শিবচতুর্দশী : পুণ্যার্থীদের ভিড় মন্দিরে মন্দিরে
পরনে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি । ঘটিতে দুধ আর জল । হাতে ফুল আর বেলপাতায় সজ্জ্বিত পুজোর থালা। শয়ে শয়ে মহিলা কিংবা মেয়েরা মন্দিরের কক্ষদ্বারে অপেক্ষারত। ভোলানাথের মাথায় দুধ দেবার আশায়। এমন দৃশ্যই শিবচতুর্দশীতে খুব স্বাভাবিক সব শিবমন্দিরে। বরাক উপত্যকায় ছোট বড় মিলিয়ে শিবমন্দিরের সংখ্যা নেহাত কম নয়।কম নয় শিবরাত্রিকে ঘিরে মানুষের বিশেষভাবে মহিলা কিংবা মেয়েদের মধ্যে উৎসাহ আর উদ্দীপনা। নিষ্ঠার সঙ্গে উপোস রেখে শিবের মাথায় জল আর বেলপাতা দিলে শিবের মত বর পাওয়া যায় এমন বিশ্বাস অনেকেই পোষেন। তাই আবিবাহিত মেয়েদের মধ্যেও উৎসাহ ভীষনভাবে পরিলক্ষিত হয়। দল বেঁধে বাড়ীর কাছের মন্দিরে গিয়ে শিবঠাকুরের মাথায় দুধ, জল আর বেলপাতা চড়াতে অনেকে পছন্দ করলেও ভূবন পাহাড়ের চুড়ায় অবস্থিত শিবমন্দির, বদরপুর ঘাটের সিদ্ধ্বেশ্বর শিববাড়ী, কিংবা শিলকুড়ির ভরম বাবার আশ্রমে শিবরাত্রিতে ভিড় সামলানো মুস্কিল।
ভূবন পাহাড়। এক সুপরিচিত ও সুপ্রসিদ্ধ নাম বরাক উপত্যকা তথা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। শিবভক্তদের জন্য মহান পুণ্যস্থান।কারন এরই চূড়ায় রয়েছে সুপ্রসিদ্ধ শিবমন্দির। পাহাড় চড়তে ভালবাসেন যারা তাদের জন্য পাহাড় চড়ার এক সূবর্ণ সুযোগ। উপলক্ষ শিবচতুর্দশী। হাজার হাজার তীর্থযাত্রীর ঢল ভূবন পাহাড়ের দুর্গম পথে। শিবরাত্রিতে এ এক সুপরিচিত ছবি। পথ যতটাই দুর্গম, শিব ভক্তদের মনোবল ততটাই দৃঢ়। হাতে লাঠি, মনে মহাদেবের প্রতি অনড় ভক্তি সাহায্য করে তীর্থযাত্রীদের তাদের আরাধ্য দেবতার কাছে পৌঁছতে।
শিলচর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভূবন পাহাড় নতুন সাজে সেজে উঠে শিবরাত্রিতে।হাজার হাজার তীর্থযাত্রী। হাতে লাঠি। মুখে শিবস্তুতি। মনে অদম্য সাহস। মনোবল দৃঢ়। এভাবেই চলে ভক্তদের চূড়ায় অবস্থিত শিবমন্দিরে পৌঁছানোর প্রয়াস। শিবচতুর্দশীতে অগুনিত সাধু সন্ন্যাসীরাও ভূবন পাহাড়ে চড়েন।
বলা হয়, আগের থেকে অনেক সুগম হয়েছে মন্দিরে পৌঁছানোর রাস্তা। আবার এমন অভিযোগও শোনা যায়, সরকারের উদাসীনতায় যতটা উন্নতি হওয়ার কথা ছিল তেমন কিছু হয়নি। অথচ প্রণামী হিসেবে লক্ষ লক্ষ টাকা জমা হয়ে থাকে এসময়। রাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত তীর্থযাত্রীরা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ছোট জায়গা মতিনগর থেকে ছোট গাড়ি করে কিংবা পায়ে হেঁটে পানিচৌকি পৌঁছান। এরপর আর গাড়ী চলাচল করে না। তাই এর পর থেকে ৭ কিলোমিটার উপরে চড়তে ভক্তদের সাথী হাতের লাঠি আর নিজের মনোবল।
মধ্যপথে সুপ্রসিদ্ধ লক্ষী গুহা মন্দিরও অবস্থিত। বলা হয়, যারা ধর্মপ্রাণ এনং একনিষ্ঠ ভক্ত তারাই এই মন্দিরে পৌঁছতে পারেন। তবে অনেকে এই ঝুঁকি না নিয়ে সোজা চূড়ায় অবস্থিত শিবমন্দিরে চলে যান।
এখানে বলা যেতে পারে, পুরো রাত পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থান করা এক অনন্য অভিজ্ঞতা। বেশীরভাগ মানুষ মধ্যরাত্রিতে গিয়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছান। পাহাড়ের চূড়া থেকে আরো অনেক মনোরম দৃশ্যের সঙ্গে মিজোরাম পাহাড়্গুলো অপূর্ব দেখায় বলে অভিজ্ঞতাকারীদের বক্তব্য। আরো জানা যায়, অনেকে যেমন খাদ্যদ্রব্য সঙ্গে নিয়ে চড়েন, তেমনি অনেকে আবার চূড়ায় পৌঁছে খাবার মানাতে পছন্দ করেন।
অভিজ্ঞতাকারীদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ‘জয় বাবা ভোলানাথ’, ‘ভম ভম ভোলানাথ’, ‘শিব শিব ভম’ বাক্যসমষ্টিগুলি একদিকে যেমন মনোবল যোগায়, তেমনি এরই মাধ্যমে উপরে চড়ার কষ্টটা ভক্তের নিষ্ঠার কাছে হার মেনে যায়। একজন জানালেন, উপরে উঠার পর এতোটাই আনন্দ হয় কিংবা ভক্তিভাব জাগ্রত হয় যে উপরে চড়ার কষ্টটা কর্পূরের মতো উবে যায়। আর একজন বললেন, “ উপরে চড়তে চড়তে খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, ভাবছি কি করে এগুবো, ঠিক তখনি এক ভদ্রলোক আমার সামনে এক কাপ চা এগিয়ে দিলেন। আমি অভিভূত হয়েছিলাম। মনে হয়েছিল এই মুহূর্তে এইটারই আমার প্রয়োজন ছিল। আর ক্লান্তি দূরও হয়েছিল। কারন এই চায়ে মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা মেশানো ছিল।” উনার কাছ থেকেই জানতে পারলাম, এরকম অনেকেই চা কিংবা অন্যকিছু বানিয়ে খাওয়ান।
উপরে মন্দিরের সম্মুখে একটি পুকুরও রয়েছে। তীর্থযাত্রীরা তাদের আরাধ্য দেবতা মহাদেবকে পুজো করার আগে পুকুরে স্নান সম্পন্ন করতেন। যদিও এখন পুকুরে নামার অনুমতি প্রদান করা হয় না।
ভূবন তীর্থ নিয়ে অনেক সময় অনেক গবেষনা হয়েছে। এক তথ্যে জানা যায়, রংমাই, লিয়াংমাই ও জেমি গোষ্ঠীভূক্ত হাজার হাজার হিন্দু নাগাদের তীর্থস্থান হচ্ছে এই ভূবন পাহাড়। দলবদ্ধভাবে শিববন্দনা করতে করতে এই তিন গোষ্ঠীর হিন্দু নাগারা বছরের একটি দিন নির্দিষ্ট করে পূজো দিতে ভূবন বাবার মন্দিরে যায়। এছাড়াও চাবাগানের জনজাতি গোষ্ঠীভূক্ত এক বৃহৎ সংখ্যক ভক্তের দল ভূবন তীর্থে আসেন পূজো দিতে। তথ্য ঘেঁটে আরো জানা যায়, বুদ্ধ ভিক্ষুরা ভগবান তথাগতের তপস্যা করতে বুদ্ধ পূর্ণিমার রাতে ভূবনের নির্জন গুহায় আসতেন।
ভূবন তীর্থের সঙ্গে কামাখ্যা মন্দিরের যোগসাজশ নিয়েও তথ্য পাওয়া যায়। কামাখ্যা তীর্থের আদলে একটি শৈবতীর্থ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। এমনকি সুরঙ্গ পথে কামাখ্যার সঙ্গে এই ভূবন তীর্থের যোগযোগ তৈরী করারও চেষ্টা করা হয়েছিল। এরই ফলস্বরূপ পরবর্তীতে ভূবন থেকে সুরঙ্গ পথে কামাখ্যা যাওয়া যায় বলে লোকমুখে কথা প্রচলিত হয়।
বলা হয়, ভূবন তীর্থের মূর্তিগুলোর মধ্যে ভারত-মঙ্গোলীয় প্রাভাব রয়েছে।প্রত্নতত্ববিদরা বলছেন, ভূবন পাহাড়ের অধিকাংশ মূর্তি সপ্তম থেকে দশম শ্তান্দীর সময়সীমার। আর এই তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে ভূবন তীর্থ গড়ে উঠার পেছনে রাজআনুকূল্য রয়েছে বলে ধারনা করা হয়। ত্রিপুরা রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা বা অবদান এক্ষেত্রে অস্বীকার করা যায় না। যদিও ত্রিপুরিরা আর্য সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত ছিল।
তবে ভক্তরা এতসব তথ্যের ধার ধারেন না। মনের ভক্তিই ওদের কাছে শেষ কথা। সব বছরের মত এবারও তীর্থযাত্রীরা প্রস্তুত ভুবন পাহাড়ে চড়ার জন্য। শিবের মাথায় দুধ আর জল ঢালার জন্য।
বদরপুরে সিদ্ধ্বেশ্বর কপিলাশ্রম মন্দিরেও শিবরাত্রি উপলক্ষে প্রচর জনসমাগম হয়। নদীর তীরে অবস্থিত অতি প্রাচীন এই মন্দিরে সারা বছর পূজার্চনা হলেও শিবরাত্রিতে যেন অন্যভাবেই সেজে উঠে। বহু দূর দূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন। মন্দিরের বাইরে বসা বিক্রেতাদের অল্পবিস্তর আয়েরও সুযোগ ঘটে শিবচতুর্দশীর দৌলতে।
শিলকূড়ির ভরম বাবায়ও শিবচতুর্দশীতে প্রচুর পরিমানে জনসমাগম হয়। উৎসাহ আর উদ্দীপনায় পালিত হয় শিবরাত্রি।
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক পরিবর্তনের সাক্ষী আমরা থাকলেও কিছু জিনিস আজও চিরাচরিত রয়েছে। ভক্তের আর ভক্তির মিলন, ভগবানের কাছে ভক্তের সমর্পন, ভগবান আর ভক্তের সম্পর্ক বিশ্বাসের সুতোয় বাঁধা। সে সুতোয় হাত রাখে কার সাধ্যি!
Comments are closed.