দ্বিতীয়বার উপাচার্য পদে থাকবেন না দিলীপ চন্দ্র নাথ, "অকারণের রাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ তাই আবেদনই করছি না," বললেন তিনি
শিলচরের এক অধ্যাপক বলেছিলেন ছাত্র আন্দোলনের মাপকাঠিতে আসাম বিশ্ববিদ্যালয় আর দিল্লির জেএনইউ প্রায় সমান জায়গায় রয়েছে। তবে পড়াশোনার নিরিখে জেএনইউ’র রেংকিংয়ের দূর-দূরান্তেও নেই বরাক উপত্যকার একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়টি। এই বছর প্রথমবার জাতীয় রেঙ্কিংয়ে দেশের সেরা ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা থেকে ছিটকে যায় আসাম বিশ্ববিদ্যালয়। এতে অভিযোগের আঙুল ওঠে উপাচার্য দিলীপ চন্দ্র নাথের উপর। তিনি পাল্টা অভিযোগ তোলেন ছাত্র আন্দোলনের দিকে। শেষমেশ এই বছর সীমিত পর্যায়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠান আয়োজন নিয়ে আরেক দফা আন্দোলন হয়। বিশ্ববিদ্যালয় সিদ্ধান্ত নেয় তিন দিনের অনুষ্ঠান করবে। তবে এর ফাঁকে অনেকেই অভিযোগ তুলতে শুরু করেছেন দ্বিতীয়বার উপাচার্য পদে থাকার জন্যই সরকারপক্ষের তোষামোদ করছেন দিলীপ চন্দ্র নাথ।
বরাক বুলেটিনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এব্যাপারে তিনি খানিকটা আবেগিক হয়ে বলেন, “আর এই পদে থাকার জন্য আবেদনই করছি না, তোষামোদ করে পদটি নেওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না।”
তিনি বলেন, “আমার বয়স এখন ৬৮ হয়ে গেছে তাই এখন কোনভাবেই আমি আরেকটা টার্ম থাকার কথা ভাবতে পারিনা। বয়স ৬৬ হলে সেটা সম্ভব ছিল, কিন্তু সেইক্ষেত্রেও আমি আবেদন করতাম না। কারণ ঘাত-প্রতিঘাত, অকারণের অভিযোগ, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রাজনীতি এসবে আমি বীতশ্রদ্ধ। এমন এমন কথা শুনতে হয় যেটা শিক্ষক হিসেবে কখনই আশা করতে পারি না। শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দায়িত্ব পালন করছি বলে চরম অপমানের মুখোমুখি হতে হয়েছে। যে দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছি সেটা পালন করার চেষ্টা চলছে, তবে কেউ কেউ পুরোটা দায় আমার উপরে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। সারা জীবন শিক্ষকতা করেছি এবং আগামীতেও সেটাই করব, তবে উপাচার্য পদের দায়িত্বে থাকার আর ইচ্ছে আমার নেই।”
কাটিগড়া বলেশ্বর গ্রামের একটি বিদ্যালয় থেকে তার পড়াশোনার জীবন শুরু হয়। অত্যন্ত দক্ষ ছাত্র হিসেবে সারা জীবন নিজেকে প্রমাণ করেছেন। গুরুচরণ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক, গুয়াহাটির কটন কলেজ থেকে স্নাতক এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাস করার পর বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন তিনি। পোস্ট-ডক্টোরেল গবেষণা করেন আমেরিকার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বরাক উপত্যকার মাটি থেকে শুরু করে আমেরিকা পর্যন্ত পৌঁছানোর ক্ষেত্রে তার পাথেয় ছিল নিজের যোগ্যতা। এরপর তিনি উপত্যকার একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে দায়িত্ব পেয়েছেন।
অবশ্যই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তিনি কিছুটা গেরুয়াপন্থী। কেউ কেউ সরাসরি অভিযোগ তোলেন তিনি অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের প্রতি নরম মনোভাব পোষণ করেন, কেননা একসময় তিনি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিভিন্ন নীতিতে তার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সমালোচকরা। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি বা রাজ্যপালকে আমন্ত্রণ না জানিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নীতিন গাডকারিকে আনার সিদ্ধান্তে উপাচার্যের দিকে আঙ্গুল উঠে। এব্যাপারে তিনি বলেন, “সাধারণ বিষয়গুলো নিয়ে বারবার অকারণে রাজনীতিকরণ করার যে ধারা তৈরি হয়েছে এতে আমি ক্লান্ত বোধ করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অতীতে অনেক অতিথি এসেছেন, এবার কেন্দ্র সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে রাজি হয়েছেন, এটা নিয়েও অনেকের অসুবিধা। আমরা চেয়েছিলাম কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ মন্ত্রী রমেশ পোখরিয়াল নিসংককে আমন্ত্রণ জানাবো। তবে এই পরিস্থিতিতে কাউকে আসতে রাজি করানো অনেক কঠিন ব্যাপার। আমাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে নীতিন গাডকারি আসতে রাজি হয়েছেন, এটা ভালো খবর। একটা জিনিস স্পষ্ট করে বুঝে নিতে হবে, সরকার যে পক্ষের থাকুক তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে চলতে হয়। আমাদের উদ্দেশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য উন্নতির পথ খুঁজে বের করা। এতে আমার ব্যক্তিগত কোনও লাভ নেই।”
শিক্ষার পরিকাঠামোগত দিক আলোচনা করলে দেখা যায় বরাক উপত্যকা এখনও দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। তবে এই উপত্যকায় দাঁড়িয়ে শিলচর এনআইটি সারা বিশ্বের সেরা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের তালিকায় আসতে সক্ষম হয়েছে। সেখানে আসাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। বিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে এর দায় বর্তায় দিলীপ চন্দ্র নাথের উপরেই। তবে একটি বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নতি-অবনতির পুরোপুরি দায় একজনের ওপর চাপানো যায় না, এটাও সত্যি। শিলচরের এনআইটি দেশের সেরা ৫০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্থান করে নেওয়ার পর ডিরেক্টর শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, “শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে রেঙ্কিং পেতে হলে ছোট থেকে ছোট জিনিস উন্নত করতে হয় এবং সেটা একা করা যায় না। প্রত্যেক শিক্ষক এবং বিদ্যার্থীর অবদান রয়েছে। এক একটা রিসার্চ পেপার মূল্যবান, এটা একটি ঘর বানানোর মত, প্রত্যেকটি ইট গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষ্ঠানের প্রধান এগুলোকে কোন জায়গায় বসানো হবে সেটা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তবে গুণগত মান পুরোটা তার ওপর নির্ভর করে না।”
আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে ছাত্ররা নিজেদের অসন্তুষ্টি ব্যক্ত করেছেন, ছাত্র আন্দোলন এমন একটা জায়গায় পৌছে গেছিল যেখানে শিক্ষকদের রুম তালা মেরে দেওয়া হয়েছিল। ছাত্ররা নিজেদের দাবিতে আন্দোলন করেছেন, তবে লাগাতার আন্দোলন চলায় এর প্রভাব পড়েছে শিক্ষার উপর, এমনটাই মনে করেন কিছু অধ্যাপক।
Comments are closed.