
কবিগুরু, এখানে তোমার আর কোনো ঘরবাড়ি নেই
বড়দিনে নাকি সান্টা ক্লজ এসে নানা আবদার মিটিয়ে যান। শবে বরাতের রাতে নাকি সমস্ত মৃত মানুষের আত্মারা মর্ত্যলোকের কাছাকাছি চলে আসেন। এই সময়ে রাত জেগে প্রার্থনা করে মানুষ। ঠিক তেমনি আজ সকাল থেকে সারাদিন, সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত বাঙালি মেতে থাকবে তোমাকে নিয়ে। এই তারিখটা বাঙালি বাংলায় বলে। এদিনের নাম পঁচিশে বৈশাখ। এরশাদ সাহেবের পঞ্জিকা সংস্কারের খেলায় আজ পঁচিশে বৈশাখেও বঙ্গভঙ্গ। বাংলাদেশ আর ভারতের বাঙালি তোমার জন্মদিনেও আজ বিভাজিত। ওপারে তুমি গতকাল, এপারে তুমি আজ। তুমি বাঙালি ঘরে জন্মেছো তাই আমাদের অহংকারের শেষ নেই। তুমি বাঙালি হয়ে দেশকে দিয়েছো বিশ্বের শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা, এও আমাদের পরম শ্লাঘার বিষয়। আমরা দীর্ঘদিন মেয়েকে সৎপাত্রস্থ করতে ছোটবেলা থেকেই সারেগামাপাধানিসা-র আরেক নাম দিয়েছি রবীন্দ্রসঙ্গীত। ভোর না হতেই পল্লী থেকে শহর বাঙালি মেয়েরা ভোরের আকাশ মুখরিত করত ‘জাগো মোহন প্যারে’-র সাথে এক নিঃশ্বাসে ‘হে সখা, মম হৃদয়ে রহো’ বা ‘জাগরনে যায় বিভাবরী’ গেয়ে। ছেলেরা তখন পাশের ঘরে বসে ‘এক এক্কে এক’ করে পাড়া মাথায় তুলত বড় হয়ে স্কুল মাষ্টার বা কেরানি হবে বলে। সেই ছেলে বা মেয়ে বড় হয়ে বিয়ের দিনে পাড়া পড়শির কাছে উপহার পেতো ‘সঞ্চয়িতা’ বা ‘নৌকাডুবি’। বাঙালি এখনও বাঙালি বলেই নিজেকে দাবি করে। তবে তার চাল চলন অনেকটাই পাল্টে গেছে। এখনকার বাঙালি তোমাকে নিয়ে গর্ব করে ঠিকই, কিন্তু একটা আফশোসও তার সর্বাঙ্গে। একটা ধীরুভাই বাঙালির ঘরে জন্মালে আজ বাঙালি এত পিছিয়ে থাকত না। আর যদি থাকত একটা বাল থ্যাকারে তবে কলকাতাটা ‘বিহারী ভূত’ আর ‘মেরো’দের দখলে যেতো না। ‘আমচি মুম্বাই’ এর মত বাঙালির নিজস্ব জনপদ থেকে যেতো। আর হবে কী করে? কাপুরুষের জাত না? পাঞ্জাবী দেখো, টোটাল পপুলেশন এক্সচেঞ্জ করে ওদের সমূলে বিতাড়ন করেছে। কলকাতার তো অর্ধেক প্রায় নিয়েই নিল। এখন মেয়রও ওরা। দুদিন বাদে বাঙালির ‘জাতীয় উৎসব’ দুর্গাপূজা বন্ধ হয়ে যাবে। এখনই নাকি কোথায় কোথায় সরস্বতী পূজা করতে দিচ্ছে না। একটা রামপাঁঠা বা গোপালপাঁঠার প্রয়োজন ছিল এখন।
তুমি কবিগুরু। আজ তোমার জন্মদিন। কিন্তু এবার খুবই মুশকিল। ভোটের বাজার তো! আমরা এখন চাল ডাল তেল নুন চাকরি বাকরি চিকিৎসা বাসস্থান নিয়েই ভাবছি না, তো তোমার কথা কখন ভাবব! এখন আমরা ভাবছি পরমাণু বোমাটা এবারের ধনতেরাসে না দিওয়ালিতে ফাটাবো। পোস্ট অফিস থেকে গঙ্গাজলের পাশাপাশি গোমূত্র ও গোবর বিক্রির আউটলেট করাটা লাভজনক হবে কিনা, এসব ভাবছি আমরা। এখন আমাদের তোমার ‘গোরা’ বা ‘চিত্রাঙ্গদা’ বা ‘সভ্যতার সংকট’ নিয়ে ভাবার সময় নেই। ভোটের বাজারে এবার বাঙালির রবীন্দ্র জয়ন্তীরও সুর আলাদা। ভোটের সংকীর্তনেও মিশে যাচ্ছো তুমি। ওই তো দেশবরেণ্য নেতা বলছেন একশো কুড়িটা চোঙে এলাকা গমগম করে, ‘রবীন্দরনাথ তো ভারতীয় পরম্পরাকেই দুনিয়ার সামনে তুলে ধরেছেন। তার হৃদয়ে ছিল উপনিষদ, পরনে ছিল সন্ন্যাসীর আলখাল্লা। তিনি এদেশের ধর্ম সংস্কারেরই প্রচারক ছিলেন। আমরাও রবীন্দরনাথের ‘ভাবনাত্মক’ দেশপ্রেম দিয়েই এ দেশের সৈন্যবাহিনীর মানমর্যাদা রক্ষা করব।’ অন্য পাড়ার মাইকে বলছে, ‘আমিই তো কবিগুরুর সেই সাধারণ মেয়ে যাকে নিয়ে তিনি কবিতা লিখেছেন। আমরা কী কখনো ভুলতে পারি মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুর পর লেখা কবিগুরুর সেই অবিস্মরণীয় গান?’ দূরে গুটিকয়েক তরুণ ঝাণ্ডা কাঁধে গাইছে ‘বাঁধ ভেঙে দাও’। কেউ শোনে না।
না, এই মুহূর্তে তোমার এর চেয়ে বেশি প্রয়োজন নেই। ভোট ফুরোলে আমরা বিবেচনা করব, যেমনটা সরকারি আমলারাও বলছেন, সিলেবাসে আর রবীন্দ্রনাথের লেখা রাখার প্রয়োজন আছে কিনা। বাংলা ভাষাটাও শিখে কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, কোনো লাভ নেই। এসব অনেক ভেবেই শান্তিনিকেতনে সাইনবোর্ডে যে ভাষা সকলে বোঝে সেই হিন্দিতে সবকিছু লেখা শুরু হয়েছে। আমরা আজকের বাঙালি পরশু ছিলাম লাল। গতকাল সবুজ। আজ আবার রঙ পাল্টানো যায় কিনা ভাবছি। না, এখানে তোমার কোনো ঘরবাড়ি আর নেই। আমরা রামনবমী আর ধনতেরাসে মেতে আছি। এবার রবীন্দ্র জয়ন্তী বন্ধ। আগামীতে গণেশ পূজা আরেকটু বড় করে করা যায় কিনা ভাবা হচ্ছে। তোমার ওই ‘জাতীয়তাবাদের চেয়ে মানবিকতাকে বড় মনে করি’ মার্কা কথাবার্তা বাঙালির ভালো লাগে না। ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো বলে সোস্যাল মিডিয়াতে ট্রোলড হওয়ার কোনো বাসনা নেই। তুমি বলেছিলে বটে ‘কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি?’ এখন আমাদের প্রভাত সন্ধ্যায় তোমার স্থান ধীরে ধীরে প্রতীকী হয়ে বিস্মৃতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভুল বললাম, আজ পাড়ায় পাড়ায় তোমার গান নাচ আর কবিতায় মুখরিত হবে চারধার। সত্যি কথাটা হল, এই হঠাৎ একদিনের জন্যে জেগে ওঠাটা আসলে বিস্মৃতির পথেই এগোনো। তুমি সারা বছর নেই। আমাদের ব্যক্তিজীবনে নেই। সামাজিক জীবনে নেই। এদেশের রাজনীতিতে কখনোই ছিলে না। তুমি ছবিতে আছো। জাতীয় সঙ্গীতে আছো। আর আছো বছরের একটি দিনে।
এদেশে আসলে তোমার কোনো ঘরবাড়ি কোনোদিনই ছিল না। একটা ভ্রম ছিল মাত্র। আজ সে ভ্রমও নেই।
Comments are closed.