Also read in

যতনে করিবে লক্ষ্মীব্রত আচরণ।জলপূর্ণ ঘট তাহে করিবে স্থাপন

 

“অবশেষে দিবে তাহে সিন্দুরের ফোঁটা।
ফলমূল সিন্দুরাদি যে যা পারো দিবে।
দূর্বা হাতে নিয়ে সবে শুন ব্রতকথা।
এয়োগন ভক্তিভাবে সিন্দুর পরিবে।
লক্ষীবাঁধা রবে তার হবে ধনজন।”

আজ কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা, লক্ষ্মী মা আজ ঘরে ঘরে পূজিতা। অন্য দিন না পড়লেও আজ ঘরে ঘরে সুর করে চলবে পাঁচালী পাঠ। সঙ্গে শঙ্খ আর উলুধ্বনির সংযোজন। লক্ষ্মী ঐশ্বর্যের অধিষ্ঠাত্রী, তাই সবারই প্রার্থনা
“আমার এ ঘরে থেকো আলো করে
এসো মা লক্ষ্মী বসো ঘরে”।
তাছাড়া ঘরে লক্ষ্মী মার পুজো হলে ঘরের শ্রী বজায় থাকে, এমনটা অনেকেই ভেবে থাকেন।

লক্ষ্মী ছয়টি বিশেষ গুণের দেবী। তিনি বিষ্ণুর শক্তিরও উৎস। শারদীয়া দুর্গোৎসবের পর আশ্বিন মাসের শেষে পূর্ণিমা তিথিতে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার আরাধনা করা হয়। লক্ষ্মী হলেন ধনসম্পদ, আধ্যাত্মিক সম্পদ, সৌভাগ্য ও সৌন্দর্যের দেবী। ধন সম্পদের আশায় ঘরে ঘরে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা হয়ে থাকে।সম্পদ ও সমৃদ্ধির দেবী মা লক্ষ্মীর বাহন হচ্ছে পেঁচা। ধনসম্পত্তি, সে টাকাকড়ি হোক বা সাধন ধনই হোক, রক্ষা করতে সদা জাগ্রত থাকতে হয়। রাতে সবাই যখন ঘুমায়, পেঁচা তখন জেগে থাকে। তাই বলা হয়, পেঁচা সেই সম্পত্তি রক্ষা করতে সক্ষম। আবার অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, সর্বগুণসম্পন্না ও সৌন্দর্যের আলোকে আলোকিত সেই লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা একদিকে যেমন আকারে ছোট তেমনি দেখতেও কুশ্রী, কেন? এর পেছনে পণ্ডিতরা মত পোষণ করে থাকেন, লক্ষীর সত্বগুণ ঐশ্বর্য যেমন সত্য, প্রেম, পবিত্রতা, তপস্যা, ক্ষমা,সেবা ভাব পেতে চান যিনি, তার পেচক ধর্ম পালন করা আবশ্যক।

লক্ষীপুজোর আয়োজনে সকাল থেকেই লেগে পড়েন ঘরের মহিলারা। পুরো বাড়ি গোবর দিয়ে নিকিয়ে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে বাড়ি জুড়ে আলপনা দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। আল্পনাতে ফুল পদ্মের সঙ্গে থাকে ধানের ছড়া, লক্ষ্মী ও তাঁর বাহন পেঁচার পা। এদিন সাধারনত ঘরের এয়োতি স্ত্রীদের সারাদিন উপোস করে লাল পেড়ে শাড়ি পড়ে সন্ধ্যায় লক্ষ্মীর সামনে মন্ডা মিঠাই, নৈবেদ্য সাজিয়ে ধূপ ধুনো জ্বালিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়েন। লক্ষ্মীর ফটো কিংবা মূর্তির সঙ্গে ধানের ছড়া রাখার রেওয়াজও রয়েছে। একইভাবে চিড়ে-নারকেল লক্ষ্মীকে নিবেদন করে সেটা গ্রহণেরও নিয়ম রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী নারকেলের জল খেয়ে এ দিন উপোস ভাঙতে হয়। এই নিয়মগুলো অঞ্চলভেদে পরিবর্তিত হয়ে থাকে।

লক্ষ্মী পূজার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক মজাদার রীতি। লক্ষ্মী পুজোর দিন অন্যের বাড়ি থেকে চুরি করার রেওয়াজ বহু প্রাচীন। এই ব্যাপারটা ঘিরে সবচাইতে বেশি উৎসাহী থাকে বাড়ির ছোটরা। দলবেঁধে অন্যের বাড়ি থেকে বিভিন্ন সব জিনিস চুরি করে আনার মধ্যে ভীষণ রকম মজা লুকিয়ে থাকে। যদিও এই চুরির সামগ্রী গুলো খুবই ছোট ছোট থাকে বেশিরভাগই খাদ্য সামগ্রী। কিন্তু তাতেও তাদের আনন্দের শেষ নেই।

আজকাল অবশ্য সেই মাটির ঘরও নেই, আর নিকোনোর জন্য গোবরের ব্যবহারও নেই। অনেকে পুজো করেন সব নিয়ম মেনে। অনেকে এত নিয়মের ধার ধারেন না, পুজো করেন নিজের মত করে।যারা বিদেশ বিভুইয়ে থাকেন তাদের এতসব সামগ্রী সংগ্রহ করাও সম্ভব নয়।

লক্ষ্মী পূজা উপলক্ষে সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেকেই খুব সরব। কেউ বা মা লক্ষীর ফটো আপলোড করছেন। কেউ বা লক্ষ্মী পূজা উপলক্ষে হাতে বানানো খাবারের ফটো আপলোড করছেন, কেউবা লক্ষ্মী পূজার নিয়মের বিরোধিতা করছেন, কেউ আবার লক্ষ্মীর পাঁচালীতে উল্লেখিত কথা গুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। এভাবেই পোস্টগুলো দেখতে দেখতে চোখ আটকে গেল একটা পোস্টে। পোষ্টের একাংশ
“গর্ভের লক্ষ্মী খুন হয় পুত্র লাভের আশায়
মাটির লক্ষ্মী পূজিত হয় অর্থ লাভের আশায়”
এর চাইতে দুঃখজনক আর কি হতে পারে? তাই তাই ঘরের লক্ষ্মীকে অবমাননা করে নয়, সম্মান জানিয়েই হোক ঘরে ঘরে মা লক্ষ্মীর পূজা। কেউ নিয়ম মেনে করুক, কেউ বা নিয়মের উর্দ্ধে উঠে নিজের মনের মত করুক, কেউ শাঁখা সিঁদুর লাল পেড়ে শাড়ি পড়ে মাকে পুজো করুক, ভালো লাগলে কেউ পাঁচালী পড়ুক,কেউ বা নাই পড়ুক। নিজের ব্যক্তিগত পছন্দকে মূল্য দিয়ে নিজের ঘরে লক্ষী বরণ করুক সবাই নিজের মনের মত করে। আসলে মনের ভক্তি টাই আসল। কথায় বলে ভক্তিতেই মুক্তি।

Comments are closed.