিপদ সূচক চিহ্নের উপরে প্রবাহিত হচ্ছিল। প্রচন্ড বৃষ্টির জন্য আমাদের ‘ক্রেন’ পর্যন্ত ভেসে চলে যায়। তবু আশ্চর্য হবেন যে এতসব কষ্টের পরেও নির্দিষ্ট সময়সীমার পূর্বেই অর্থাৎ একমাস আগেই আমরা সেতুর কাজটি শেষ করতে পেরেছি,তিনি যোগ করেন।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে সময়সীমার মধ্যে সেতু নির্মাণের কাজ শেষ করতে পারলেও সেতুটির সঠিকভাবে টিকে থাকার আয়ু কতটা হবে? ডিটুএস ইনফ্রাস্ট্রাকচারের ইঞ্জিনিয়ারের বিশ্বাস, তারা খুবই ভালো ভাবে কাজ সম্পন্ন করেছেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা যেভাবে কাজ করেছি তাতে আগামী ১০০ বছর সেতুটির কোন সমস্যা হওয়া উচিত নয়, বরং খুব ভালোভাবে চলা উচিত। যদিও প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা রাস্তাটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ওভারলোডের কথা মাথায় রেখে এক্ষেত্রে সত্তর বৎসর বলাটা শ্রেয় হবে বলা যায়, জানালেন সিং। তিনি সেই সঙ্গে দ্রুত যোগ করেন, এক্ষেত্রে আমি অবশ্যই বলব, সেতুর ভালোভাবে নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে এর বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সিং এ ক্ষেত্রে পুরনো সেতুর উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেতুটি বর্তমানে দুরবস্থার শিকার। সঙ্গে তিনি এও বলেন, একটি পুরনো নকশা অনুসরণ করে এটি নির্মিত হয়েছিল। তিনি আরও যোগ করেন, আমি শুনেছি যে সেতুটি নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হবে।যাতে করে এটিকে ঠিকভাবে পুনর্নবীকরণ করা যেতে পারে।
সেতুটির নির্মাণ প্রকল্পটি পরিচালনাকারী কোম্পানি ডিটুএস ইনফ্রাস্ট্রাকচারের চেয়ারম্যান ডি ডি শর্মা তার এক্ষেত্রে নিজস্ব পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে বলেন, একটি কনক্রিট সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ খুবই গুরুতর সমস্যা। মানুষ মনে করে যে প্রতিটি নির্মাণ স্থায়ী হয়। যদিও এটি একটি অত্যন্ত প্রকৌশলগত ব্যাপার, তাই যার উপর নির্মাণের আয়ু নির্ভর করছে, তা হচ্ছে “কনসেপ্ট অ্যাণ্ড কোডস”।
চেয়ারম্যান আশ্বস্ত করেন, আমরা যে কোন ধারণাসঙ্গত ত্রুটি এড়াতে সব ধরনের সম্ভাব্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। এই সেতুটি অত্যাধুনিক আইআরসি ১১২ (ইন্ডিয়ান রোড কংগ্রেস) এর উপর নির্মিত হয়েছে। আমরা নিশ্চিত যে এই সেতুটি ঠিক মতো কাজ করে যাবে এবং কোন সমস্যা হবে না। ওভারলোডিং বা বিশাল ভূমিকম্প কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে অনেক সময় কিছু সমস্যা দেখা দেয়, যা সম্পূর্ণভাবে অপ্রত্যাশিত।
নির্মাণের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভাবে যত্ন নেওয়ার জন্য দলটির তিন স্তরের পরামর্শদাতা ছিলেন বলে তিনি জানান। তিনি আরো বলেন, এটি জনসাধারনের টাকা। আমরা ব্যাপারটাকে হাল্কা ভাবে গ্রহণ করতে পারিনা। পুরনো সদরঘাট সেতুটি এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ। এটি ইতিমধ্যেই দুরবস্থার শিকার। আমি বলছি না যে এর কাজ গুণগত মান বজায় না রেখে করা হয়েছে, কিন্তু সেখানে কনসেপ্টে ত্রুটি ছিল। বরাকের মতো একটি নদীর উপর সেতু নির্মাণ মোটেই তামাশা নয়।
সিং কথোপকথনের শেষ পর্যায়ে বলেন, যে সব ঘটনা আমি আগে উল্লেখ করেছি তা দেশের যে কোন জায়গায় হতে পারে। উপত্যকার লোকেরা খুবই সহযোগী এবং আমাদের এই অঞ্চলে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল খুবই ভালো।
এখানে উল্লেখ্য যে, রাজর্ষি সিনহার কারণেই বরাক বুলেটিনের পক্ষে ডিটুএস ইনফ্রাস্ট্রাকচারের সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে সদরঘাট সেতু নিয়ে এই স্টোরিটি করা সম্ভব হয়েছে।
Comments are closed.