Also read in

"ওরা কাপড় ধুয়ে দিতে বলতো, কাজ না করলে মারতো, খাবার কেড়ে নিত": ডিটেনশন সেন্টারের ভেতর অকথ্য যন্ত্রণার শিকার হাফলংয়ের অসুস্থ নুরুল নেসা

তিনবছর আগে হাফলং থেকে বাংলাদেশি সন্দেহে আটক করা হয়েছিল অসুস্থ নুরুল নেসাকে। প্রথমে কোকরাঝাড় এবং শেষে শিলচর সেন্ট্রাল জেলের ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকতে হয় তাকে। বাবার বাড়ি কাছাড়ের মাসিমপুর এলাকায়। কাজের জন্য স্বামীর সঙ্গে হাফলং পাড়ি দিয়েছিলেন। এখন তার মা-বাবা এবং স্বামী, কেউ জীবিত নন। তিন বছর ডিটেনশন ক্যাম্পে কাটিয়ে বুধবার মুক্ত হয়েছেন তিনি। খোলা আকাশের নিচে বেরিয়ে এসেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি, তুলে ধরেন জেলে থাকাকালীন তার ওপর অকথ্য অত্যাচারের কাহিনী।

স্নায়ু জনিত রোগে ভুগছেন তাই স্পষ্ট করে কথা বলতে পারছিলেন না। তবে বারবার করে বলছিলেন, ওরা আমাকে মেরেছে, অন্যদের কাপড় ধুয়ে দিতে বাধ্য করেছে, কাজ না করলে খাবার কেড়ে নিয়েছে, এমনকি প্রয়োজনীয় ঔষধটুকু আমার জোটেনি। তার কথায় যেটুকু বোঝা গেছে, সেটা হচ্ছে, প্রায় তিনবছর চারমাস জেল খেটেছেন তিনি। জেলের ভিতর কিছু নিজস্ব নিয়ম থাকে, অবশ্যই সরকারি নিয়মের কথা তিনি বলছেন না। জেলের অন্যান্য বন্দীদের অনেকেই বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে এসেছেন। এদের মধ্যে হয়তো কেউ সর্দার রয়েছেন। সেই সর্দার গোছের কেউ একজন নিয়ম করে দিলেন, নুরুল নেসাকে তাদের কাপড়-চোপড় ধুয়ে দিতে হবে। স্নায়ু রোগে ভুগতে থাকা নুরুল নেসা কাতর আর্জি জানালেন তিনি এই শরীর নিয়ে হয়তো কাজটা করতে পারবেন না। ফলে তার উপর শুরু হলো শারীরিক যন্ত্রণা। কোন একটা সময় জেলের ভিতর তার বাঁ হাতে গভীর চোট পান। অথচ এর চিকিৎসা হয়নি বা পর্যাপ্ত ঔষধ তার কাছে পৌঁছানো হয়নি। নিজের স্বামী সহ দুই সন্তানকে তিনি আগেই হারিয়েছেন। মনের দিক দিয়ে এখন আর লড়াই করার মতো কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ধীরে ধীরে বেঁচে থাকার ইচ্ছাটুকু হারিয়ে ফেলেছেন। তবুও মানুষের শরীর, শরীরে আঘাত লাগলে ব্যথা তো হয়। ফলে প্রচন্ড শারীরিক নির্যাতন সহ্য করেও জেলের ভিতর নিয়ম গুলো পালন করেছেন।

লকডাউন শুরু হওয়ার পরে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে একের পর এক মানুষ ছাড়া পাচ্ছেন। তখন মনে কিছুটা আশা জেগেছিল হয়তো এই যন্ত্রণা থেকে তিনি মুক্তি পাবেন। প্রথম দফায় হাফলংয়ের ১৪ জনকে মুক্তি দেওয়া হল। কিন্তু তার মুক্তির আশাটুকু আর গড়ে ওঠেনি। গ্রেফতার হওয়ার আগে তার বোনের বাড়িতে থাকতেন। তারা প্রত্যেকেই দিনমজুর। বিভিন্ন সময় সরকারি প্রকল্পের রাস্তার কাজে সবাই মিলে দিনভর খাটতেন। সেখান থেকে যেটা জুটত সেটা দিয়েই ঘর চালানো। এবার জামিনের টাকা কে দেবে? এতটুকু টাকা তো জমানোর নেই? তবু চেষ্টা করলেন, তার দিদি ও দিদির মেয়ে মিলে টাকা জোগাড় করলেন। এক্ষেত্রে পুলিশের কিছুটা ভূমিকা রয়েছে। তারা সহজে জামিনদার পাইয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করতে থাকলেন। শেষমেষ বুধবার তার মুক্তি হলো। জেল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার আগে কাঁদতে কাঁদতে শুধু এটুকুই বললেন, আমার মত আর কোন মহিলা যেন এই ভাবে জেলের ভেতর নির্যাতনের শিকার না হয়। এর থেকে হয়তো মরে যাওয়া অনেক সহজ।

নুরুল নেসা সহ মোট তিনজনকে বুধবার শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। তিনজনেই হাফলঙ ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের বিচারে বিদেশি ঘোষিত। বাকি দুইজন হলেন সাধন মালাকার এবং সুনীল রায়। সাধন মালাকারের পুরনো বাড়ি কাছাড় জেলার জালালপুরে। পারিবারিক কলহের জেরে বাড়ি ছাড়া এবং তারপর স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে হাফলং থাকতেন। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেননি। একদিন হঠাৎ ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে ডি নোটিশ আসে। একে তো গরিব, তারপর সঙ্গে কোন কাগজপত্র নেই। ফলে আইনজীবীও তার সহায়তা করতে পারেননি। শেষে একজন গ্রেফতার হলেন এবং হাফলং ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হল। ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পে আছেন, প্রায় চার বছর কাটিয়ে বুধবার মুক্তি পেলেন।

সুনীল রায়ের আসল বাড়ি বড়খলার কালিনগর এলাকায়। বাবার নামের পদবী নমঃশূদ্র ছিল। তারা পরবর্তীতে সেটা পাল্টে রায় লেখালেন। আর এখানেই আটকে গেলেন তিনি। ট্রাইবুনাল তার নথি গ্রহণ করল না এবং ডি ভোটার ঘোষণা করে শিলচর পাঠিয়ে দিল। শশুর বাড়ি বদরপুরে। স্ত্রী এবং শ্বশুর মিলে অনেক চেষ্টার পর তাকে জামিনদার পাইয়ে দিতে সমর্থ হন।

হাফলংয়ের আরও কিছু লোক শিলচরের ডিটেনশন সেন্টারে রয়েছেন। আগামীতে তাদের মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

Comments are closed.