
কাছাড়ের সিঙ্গেরবন্দ এলাকায় প্রত্যেক মহিলা এখন আত্মনির্ভর, তাদের বানানো হ্যান্ডলুমের কাপড়-চোপড় পৌঁছে যাচ্ছে বাইরের রাজ্যে
কাছাড় জেলার লক্ষীপুর সমষ্টির সিঙ্গেরবন্দ এলাকায় এখন মহিলারা সবথেকে বেশি স্বনির্ভর। তাদের বানানো হ্যান্ডলুমের শাড়ি, গামছা থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাপড় শুধুমাত্র কাছাড় জেলায় নয়, পাশবর্তী রাজ্যেও বিক্রি হচ্ছে। বিশেষকরে লকডাউনের পরিস্থিতিতে বাড়িতে বসে হস্ততাঁত পদ্ধতি ব্যবহার করে তারা অনেক বেশি কাপড়-চোপড় তৈরি করতে পেরেছিলেন। এলাকায় প্রায় ৪০০ জন মহিলা দিনরাত কাপড় বুনছেন, তাদের বানানো কাপড় শিলচর, ধলাই, কালাইন এবং লক্ষ্মীপুরে প্রথমত বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া মণিপুরে চলে যাচ্ছে তাদের বানানো বেশ কিছু কাপড় চোপড়। প্রত্যেক মহিলা রোজগার করছেন, অনেকে পরিবারের পুরুষদের থেকে বেশি রোজগার করছেন এবং সানন্দে সংসার চালাচ্ছেন।
শনিবার শিলচরে জেলা হ্যান্ডলুম বিভাগের তরফে তিনদিন ব্যাপী একটি প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। সিঙ্গেরবন্দ ক্লাস্টার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের অধীনে আয়োজিত প্রদর্শনীতে মহিলারা নিজেদের হাতে তৈরি করা কাপড়চোপড় বিক্রি করছেন। কাছাড় জেলায় প্রথমবার এমনটা হচ্ছে এবং এর পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে মহিলারা অনেক বেশি কাপড় কাপড় চোপড় বানিয়েছেন। হস্ততাঁত শিল্প বিভাগের পক্ষ থেকে হীরালাল সিংহ জানান, ২০১৮ সালে রাজ্যে ৬টি জেলার একটি এলাকা নির্ধারণ করে সেখানে হস্ততাঁত শিল্পের উন্নয়নে বিশেষ অনুদান দেয় রাজ্য সরকার। বরাক উপত্যকা থেকে একমাত্র কাছাড় জেলার লক্ষীপুর অঞ্চলের সিঙ্গেরবন্দ ক্লাস্টার’র আওতায় আসে। এলাকায় ২০টি আত্মসহায়ক দল বহুদিন ধরে হস্তশিল্পের কাজ করে আসছে। প্রায় ৪০০ জন মহিলা এর সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। তাদের কাজের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের পরিকাঠামোগত উন্নতি হয়েছে এবং পরবর্তীতে কাপড় বানানোর জন্য রো-মেটেরিয়াল সুলভ মূল্যে পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। এখন মহিলারা তিন থেকে চার গুণ বেশি রোজগার করতে পারছেন, তাদের কাজের গতি এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে আগে প্রতিদিন যতটুকু কাজ করতেন তার থেকে তিনগুণ বেশি এখন করছেন। আগামীতে বরাক উপত্যকার নিজস্ব সামগ্রী ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের হস্ত তাঁত প্রডাক্ট বানানোর পরিকল্পনা রয়েছে।”
বৃহস্পতিবার সকালে শিলচর অফিসপাড়ায় হস্ততাঁত শিল্প কার্যালয় চত্বরে তিন দিনব্যাপী প্রদর্শনী এবং বিক্রি অনুষ্ঠান শুরু হয়। সিঙ্গেরবন্দের মহিলারা নিজেদের বানানো শাড়ি গামছা সহ অত্যন্ত সুন্দর সুন্দর কাপড়-চোপড়ের পসরা সাজিয়ে সেখানে যোগ দেন। অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা দর্শকরা প্রথমেই দোকানগুলোয় ভিড় করেন এবং অত্যন্ত উৎসাহিত হয়ে কাপড় কিনতে শুরু করেন।
এদিন শিলচরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মুখ্য অতিথি হিসেবে যোগ দেন ডিডিসি জেসিকা রোজ লালসিম। তিনি বলেন, “একজন মহিলা হিসেবে আমি গর্বিত যে আমার জেলার মহিলারা এমন একটা নিদর্শন তুলে ধরতে পেরেছেন। একসময় মনিপুর থেকে গামছা ইত্যাদি কাছাড় জেলায় বিশাল পরিমাণে আসত, অথচ সিঙ্গেরবন্দের মহিলারা এর উল্টোটা করে দেখিয়েছেন। এখন মনিপুর থেকে গামছা আসছেনা, বরং কাছাড় থেকে মনিপুরে গামছা সহ অন্যান্য সুন্দর সুন্দর কাপড় চোপড় পাঠানো হচ্ছে এবং সেখানে বিক্রিও হচ্ছে। আমি চাই এভাবে শিলচর শহর তথা বরাক উপত্যকার বাজারে আমরা হ্যান্ডলুমের গামছা-শাড়ি ইত্যাদি এত বেশি পৌঁছে দেব, যাতে মেশিনে বানানো কাপড় মানুষ কেনা বন্ধ করে দেন। মহিলারা সমাজে অত্যন্ত সুন্দর রং ভরে দিতে সমর্থ, আজকের অনুষ্ঠানে এত রঙ্গিন কাপড় দেখে মনটা উৎফুল্ল হয়ে গেছে।”
সিঙ্গেরবন্দের মহিলা প্রমিলা দেবী বলেন, “এখন আমাদের এলাকায় কোনও মহিলা অন্য কাজ করেন না। আমাদের সময় নেই, কিন্তু কাজ অনেক বেশি। প্রত্যেকে রোজগার করছেন এবং অত্যন্ত উৎসাহ নিয়ে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। মহিলা স্বাধীনতার এটা একটা অনন্য নিদর্শন। এখন আমরা আর বাড়ির পুরুষদের দিকে হাত বাড়িয়ে থাকিনা, বরং তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সংসার চালাতে সমান সহযোগিতা করি। কোনও কোনও মহিলা তাদের বাড়ির পুরুষদের থেকে বেশি রোজগার করছেন এবং সেটা সসম্মানে। আমরা ধীরে ধীরে অন্যান্য মহিলাদের কাজ শেখাচ্ছি এবং উদ্বুদ্ধ করছি। যারা সরকারি সাহায্য পাচ্ছে না তারাও কাজ করছেন এবং রোজগার করতে পারছেন। এখন আমরা প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ জন মহিলা এই কাজে যুক্ত রয়েছি, আমার বিশ্বাস আগামীতে হাজার হাজার মহিলা এই পদ্ধতিতে আত্মনির্ভর হবেন।”
Comments are closed.