"দেড় মাস ধরে মাকে দেখিনি; রাতে শ্মশানে জল চাইলেও পাইনা" ৬০টি কোভিড মৃতদেহ দাহ করেও অম্লান হাসি পিনাকদের
১৬ জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত টানা দেড় মাস ধরে প্রায় ৬০টি কোভিড মৃতদেহ দাহ করেছেন রাইসিং ইউথ সোসাইটির পিনাক রায় এবং তার সহযোগীরা। অনেক সামাজিক বাধা অতিক্রম করলেও তারা কথা রেখেছেন, একটি মৃতদেহও ফিরিয়ে দেননি। শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে একসময় মৃতদেহের স্তুপ।কোনও কোনও মৃতদেহ সাতদিন পুরনো, পচে জল বেরোচ্ছে, যারা এগুলো প্যাক করেছেন তারাও হাত লাগাতে চাইছেন না। তবে পিনাক এবং তার সহযোগীরা সেই পচাগলা মৃতদেহ নিয়ে এসে দাহ করেছেন। হিন্দু নিয়ম মেনে ইউটিউব দেখে মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন, মুখাগ্নি করেছেন। তবু সমাজে তারা প্রায় অস্পৃশ্য, বাড়িতে না থেকে হোটেলে থাকছেন, এক শহরে থেকেও পরিবারের মুখ দেখার সুযোগ নেই।
পুরো প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল নারায়ন মিত্রের মৃত্যুর দিন থেকে। তার মৃতদেহ সৎকার নিয়ে কড়া সুরক্ষা ব্যবস্থা রাখা হয়। রাইসিং ইয়ুথ সোসাইটির যুবকদের বলা হয় তারা যেন পিপিই কিট পরে কোভিড পজিটিভ মৃতদেহ সৎকার করেন। তাদের পাঠানো হয় ডিমা হাছাও সীমান্ত সংলগ্ন এক জঙ্গলে। অন্ধকার রাতে জঙ্গলের ভিতরে কোভিড মৃতদেহ নিয়ে দাহ করার মুহূর্ত এখনও তাদের মনে আছে। নানান বিপদ হতে পারত তবুও তারা কাজ শেষ করে ফেরেন।
সম্প্রতি মৃত্যুর হার কমে এসেছে, এখন প্রতিদিন চার-পাঁচটা করে মৃতদেহ সৎকার করতে হচ্ছে না। তবু সমাজের চোখে এখনও তারা স্বাভাবিক হতে পারেননি। পিনাক রায় বরাক বুলেটিনের সঙ্গে আলাপচারিতায় নানান ঘটনা তুলে ধরেন। তিনি জানান, তাদের এক সদস্য সম্প্রতি অসুস্থ মায়ের জন্য ঔষধ নিয়ে বাড়িতে গেছিল। এলাকার লোক দা-হাতুড়ি ইত্যাদি অস্ত্র নিয়ে তাদের উপর চড়াও হন। শেষমেষ মাকে ওষুধ না দিয়ে অনেক কষ্টে অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসে বছর আঠারোর ছেলেটি। তারা নিজেও বাড়িতে যান না কেননা সেখানে গেলে পাড়ায় দোকান থেকে জিনিস দেওয়া হয় না, মাছওয়ালা মাছ দেয়না, সবজিওয়ালা সবজি দেয়না। যেন তারা কোনও ধরনের অপরাধী। অজানা অচেনা লোকের মুখাগ্নি করেন, হিন্দু নিয়ম মেনে চার দিন পর পর পূরক করেন। তবে এতে কোনও পুরোহিত এসে সাহায্য করেন না,গুগোল বা ইউটিউবে মন্ত্র খুঁজে সেগুলো নিজেই পাঠ করেন।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের মুখাগ্নি করার সুযোগ দিয়েছে প্রশাসন। পিপিই কিট লাগিয়ে কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের মুখাগ্নি করেছেন। এক্ষেত্রেও আবার নানান ঘটনা রয়েছে। এক যুবক তার স্ত্রীর মুখাগ্নি করেননি কারণ মুখাগ্নি করলে এক বছর তিনি আর বিয়ে করতে পারবেন না। ছোট্ট শিশুকে রেখে মা মারা গেছেন, হয়ত তাকে দেখার জন্য আরেক বিয়ে করার পরিকল্পনা ইতিমধ্যেই করে নিয়েছিলেন।
আরেক ব্যক্তি বললেন, “যিনি মারা গেছেন তার কথা ভেবে আমরা অসুস্থ হতে পারি না, মুখাগ্নি আপনারাই করুন।” এভাবে অনেকে নিজের পরিবারের সদস্যদের মৃতদেহের পাশে আসতে ভয় পান। অথচ পচা-গলা অবস্থায় নানান মৃতদেহ নিয়ে প্রতিরাতে শ্মশানে শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছেন শিলচরের যুবকরা।
শ্মশানে রাতে তাদের সঙ্গে কি ব্যবহার হয় এব্যাপারে পিনাক বলেন, “আমাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে খাবার দেওয়া থাকে। রাতেই সেগুলো হোটেলে পৌঁছে দেওয়া হয়। কাজ সেরে হোটেলে যখন খাবার খেতে যাই প্রায় সকাল হয়ে যায়। খাবারে গন্ধ হয়ে যায়, সেটা মুখে তোলার নয়। আমরা জল বা খাবার ইত্যাদি কিছুটা নিয়ে যাই, তবে এটা শেষ হয়ে গেলে আমাদের জল কিনে খাওয়ারও অধিকার থাকে না। যারা দোকান দিয়ে রয়েছেন তাদের দোষ নয়, এলাকার মানুষ বলে দিয়েছেন আমাদের কাছে যাতে কোনও কিছু বিক্রি করা না হয়। আমরা এমনও বলেছি, টাকা কোনও একটা জায়গায় রেখে দেব, আপনারা জল দূরে কোথাও রেখে দিন আমরা নিয়ে নেব। সেটাও মানতে নারাজ তারা। একবার আমাদের এক বোতল জল দেওয়া হয়েছিল, তার জন্য রীতিমতো বিচার হয়েছে এবং বিধান দেওয়া হয়েছে কোনওভাবেই যাতে এর পুনরাবৃত্তি না হয়। ফলে দুপুরে খাবার পর আমরা আর পরের দিন সকালে খাবার খাই। অনেক রাত্র জল ছাড়াই কাটিয়ে দিই।
এভাবে কতদিন চলবে আমরা জানি না, তবে যখন কথা দিয়েছি কাজটি সম্পন্ন করব, শেষ দিন পর্যন্ত করে যাব। এর অন্যথা হবে না। আমাদের পরিবারের সদস্যরাও এবার মেনে নিয়েছেন, আমরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে তাদের কাছে ফিরতে পারব না। তবু মাঝে মাঝে ভয় হয় যদি কোনদিন সাংঘাতিক অসুখ হয়, যদি কোনদিন আর বাড়ি ফেরা না হয়। মাঝে মাঝে এই ভয়ে রাতে ঘুম হয় না। তবু মানুষ হিসেবে গর্ববোধ করি।
Comments are closed.