"হাজারো স্মৃতি বহন করা শিলচর এখনো আমার প্রাণের শহর", বলছেন 'পরবাসী' অরিন্দম, অভিজিৎ, কমলিকা
“হাজারো স্মৃতি বহন করা শিলচর এখনো আমার প্রাণের শহর”, বলছেন ‘পরবাসী’ অরিন্দম, অভিজিৎ, কমলিকা
শিলচর। চার অক্ষরে সমৃদ্ধ। একটি শহরের নাম। কিন্তু আমাদের কাছে শিলচর শুধু নিছক একটি শহর নয়। এক আকাশ ভালোবাসা। এক বুক অভিমান। গর্বে মাথা উঁচু হয়ে যাওয়া। যারা শিলচরে থাকেন তাদের জন্য এটি ‘আমার শহর’। কিন্তু যারা শহর থেকে অনেক দূরে প্রবাসে থাকেন তাদের হৃদয়ের অনেকটা জুড়ে এই শহর শিলচর। আসলে কর্মসূত্রে কিংবা আরও বিভিন্ন কারণে প্রবাসে থাকলেও জড়টাতো রয়ে গেছে শিলচরেই।শহরটা আজও অস্তিত্বের অনেকটা জুড়ে আছে।
সেই পুরোনো দিনের গল্প, শহর ঘিরে অফুরান স্মৃতি, সুখে দুঃখের অফুরন্ত কথা যাতে করে ভাষা খুঁজে পায়, তাই যারা শহর থেকে দূরে অন্য শহরে কিংবা অন্য দেশে থাকেন তাদের কথা ভেবেই আমাদের এই নতুন কলাম। এখানে নির্বাচিত ব্যক্তিদের পাশাপাশি অন্যান্যরাও অংশগ্রহণ করতে পারবেন। তাদের স্মৃতি, শহর ঘিরে অনুভূতি, ভালোলাগা, হারিয়ে যাওয়া কথা আমাদেরকে মেইলের মাধ্যমে লিখে পাঠাতে পারেন।
অরিন্দম ধর
আইটি প্রফেশনাল
সৌদি আরব
“বাবা,আমার শিলচরই ভালো লাগে, ওখানেই কি আমরা পুরোপুরি থাকতে পারিনা?” আমার নয় বছরের মেয়ে আদ্রিতির মুখে এই কথা শুনে আমি সত্যিই আশ্চর্য্য হয়ে যাই| বিগত ১৮ বছর থেকে উচ্চ শিক্ষা এবং চাকরির জন্য আমাকে ভারতের প্রায় সবকটি মেট্রো শহরেই থাকতে হয়েছে এবং মেয়ের জন্মও মুম্বাইতে | তাই ভাবতেই পারিনি যে আমার প্রাণের শহর শিলচর কে যে আমার মেয়েও ভালোবেসে ফেলতে পারে | কি আছে পাহাড়ে ঘেরা এই শিলচরে? সেটা ভাবতেই আমি চলে যাই পেছনে ফেলে আসা সেই প্রাণবন্ত পুরোনো দিনগুলোতে |
আমি যে এই শহরকে আজও এতো ভালোবাসি তার কারণ কিন্তু জুড়ে আছে ছোটবেলায় ফেলে আসা আমার অনেকগুলো টুকরো টুকরো পুরোনো স্মৃতি |
সে চৈত্র মাসের রৌদ্রেই হোক কিংবা প্রবল বৃষ্টিতে কাদা মাখা শরীরেই হোক, ফুটবল বা ক্রিকেট খেলে এরপর পাড়ার সবচেয়ে বড়ো পুকুরে ঘন্টার পর ঘন্টা সাঁতার কাঁটার আনন্দই যে ছিল আলাদা |আমাদের পড়াশুনা করতে হতো কিন্তু অনেক কষ্টে | প্রায়ই রাতে লোড শেডিং এর ঝামেলা থাকতো, তবুও ল্যান্টার্ন নিয়ে গরমে আর মশার কামড় খেয়েও আমরা পড়াশুনা চালিয়ে যেতাম | আমার পড়ায় বাধা পড়তো তখনি যখন কোনোদিন রাতের বেলা বৃষ্টি হতো আর চালের উপর বৃষ্টির ফোটা পরে যখন এক সুমধুর আওয়াজ করতো, যতই পরীক্ষার টেনশন থাকুক না কেন, বই গুটিয়ে চট করে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়তাম| খেলোধুলোতেও কিন্তু আমরা কম যাইনি| খেলার জন্য নানান মাঠ ঘুরে বেড়ানো সে গ্রেভ এর মাঠই হোক , কিংবা টিভি সেন্টার এর নতুবা মালিনী বিল এর মাঠই হোক না কেন| যেদিন ক্রিকেট এর ম্যাচ থাকতো, ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়ার টেবিল এ বসে কি আর পড়ায় মন বসে? কাগজ কলম নিয়ে বসে পড়তাম সঠিক টীম আর ম্যাচ স্ট্রাটেজি বানাতে |
শিলচর কিন্তু সবচেয়ে বেশি জীবন্ত হয়ে উঠে দূর্গা পূজার সময়| আর সেটা শুরু হয়ে যায় মহালয়ার দিন থেকেই| ঝাঁকে ঝাঁকে ছেলেমেয়েরা ভোরবেলা উঠে মহালয়ার আগমনী গান রেডিও তে শুনতে শুনতেই চলতে থাকে সদরঘাট ব্রিজ এর উদ্দেশে, কারণটা কি, যদিও সেটা আজ অবধি আমি জানতে পারলাম না| এরপর তো শুরু হলো দূর্গা পুজোর তোড়জোড় | ছোটবেলায় পায়ে হেঁটে বন্ধুদের সঙ্গে পুরো শহরের পুজো ঘুরে দেখা, বাবার দেওয়া ১০ টাকায় সেণ্ডঅফ রেস্টুরেন্টে বসে চিকেন কাটলেট বা মোঘলাই পরঠা খাওয়া কিংবা পাড়ার পুজোতে ঢাক বাজানো, সে অনুভূতিই ছিল অন্য রকমের| সবচেয়ে বেশি জাঁকজমক হতো দশমীর বিসর্জন| ট্রাকে থাকতেন দূর্গা প্রতিমা আর পেছনে নানান বাদ্য যন্ত্রের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে নেচে নেচে চলা যুবক যুবতীরা| বিসর্জন সেরে এসেই আবার পাড়ার পুজোয় বসে শান্তির জল আর অপরাজিতা হাতে বাঁধার সঙ্গে মিলতো সুস্বাদু মিষ্টির প্যাকেট |
যদিও বলে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বন| তাই সরস্বতী পুজো, গনেশ পুজো কিংবা বিশ্বকর্মা পুজো সবকিছুতেই নানান রকমের আনন্দ উপভোগ করতাম| তবে আরো একটা পুজো যেটা আমার ছিল সবচেয়ে বেশি প্রিয় সেটি হলো লক্ষ্মী পুজো, আরো সহজ ভাষায় বললে বলা যায়,অবাধে চুরি করার ছুটের রাত| এই রাতে চুরি করতে গিয়ে চোর ধরা পড়লেও ঘরের মালিক কিন্তু বিশেষ কিছু বকুনি দিতে পারবেন না বা কোনো অ্যাকশন নিতে পারবেন না| তবে সেই চুরি গুলো ছিল নেহাতই ছোট রকমের মানে ঘরের বাইরে রাখা ফল প্রসাদী নেওয়া এসব | আমাদের টার্গেটেই থাকতো কিছু ঘর যাদের ছিল অনেক রকমের ফল গাছ যেমন নারকেল, সুপারি বা আঁখ | কতবার যে ধরা পড়তে গিয়ে বেঁচেছি বেড়া ডিঙিয়ে বা নালায় পরে তার ইয়ত্তা নেই |
আরেকটা জিনিস যেটা আমার ছোটবেলায় খুবই প্রভাব ফেলেছিলো সেটি হলো বন্যা| যেখানে আমাদের দেশের বেশিরভাগ শহরই জলের অভাবে ভুগছে, সেখানে এই ছোট শহর শিলচর পরিবেষ্টিত হয়ে আছে অনেকগুলো নদী দিয়ে এবং বর্ষাকালে সেই নদীগুলোর ভয়াবহতা শিলচরবাসীকে খুবই কষ্টে ফেলে দেয় | বন্যার জল আমাদের ঘরেও চলে আসতো আর আমাদেরকে তাই আশ্রয় নিতে হতো পাড়াতেই কারো উঁচু বাড়িতে | শুধু যে আমরাই আশ্রয় নিতাম তাই না, আমাদের মতো অনেকেই থাকতে আসতো এই দুর্ভোগের সময়। আর তাই সবাই মিলে স্ফূর্তি করে ঠিক একটা পিকনিক করার মতোই হয়ে যেত ব্যাপারটা | একসঙ্গে সবার রান্না করা, খাওয়া, ভিসিআর এ সিনেমা দেখা ইত্যাদি তো ছিলই, তাছাড়া স্নানের জন্য সেই বন্যার জলেই সাঁতার কাটা এবং চলাফেরার জন্য অনেকগুলো বাঁশ দিয়ে বাঁধানো ‘বুরা’ নিয়ে বেরিয়ে পড়া | যদিও বন্যা সবার জন্য একটা বড়ো রকমের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আসতো কিন্তু আমাদের ছোটদের জন্য সেটাই এক আনন্দের ব্যাপার হয়ে যেত |
সবই বলা হলো কিন্তু শিলচর এর সবচেয়ে অনন্য একটি পর্বের উল্লেখ না করলেই যে না হয় | মেরামেরি, হাঁ মেরামেরি হয় পৌষ সংক্রান্তির রাতে যেটা পুরো ভারতবর্ষে বিভিন্ন নামে সবাই পালন করে, যেমন অসমীয়াদের জন্য বিহু এবং পাঞ্জাবিদের জন্য সেটাই লহরী | শিলচরে তাই মেরামেরির নামে খড়কুটো দিয়ে একটি ঘর বানানো হয় এবং রাতে সেখানে সব ছোটোবড়রা মিলে গান বাজনা আমোদ প্রমোদ ছাড়াও সঙ্গে চলতে থাকে বিভিন্ন রকমের খাওয়া দাওয়া | সকালে উঠে আবার স্নান সেরে ওই ঘরটাকেই আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়াও ছিল মেরামেরিরই একটি অংশ |
আমি চাকরি করছি একটা বেসরকারি সফটওয়্যার কোম্পানি তে, তাই কর্মসূত্রে আমাকে ইউরোপ বা আরবের কয়েকটি দেশে ঘুরে বেড়াতে হয়| কিন্তু কি বলবো, যেহেতু ওসব দেশে আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ এর অনেক মানুষই আছে, তাই ভাষার টানে আমি ওদের সঙ্গে সিলেটি বলা শুরু করে দেই | সে যে কি আনন্দ তা ভাষায় লিখে প্রকাশ করা যাবে না | ইদানিং সৌদি আরবে আমার আশেপাশে ওপার বাংলার এতো মানুষ দেখে কখনো কখনো মনে করি যে আমি হয়তো শিলচরেই বসে আছি |
রোজই স্বপ্ন দেখি শিলচর ফিরে আসার। আর এই আশাই হয়তো আমাকে রোজ ইন্ধন যোগাচ্ছে বাঁচার | কিন্তু পারবো কি নিজেকে মানিয়ে নিতে এখন এই শহরে ? মনে খুবই ব্যথা পাই যখন প্রতিদিন শিলচর এর সংবাদপত্র গুলোতে পড়ি শহরের ক্রমশঃ বেড়ে উঠা অরাজকতা, অপ্রীতিকর ঘটনা আর তার সঙ্গে বেড়ে ওঠা নানান অপহরণ জড়িত ঘটনা | এই কি সেই ফেলে আসা আমার সেই আদরের শহর শিলচর !!!
অভিজিৎ চক্রবর্তী
প্রোডাকশন লিডার,জাগুয়ার ল্যান্ডরোভার কারস লিভারপুল
যুক্তরাজ্য
শিলচর শহর আমার জন্মস্থান। জন্মগ্রহণ এবং এরপর সেখানে আমার বড় হয়ে ওঠা। আর এরই ফাঁকে হাজার স্মৃতি বহন করে শিলচর আজও আমার প্রাণের শহর। আজ এই লেখাটা লিখতে গিয়ে মনের মধ্যে হাজার ঘটনার আনাগোনা, হাজার স্মৃতির ভিড়।শৈশবের স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠতেই প্রথমে বন্ধুদের সাথে অফুরন্ত খেলার কথা মনে পড়ে গেল। তাছাড়া সন্ধ্যায় অন্নপূর্ণা বা রাধামাধব মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে আড্ডার কথা কি আর ভোলা যায়? আসলে দীর্ঘ দিন বিদেশ থাকা সত্ত্বেও এখনও শিলচর আমার অনেকটা জুড়ে আছে। তবে শিলচরকে সবচাইতে বেশি মিস করি প্রতি বছর দুর্গাপূজার সময়। চাঁদমারীর পূজার সাথে পুরোপুরি জড়িত ছিলাম,চুটিয়ে দুর্গাপূজা উপভোগ করতে পারতাম। গত ২০ বছর ধরে যুক্তরাজ্যের বাসিন্দা। তাই অনেক পারিবারিক বিয়ে মিস করি।অথচ ছোটবেলায় কত বিয়েতে চুটিয়ে মজা করেছি। ছুটির দিনগুলিতে ইউরোপের অনেক জায়গায় ঘুরছি, অনেক কিছু দেখছি, কিন্তু আশ্চর্য হলেও এগুলো শিলচরের কাছে ম্লান হয়ে যায়। তাই শিলচর ঘুরতে যাওয়ার সময় সবচেয়ে বেশি উৎসাহিত থাকি। এমন কি শিলচরের কথা ভেবেও উত্তেজিত বোধ করি। কারণ শিলচরকে আমি আগের মতোই ভালোবাসি। তাই শিলচরের সঙ্গেও যোগাযোগ রয়েছে আর আমার সব শৈশব বন্ধুদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতে পেরে আমি আনন্দিত।
কমলিকা রায়
গৃহিণী
কলকাতা
আজ আমার সারা মন জুড়ে শিলচর। কারণ আজ আমার দেখা ছাব্বিশ বছর আগের শিলচর কে নিয়ে লিখতে বসেছি। এখন শুনেছি অনেক পাল্টে গেছে। সেটা আমার আর দেখা হয়নি, কারণটা আমার বাপের বাড়িও কলকাতায় চলে এসেছে, তাই আর শিলচর যাওয়া হয়ে উঠেনি।
শিলচরের কথা মনে হলেই সবার প্রথম মনে পড়ে, যেখানে থাকতাম সেখানকার কথা তারপর আমার স্কুলের কথা , স্কুলের বন্ধুদের কথা , পাড়ার বন্ধুদের কথা। তারপর বড় হওয়ার পর কলেজের কথা, সেখানকার বন্ধুদের কথা। আত্মীয় স্বজন, চেনাপরিচিত নানান লোকের কথা মনে পড়ে। চোখের সামনে ভেসে উঠে ওদের মুখ।
এসব নানান কথা মনে হলে অনেক সময় আনন্দে মন ভরে উঠে, আবার কখনও কখনও চোখে জল চলে আসে। আমার কত হাসি, কত আনন্দ কত কান্না ছড়িয়ে আছে শিলচরের মাটিতে। সেসব ভাবলেই নস্ট্যালজিক হয়ে পড়ি। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যায়।
আমাদের ছোটবেলায় আজকের মতো খুব বেশি আনন্দ উৎসব তো ছিল না, কিন্তু যতটুকুই পেতাম মন খুলে আনন্দ করে নিতাম। বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম উৎসব পালিত হতো , তার সব কটাতেই প্রায় যোগদান করতাম যদি না কোন অসুবিধা থাকতো। তবে বিশেষভাবে মন ভরে যেতো শীতকালে গান্ধীমেলা আর সার্কাস এলে। প্রায় রোজদিন গান্ধীমেলায় যাওয়া হতো, তবুও যেন মন ভরতো না , সার্কাসেও প্রায় সেই অবস্থাই হতো, যার সাথে পারতাম রওনা দিতাম, আজ ভাবলে ভীষণ হাসি পায়। অবশ্য তখন এইরকম কিছু পাগলামো করেছিলাম বলেই আজও এগুলো আনন্দ দিচ্ছে, মনে পড়লে ভালো লাগে।
শিলচর নিয়ে অনেক স্মৃতি আমার জীবন জুড়ে আছে, তাকে বাদ দেবো কি করে? শিলচরের পরিবেশ আমাকে বড় করে তুলেছে, আজ যতটুকুই পরিণত হয়েছি সেটা শিলচরেরই অবদান, সত্যি বলতে কি শিলচর আমার মায়ের মতো। তাই খারাপ ভাল সব কিছু নিয়েই আমার শিলচর , “আমার জন্মভূমি”।
Comments are closed.