দেশভাগ: এখনও গেল না ক্ষত
দেশভাগ: এখনও গেল না ক্ষত
১৯৪৭- এর ১৫ আগস্ট। সৃষ্টির সেই আদিকাল থেকে যেভাবে সকাল-সন্ধ্যা হয়, তেমনি সেই বিশেষ সকালেও পূর্বাকাশে দেখা দিল
নবারুণ। জবাকুসুম সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্। প্রতিদিনের মতো গাছপালা-নদীনালা-হাওরবিল- সবুজ মাঠ- সোনালী ধানক্ষেত-নীল আকাশ গায়ে মেখে নিল সেই মহাদ্যুতি। কোথাও কোনো পরিবর্তনের ছোঁয়া নেই, – আকাশ বাতাস জল মাটিতে। তবে হ্যাঁ,- মাটি! এই মাটি সরে গেলো লক্ষ-লক্ষ মানুষের পায়েরতলা থেকে সেই দিনটিতে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে।
ভিটে হারাদের মনে প্রশ্ন জাগে,- এই দেশ কি আর আমাদের নয়? এই ঘরদোর- বাঁশবাগান-পুকুরঘাট-পাখির কলতান? মিজানুর, আব্দুল আর দেওয়ানবাড়ির বাসিত সাব?
শতাব্দীর অন্যতম ভয়াবহ মনুষ্যসৃষ্টি বিপর্যয়। বাস্তচ্যুতদের মহামিছিল। সেই সুযোগে মানুষের ভেতরের পশু দাঁত-নখ বের করে। খুন-জখম-গৃহদাহ। ‘লুটের মাল’ হল মা-মাটি-মানুষসহ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ। ভীতিপ্রদর্শন-দলবদ্ধ সন্ত্রাস- ধর্ষণ-অপহরণ-ধর্ম ও সম্ভ্রম নাশ।
অন্যদিকে ক্ষমতালোভী বৃদ্ধের দল ক্লান্ত যাত্রার শেষ পরিচ্ছেদে এসে ছিঁড়ে-খুবলে খায় মানচিত্র। খেলে পাশা, সাজায় দাবার ঘুঁটি।
আমার মুখে অন্তহীন আত্ম লাঞ্ছনার ক্ষত
আমার বুকে পালানোর পালানোর আর পালানোর
দেশজোড়া স্মৃতি।
(দেশহীন, শঙ্খ ঘোষ)
হিজল গাছের ফুল টুপ টুপ করে এখনো পড়ছে জলের ওপর
বলছে, যাবে কোথায়?
তারপর একটু দূরেই মাঠে
কালো মেঘের মতো ধান হয়েছে
লক্ষীবিলাস ধান!
তারও এক প্রশ্ন- যাবে কোথায়?
( উদ্বাস্তু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত)
পথকে সম্বল করে দলে দলে এগিয়ে চলে তারা নতুন মানচিত্র সদ্য আঁকা লাল রঙের দাগের এপার থেকে ওপারে, দেশবাড়ির নাড়ির বন্ধন ছিন্ন করে। একই রাষ্ট্রের একদল মানুষ নিজ রাষ্ট্রেই খুঁজে অন্য এক দেশ। যাচ্ছে তারা নতুন দেশে। নিজধর্ম রাষ্ট্রে, নিরাপদ ভূ-খণ্ডে। বিভাজনপূর্ব অখন্ড এক দেশের এক অংশ থেকে অন্য অংশে। কিন্তু নতুনদেশে
নতুন দেশে নতুন জিনিস
মানুষ নয়, জিনিস।
নতুন জিনিসের নতুন নাম
উদ্বাস্তু!
শুধু উদ্বাস্তু নয়, জন্ম নেয় অারও অনেক শব্দ। রিফিউজি, রিফু, আবাদি, উঠরা, শরণার্থী, বাস্তুহারা, ছিন্নমূল, ভগনিয়়া, কেলা বঙ্গাল, বঙ্গাল খেদা, বাংলাদেশি বিদেশি এবং বিদেশি বিতাড়ন। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, দশকের পর দশক যায়- ঘৃণা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। শিকড়হীনদের প্রতি বনস্পতিদের উন্নাসিকতা অবজ্ঞা নির্মম বিদ্বেষ,- যা ধর্মের প্রলেপেও উপশম হয় না। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল। জ্বলে ওঠে আগুন। ঘৃতাহুতি দেয় উগ্র জাতীয়তাবাদী দৃশ্য গণমাধ্যম। ভুল এবং মিথ্যা ব্যাখ্যা দিয়ে খেপিয়ে তোলে মানুষ। গর্জে উঠে ঘাতকের আয়ুধ।
নিত্য নতুন শব্দেরা আসে একে একে। এনআরসি, লিগেসি ডেটা, ডি-ভোটার, ফরেনার্স ট্রাইবুনাল, ডিটেনশন ক্যাম্প, ঘুসপেটিয়া, উইপোকা। খসড়া নগরিকপঞ্জি ছুটদের হাহাকার, আত্মহত্যা, জেলহাজত। মুকবধির ভীষ্ম পিতামহ।
ভূমিপুত্র নামের স্বয়ম্ভু প্রভুদের হুংকার। বেজে ওঠে রণডঙ্কা। মা-মাটি-ভাষা-সংস্কৃতি বুঝি তলায় অতলে, ‘বিদেশিদের’ চাপে ! এই শঙ্কাকে রোপণ করে শাসন ক্ষমতা দখলে মত্ত হয় প্রতি দশকে নতুন নতুন মুখ। ‘জয় মা’ রবে কাঁপে আকাশ-বাতাস-গিরি-নদী- কন্দর। এই বুঝি বজ্রপাত হয় আকাশ হতে।
একটা চারাগাছ যতদিনে মহীরুহ হয়ে ওঠে, ততদিনে কি একটা মানুষ একটা অঞ্চলের ভূমিপুত্র হতে পারেনা?
Comments are closed.