পুজোয় আমার শিলচর আসা চাই-ই, কিন্তু কেন? - জানাচ্ছেন অভিজ্ঞ সাংবাদিক সত্রজিৎ সেন
“তোমায় পড়েছে মনে, আবার শ্রাবণ দিনে, একলা বসে নিরালায়।” কিশোর কুমারের এই গানটা শিলচর নিয়ে আমার অনুভূতিকে ঠিক ছুঁয়ে যায়, বিশেষ করে দুর্গাপূজার সময়।
আমি বিগত এগারো বছর ধরে আমার প্রানের শহর শিলচরকে ছেড়ে এখানে এই কংক্রিটের জঙ্গল দিল্লিতে বাস করছি। একেবারে খাটি সিলেটি মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত যুবক হিসেবে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় ঘরবাড়ি, পরিবার ছেড়ে বেরিয়ে আসতে আমায় খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। ২০০৭ সালে জীবনে প্রথম আমি পুজোয় বাড়ির বাইরে পরিবার-বিচ্ছিন্ন হয়ে রইলাম। আমি ছুটিও পাইনি কারণ আমি সবেমাত্র চাকুরিতে যোগ দিয়েছিলাম। সত্যি কথা বলতে আমি এই নিয়ে খুব একটা দুঃখও পাইনি, কারণ তখন আমি ধরে নিয়েছিলাম আমি বন্ধুদের থেকে আলাদা এবং সাংঘাতিক কিছু একটা করব।
দু বছর পর ২০০৯ সালে আমি পুজোয় বাড়ি এলাম । আমার মধ্যে তখন বাঁধনহারা আনন্দ, তবে সেটা কিন্তু বাড়ি ফিরে আসার জন্য নয়। আমার বাধন হারা আনন্দের কারণ, আমি বাড়ি ফিরছিলাম আমার নিজের অর্জিত টাকায় ফ্লাইটের টিকিট কেটে। আমার বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দের আরও কারণ, আমার হাতে ছিল ব্ল্যাকবেরি ফোন, চোখে ছিল মহার্ঘ সানগ্লাস এবং বন্ধুদের চমকে দেওয়ার মতো আরও আরও অনেক জিনিস। আমি মনে মনে খুব খুশি ছিলাম, কারণ আমি বন্ধুদের থেকে অনেক আলাদা কিছু একটা করতে পেরেছি।
তবে বস্তুজগতের এই ফানুসটা চুপসে যেতে খুব একটা সময় লাগেনি। ২০১০ থেকে ২০১৫ – এই বছর গুলোতে আমি পুজোয় শিলচরে আসতে পারিনি নানা কারণে। তবে এই বিষাদময় বছরগুলো বেশ ভালোভাবেই আমাকে বন্ধু বান্ধব এবং পরিবারের সাথে পুজো উপভোগ করার গুরুত্বটা বুঝিয়ে দিল ।
পরিবর্তনশীল জগতে উৎসব উদযাপন এখন আর কোনো একটা বাঁধনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সময়ের সাথে সাথে উৎসব উদযাপনের ধরন ধারনেরও অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। বর্তমান জগতে সবাই নিজেকে নিয়ে খুবই ব্যস্ত, তাই অন্যদের সাথে আনন্দ উৎসব করার সময় কোথায়?
দুর্গাপুজো এখন আমার কাছে এক উপভোগ্য উৎসব, চিন্তা ভাবনা মুক্ত একটা শান্তির দিন। দূর্গাপুজো এখন আমার কাছে ভুল ভ্রান্তি গুলো দূরে সরিয়ে ভাঙা হৃদয় জোড়া লাগানোর উৎসব, জীবনে এগিয়ে যাওয়ার উৎসব।
যে বছরগুলোতে পুজোয় আমি শিলচরে আসতে পারেনি, সেই বছর গুলোই আমাকে জানিয়ে দিলো শিলচরে আসা, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আবার মেলা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ।
এই পুজোর দিনগুলো আমাকে সমস্ত কাজ দূরে সরিয়ে রেখে এক সম্পূর্ণ বিশ্রাম দেয়। আমি প্রাণ খুলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে পারি, খেলতে পারি, ঘুমাতে পারি – যা কর্মস্থলে সম্ভব নয়। তাই পুজো হচ্ছে চাকরি থেকে সাময়িক বিরতি এবং কাজকে দূরে সরিয়ে রেখে সময়কে উপভোগ করা।
এটা পরিবার এবং বন্ধু-বান্ধবদের সাথে একটা পুনর্মিলনের মাধ্যম। ওই ছয়টা বছরে আমি কি কি মিস করেছিলাম সেটার একটা তালিকাও তৈরি করেছিলাম। পরিবার এবং বন্ধু-বান্ধব ছাড়াও আমি মিস করেছিলাম প্রেমতলার ফুচকা, চৌরঙ্গীর আড্ডা, প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘোরা, শ্রেয়শী রেস্টুরেন্টে খাওয়া এবং দশমীতে উদ্দাম নৃত্য। এখন, দুর্গা পুজোতেই আমি পুনরায় এগুলো ফিরে পাই।
তাই প্রত্যেক বৎসর পুজোয় বাড়িতে আসা এখন আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ বৎসরও আমি আসছি, আশা রাখছি আপনাদের সবার সাথেই দেখা হবে ; শারদীয় শুভেচ্ছা।
Comments are closed.