কোন এক ঝড়ের তাণ্ডবে রাজর্ষির আশ্রয়হীন হয়ে ওঠার গল্প লিখেছেন প্রাঞ্জল পাল 'আশ্রয়'
আশ্রয়
ঘড়িতে তখন পৌনে একটা, এখন প্রায় প্রতিদিনই এমনটা হয়। বর্ষাকাল, তাই বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। তার মধ্যে দোতলার জানালা দিয়ে রাস্তার লাইট পোষ্টের আলোয় দেখা যাচ্ছে বাড়ির ডান পাশে থাকা ছাতিম গাছটা । রাজর্ষির ছোটবেলাকার যাপিতক্ষণের একমাত্র সঙ্গী এই গাছটা। আজও মনে পড়ে সেই দিনগুলির কথা ! যখন তারা এই শহরে সবেমাত্র এসেছে ! রাজর্ষির বাবার ট্রান্সফারেবোল্ জব। চাকরি সূত্রেই প্রথমে এ শহরে আসা , তখন রাজর্ষির বয়স পাঁচ – ছয় হবে আরকি । কয়েক বছর ভাড়া বাড়িতে থাকতে থাকতে সেই বাড়িটাকেই কিনে নিলো ওরা । নতুন শহরে ছোট্ট রাজর্ষির খেলার সাথী ওই ছাতিম গাছটাই । গাছটার চারপাশে ঘুরেঘুরে মুখ দিয়ে নানা রকম শব্দ বের করে খেলেই তার দিনগুলো বেশ আনন্দে কাটতো । অবসর সময় এই গাছটার নীচই ছিল তার বিশ্রাম ও বিনোদনের অন্যতম ঠিকানা । গাছটাই তার একমাত্র অন্তরঙ্গ সহচর , সখা !
এসব ভাবতে ভাবতে রাজর্ষির চোখের কোণে জল চলে আসে ! প্রায় বছর খানেক ধরে গাছটা হঠাৎ অন্ত:সার শূন্য হয়ে যাচ্ছে । প্রথমে গাছটার পাতা গুলো ঝরা আরম্ভ করল , তারপর আস্তে আস্তে পুরো গাছটাই কেমন যেনো শুকিয়ে গেলো । এখন কেবল কোনো এক অযাচিত ঝড়ে ভেঙে পড়ার অপেক্ষা ! এতোক্ষণে রাজর্ষির ভেজা চোখের জল কান্নায় পরিণত হল। আসলে যন্ত্রণাটা আরো গভীরে ! বেশ কদিন হলো তার খাওয়া – ঘুম সব কিছুই আর স্বাভাবিক ছন্দে নেই । কেবল সংসারের দায়ে সময় মতো চাকরিতে যাওয়া , আবার সারা দিনের হাড়ভাঙা খাটনি শেষে কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফিরে আসা । প্রতিদিনের গড্ডলিকা স্রোতে চলা জীবনে তার মনটা যেমন অস্থির হয়ে থাকে, তেমনি প্রতিদিনের যাপন তাকে বিমুখ করে রেখেছে সবকিছু থেকেই !
রাত এখন আরও গভীর , স্ত্রী অনন্যা বেশ উত্তেজিত কণ্ঠে হাঁক দিলো , “এই শুনছো মায়ের শ্বাসকষ্টটা তো বেড়েই চলেছে ।” এভাবেই প্রতিটা রাত এখন কাটে ! রাজর্ষির মা ছোটো থেকেই শ্বাসকষ্টের রোগী , রাজর্ষি তাঁর কাছেই শুনেছে , তিনি নাকি সেই শিশুকাল থেকেই এই রোগটায় অনেক ভুগছেন । মাঝ বয়সে কিছুটা কম ছিল । বয়সের সায়াহ্নে এসে অসুখটা এখন চরমে ! প্রায় মাস খানেক ধরে কোনভাবেই যন্ত্রণাটা আর বশে আনা যাচ্ছে না । ছয় বছর আগে বার্ধক্যজনিত রোগে রাজর্ষির বাবা মারা যান । তখন থেকে মা-ই তার পৃথিবীতে একমাত্র কাছের মানুষ । যদিও অনন্যার অস্তিত্বটা তার জীবনে একেবারেই অল্প দিনের । মাত্র নয় মাসের দাম্পত্য তাদের । অনেক জোর করে রাজর্ষিকে বিয়েতে রাজী করিয়েছিলেন তার মা ! প্রথমে সে বিয়ে করতে চায়নি ! কারণ , পাছে মায়ের যদি কোনোভাবে অবহেলা হয় ! কিন্তু না, অনন্যাও অনেক ভালো মেয়ে , আজ অবধি অসুস্থ শাশুড়ির কোনো অবহেলা করেনি সে । রাজর্ষির সাথে প্রতি রাতে জাগা , শাশুড়ির চিকিৎসা , সেবা , স্বামীর প্রতিটা কর্তব্য ও যন্ত্রণার ভাগীদার সে !
আজ অবধি রাজর্ষির জীবনে সব থেকে বড় ধাক্কাটা ছিল তার বাবার মৃত্যু ! সমসাময়িক আর দশটা ছেলের থেকে রাজর্ষি চিরকালই একটু আলাদা বা বলা যায় মা – বাবা কে নিয়ে একটু বেশিই স্পর্শকাতর ! তাই তো তার কাছে বর্তমানের প্রতিটা রাত বিনিদ্র রজনী ! শহরে এবং যথাসম্ভব বহির্শহরে মায়ের চিকিৎসা করিয়েছে সে। কোনরকম গাফিলতি হতে দেয়নি। কিন্তু বার্ধক্যের শ্বাসকষ্ট সে আর কমবার নয় ! ডাক্তার বলেছিলেন নার্সিংহোমে রাখতে কিন্তু সে ব্যাপারে মায়ের প্রবল বিরোধিতায় চিকিৎসাটা ঘরেই করতে হচ্ছে । তিনি চান তাঁর শেষ ক’টা দিন স্বামীর ভিটে আঁকড়ে থাকতে ! রাজর্ষিও মায়ের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে ।
রাত এখন প্রায় শেষ ; ভোরের আলো ফোটার মাত্র কিছুক্ষণের অপেক্ষা। সমান্তরাল ঘরে কেবল তিনটে প্রাণের অস্তিত্ব ! মধ্যিখানে একটা সাবেকি ডিজাইনের খাট , তাতেই শায়িত রাজর্ষি জননী । তাঁর মাথার কাছে বসে আছে অনন্যা আর রাজর্ষি দাড়িয়ে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে মায়ের মুখের দিকে ; তার বুক চিড়ে যাচ্ছে মায়ের প্রতিটা শ্বাসের আওয়াজে ! ওদিকে বাইরের বৃষ্টি এখন প্রবল দাপটে ঝড়ে পরিণত ! ঠিক তখনই বাইরে থেকে শোনা যায় রাজর্ষির যাপনের অন্যতম আশ্রয়স্থল ছাতিম গাছটা এবারের ঝড়ের ধাক্কা আর সামলাতে না পেরে ভেঙে পড়ার শব্দ । এদিকে মায়ের শ্বাসের আওয়াজটাও এখন আর শোনা যাচ্ছে না ! …… এবার পুরোপুরি আশ্রয়হীন রাজর্ষি !!
লেখক প্রাঞ্জল পাল গল্প লেখার পাশাপাশি কবিতা ও প্রবন্ধ লেখেন।
Comments are closed.