
"সরকারি সংখ্যার অনেক বেশি মৃতদেহ পুড়িয়েছি," শিলচরে সম্বর্ধনা পেয়ে জানালেন রাইজিং ইয়ুথ সোসাইটির সদস্যরা
১৬ জুলাই কাছাড় জেলায় সরকারিভাবে ঘোষণা অনুযায়ী প্রথম করোনা মৃত্যু হয় এবং সেদিন থেকেই লাগাতার মৃতদেহ দাহ করেছে চলেছেন রাইজিং ইয়ুথ সোসাইটি সদস্যরা। সরকারিভাবে সেই সংখ্যা সত্তরের কাছাকাছি হলেও আদতে একশোর বেশি এমন মৃতদেহ দাহ হয়েছে এবং সেটা করেছেন পিনাক রায় ও তার সহযোগীরা মিলে। বছরশেষের সন্ধ্যায় তাদের সংবর্ধনা দিতে এক অনুষ্ঠান আয়োজন করেন বিশিষ্ট সংগঠক তথা ব্যবসায়ী চন্দন শর্মা। এতে অংশ নেন শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। প্রত্যেকেই করোনাকালে রাইজিং ইয়ুথ সোসাইটির সদস্যদের কাজের প্রশংসা করেন এবং তাদের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দেন।
অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গুরুচরণ কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ পার্থ সারথি চন্দ, জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি বাবুল হোড়, চিকিৎসক সিদ্ধার্থ ভট্টাচার্য সহ অনেকেই। রাইজিং ইয়ুথ সোসাইটির সদস্যদের সম্মাননাপত্র সহ বিভিন্ন উপহার তুলে দেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথিরা।
নিজেদের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে রাইজিং ইয়ুথ সোসাইটির সদস্য বলেন, ‘যখন প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃতদেহ সৎকার করেছি, আমরা জানতাম না তিনি কে এবং কি পদ্ধতিতে কাজ হবে। বৃষ্টির রাতে গভীর জঙ্গলে এক অজানা ব্যক্তির মৃতদেহ পুড়িয়েছি যিনি করোনা ভাইরাসে মারা গেছেন। আমরা এলাকায় পৌঁছনোর আগে চারটি মুসলমান ছেলেকে চিতা সাজানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তারা কখনও হিন্দু মানুষের সৎকার করেননি, তবু তারা সেটা সাজিয়েছে যেখানে পরে নারায়ন মিত্রের সৎকার হয়েছে। এমন মানবিকতার উদাহরণ আমাদের এই যাত্রায় অনেকগুলো রয়েছে। এক সময় এলাকার মানুষ আমাদের সদস্যদের বাড়িতে ঢুকতে দেননি, মায়ের ওষুধ নিয়ে বাড়িতে যাওয়ার পর ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা হয়েছে, পচা গলা মৃতদেহ সৎকার করেছি, মাসের-পর-মাস শহরে থেকেও পরিবারের মানুষের মুখ দেখিনি। এমন অনেক উপলব্ধি রয়েছে যা বলতে গেলে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যাবে কিন্তু শেষ হবেনা। সরকারিভাবে যতগুলো মৃতদেহ জানানো হয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি সংখ্যায় মৃতদেহ পোড়ানো হয়েছে। তবু এত কিছুর পরেও আমাদের উপলব্ধি একটাই – কঠিন সময়ে অজানা অচেনা ব্যক্তির পাশে দাঁড়াতে পেরেছিলাম, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই দিনগুলো মনে থাকবে।’
আগামীতে শুধু করোনা ভাইরাসে মারা যাওয়া নয় সাধারণভাবে মারা যাওয়া গরীব দুঃস্থ পরিবারের সদস্যদের মৃতদেহ সৎকার বিনামূল্যে করার পরিকল্পনায় রয়েছেন পিনাক এবং তার দলের সদস্যরা। সাধারণত এমন সংকল্প নিতে দেখা যায় না কোন তরুণ যুবক দলকে।
রাইজিং ইয়ুথ সোসাইটির সদস্যদের সংবর্ধনা দেওয়ার ব্যাপারে চন্দন শর্মা বলেন, ‘যখন আমরা লকডাউনে নিজেদের করোনা ভাইরাস থেকে দূরে রাখতে বাড়িতে আটকে রেখে ছিলাম, এই যুবক দল ভাইরাস সংক্রমণে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মৃতদেহ নিজের হাতে পোড়ানোর কাজ করছিলেন, এটা ভাবতেও ভয় লাগে। অজানা, অচেনা পরিবারের মানুষের মৃতদেহ পুড়িয়েছেন, তারপরেও সমাজে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি দেখতে হয়েছে। নিজের মাকে দেখতে গিয়ে পাড়ার মানুষের কাছে হেনস্তা হয়েছেন তারা, এই বয়সে এতটা ত্যাগ খুব বড় মনের মানুষ করতে পারে। সে সময় তাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো ক্ষমতা ছিল না আমাদের, আজ তাদের সঙ্গে আছি। তাদের সংবর্ধনা দিয়ে আমরা নিজেরাই সম্মানিত।’
পার্থসারথি চন্দ বলেন, বহু বছর পরেও যখন আমরা করোনা পরিস্থিতির কথা আলোচনা করব, সবথেকে উজ্জ্বল নাম হয়ে থাকবে এই যুবকগুলোর। আজ তাদের সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে, তবে আমি মনে করি তাদের সম্মান জানিয়ে আমরাই সম্মানিত।
Comments are closed.