Also read in

Corona : Sweden to Hyderabad, experience shared by Arindam

করোনা। কান পাতলে সর্বত্র একটাই নাম। বিশ্বজুড়ে। তাড়া করে বেড়াচ্ছে আতঙ্ক। আমি ভারত বর্ষ থেকে অনেক দূরে।দূরে আমার পরিবার থেকেও। সুদূর স্পেনে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই দেশে ফিরতে মন উদগ্রীব হয়ে উঠে। এই কঠিন সময়ে ফিরতে চাই পরিবারের কাছে। অংক কষে দেখলাম এখন ফিরে আসাই সবচাইতে ভালো।

সেই অনুযায়ী আমি আমার কোম্পানি ‘উইপ্রো’কে জানালাম যে আমি দেশে ফিরতে চাই। উইপ্রো’ আমার কথায় রাজি হয়। আমি আমার ক্লায়েন্টের সঙ্গে কথা বলি। ওরাও রাজি হয়। কিন্তু আমি ওদের সঙ্গে কথা বলে স্পষ্ট বুঝতে পারি,ব্যাপারটাতে ওরা দুঃখ পেয়েছে। ওদের মনে হচ্ছিল যে আমি ওদের দেশের কিংবা ওদের উপর ভরসা না করে দেশে ফিরতে চাইছি। আমি আবার আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলাম। অথচ আমার টিকিট কাটা হয়ে গেছিল ১৪ মার্চের। তখন যদি ফিরে আসতাম তাহলে আমাকে এমন রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হত না। তারপর আবার ১৮ মার্চের টিকিট কাটা হলো। ১৬ তারিখ সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে এসে টিভির পর্দায় চোখ রাখতেই আঁতকে উঠলাম। ভারত ১৮ মার্চ লক হয়ে যাচ্ছে।ইউরোপিয়ান কান্ট্রি এবং গালফ কান্ট্রিগুলোকে লক করে দেবে। আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার টিকিট এগিয়ে আনার জন্য চেষ্টা শুরু করলাম। ফোন করছি, মেইল করছি, কিন্তু কোন উত্তর পাচ্ছিনা। আমার তখন দিশেহারা অবস্থা। পুরো রাত জেগে বসে আছি। রাত দুটোর সময় ওদের ম্যাসেজ পাই যে ওরা চেষ্টা করছে। দু’ঘণ্টা ধরে চলে ওদের সঙ্গে কথাবার্তা। যাবতীয় ফ্লাইটের বিষয়ে ওরা আমাকে জানায়। বেশিরভাগ ফ্লাইট বাতিল হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত একটা ফ্লাইট পাওয়া গেল। এমি রেইডস। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দুবাইতে ৪ ঘণ্টা পরের কানেক্টিং ফ্লাইটটা ক্যানসেল হয়ে যায়। তারমানে আমাকে ভারতের উদ্দেশ্যে ফ্লাইট ধরতে ১৪ ঘণ্টা দুবাইতে থাকতে হবে। ব্যাপারটা ভেবে অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু আমার কাছে আর কোনো রাস্তা খোলা ছিল না।

তার উপর আমার ফ্লাইট স্টকহোম থেকে।সারা রাত্র ধরে ঘুম নেই। সকালে সুইডেনের ভ্যাক্সজো থেকে দুটো ট্রেন চেঞ্জ করে পৌঁছালাম স্টকহোমে। এসব শহরে যেখানে খুব একটা বেশি মানুষ দেখা যায় না সেখানে বিমানবন্দরে এসে দেখি মানুষ মানুষে ছয়লাপ। প্রচুর ভারতীয় এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছেন। আসলে স্টকহোম থেকে যে দিল্লি এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট ছিল সেটা বাতিল হয়ে যাওয়ায় মানুষ পাগলের মতো ছোটাছুটি করছেন। যে কোন উপায়ে ভারতে ঢুকে যেতে চান। অনেকেরই টিকিট পর্যন্ত নেই, তবু চেষ্টা চালাচ্ছেন কোনভাবে যদি কিছু করা যায়। আমাকে তখন চিন্তা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, ঠিক এভাবেই যদি দুবাই থেকে ভারতে আসার বিমান বাতিল হয়ে যায়! তাহলে ১৪ দিন আমাকে দুবাইতেই থাকতে হবে! ভাবতেই কেমন ভয়ে ভেতরটা শুকিয়ে গেল!

১০ ঘন্টার বিমান যাত্রা করে দুবাইতে এসে যখন পৌঁছালাম তখন দেখি অবস্থা আরও ভয়াবহ। শুধু মানুষের মাথা। এত বড় দুবাই বিমানবন্দর ভিড়ে ঠাসা। খুব অসুবিধার মধ্যে ১৪ ঘণ্টা বিমানবন্দরেই কাটাতে হয়েছে। ভারতের উদ্দেশ্যে যখন আমাদের বিমান ছাড়লো কিছুটা স্বস্তি বোধ করছিলাম, অন্ততপক্ষে দুবাইতে তো থাকতে হচ্ছে না। চার ঘন্টা বিমানে মাস্ক পড়েই ছিলাম। পরে জানতে পারলাম, আমাদের বিমানেই একজন কোভিড ১৯ রোগী ছিল।

হায়দ্রাবাদ বিমানবন্দরে নেমে দেখি অন্য এক চিত্র। এখানেও মানুষে মানুষে ছয়লাপ, কিন্তু সাধারণ মানুষের থেকে পুলিশের সংখ্যা বেশি। বিমানবন্দরে স্থানে স্থানে টেস্টিং এর জন্য কিউ বানিয়ে রেখেছে। সবচেয়ে প্রথমে ছিল থার্মাল টেস্টিং। এটা শরীরের জ্বর রয়েছে কিনা তা চেক করে। এই টেস্টে যদি ধরা পড়ে যে কারো শরীরে জ্বর নেই,তাহলে সে টেস্টে পাশ। পরে জানতে পারি, এই টেস্টে পাশ করার জন্য অনেকেই ওষুধ খেয়ে শরীরের তাপ কমিয়ে রেখেছিলেন।

তারপর পুলিশ বিভিন্ন টেস্টিং এর জন্য আমাদের সাহায্য করে। বিমানবন্দরে অল্প অব্যবস্থার মুখোমুখি হলেও পুলিশ কিন্তু খুব সাহায্য করেছে। আসলে এক নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়ে সামাল দিতে ওদেরও দিশেহারা অবস্থা।

এরপর একটি বাসে করে আমাদেরকে নিয়ে আসা হলো এক জঙ্গলের মধ্যে। সময়টা রাত্র, তার উপর এরকম একটা জায়গায় এসে মনের মধ্যে একটা কেমন অনুভুতি কাজ করছিল।কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ওরা আমাদেরকে স্পষ্ট করে কিছু বলছিল না।একবার বলছিল আমাদেরকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে টেস্ট করার পর ছেড়ে দেওয়া হবে। তারপর আবার আমাদেরকে হাসপাতালে না নিয়ে অন্য একটা স্থানে নিয়ে আসলো।।আমি এদিকে আগেই আমার স্ত্রী এবং বাচ্চাকে বলেছিলাম আমি যদি ঘরে ফিরিও, তবু ওরা যেন অন্য কোথাও চলে যায়।

অন্যবার হলে উদগ্রীব হয়ে থাকতাম কখন বাড়ি পৌঁছাব এবং বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরব। এবার ইচ্ছে করেই দূরে থাকতে চাইলাম। একটা ভয় মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। যাইহোক, এগিয়ে চললাম। তারপর দেখি, কোন হাসপাতাল নয়, ওরা আমাদেরকে নিয়ে এলো এক হোস্টেলে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের। হোস্টেলটা খুবই সুন্দর। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।

কিন্তু এদিকে সবাই চিৎকার-চেচামেচি শুরু করলো। পুলিশের সঙ্গে রীতিমতো তর্কাতর্কি। পুলিশ খুব ধীর স্থির ভাবে সবার প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করছিল। এদিকে প্রায় সাত ঘণ্টা ধরে খাওয়া নেই।এমনকি জল পর্যন্ত খাইনি। বাচ্চারা যারা ছিল, তারা কান্নাকাটি করছিল।

তবে হোস্টেলের ভেতরে সবকিছুরই ব্যবস্থা ছিল। একটা ঘরে দুজন কিংবা তিনজন করে থাকতে দিচ্ছিল। আমাদেরকে কোয়ারান্টিনে পাঠিয়েও শব্দটা এখানে অর্থহীন হয়ে উঠলো, যখন ঘরটা অন্য আরও একজনের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হলো। তবে থাকার ব্যবস্থাটা কিন্তু খুবই ভালো ছিল। বিছানার চাদর থেকে শুরু করে জলের গ্লাসটা পর্যন্ত সব নতুন ছিল।

তারপর আরও এক অদ্ভুত ব্যাপার হল। পুরো দিন ঘুমিয়ে যখন সন্ধ্যায় ঘুম থেকে উঠেছি, তখন দেখি হোস্টেলের প্রায় অনেকে অনুমতি নিয়ে চলে গেছে। আমরা মুষ্টিমেয় কয়েকজন রয়ে গেছি। অন্যরা নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে নিজের নিজের বাড়িতে চলে গেছে। এদিকে শোনা গেল রাত্রেই পাসপোর্ট পেয়ে যাব আমরা, যা কিনা ওরা আটকে রেখেছিল। পাসপোর্ট পাওয়ার পর আমরাও চলে যেতে পারি। কিন্তু রাত্রিবেলা বেরিয়ে আসার ইচ্ছে ছিল না। তাই ভাবলাম পরের দিনই বেরোবো। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠার পর পুলিশের পক্ষ থেকে আমাদের জিজ্ঞেস করা হয় যে আমরা আরো এখানে থাকতে চাই কিনা। খেয়াল করে দেখলাম শুধু আমরা পাঁচ ছ’জন রয়ে গেছি। এরপর আর এখানে থাকার কোন মানে হয় না। তাই চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু মনে তখনো দ্বিধা। বারবার একটা প্রশ্ন উঁকি মারছে মনের গভীরে, ঘরে ফিরবো?এদিকে এই যে দুদিন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে ছিলাম, প্রকৃতিকে বড় কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। ব্যস্ত জীবনের প্রতিদিনের দৌড়ঝাঁপ তথা যান্ত্রিক জীবন থেকে দূরে এ যেন এক অন্য জীবন!

এদিকে আমার একটি বন্ধু আমেরিকা থেকে হায়দ্রাবাদে ফিরে আসে আগের রাতে। ওরা দিল্লি হয়ে হায়দ্রাবাদ পৌঁছে। ওদেরকে কোথাও আটকানো হয়নি কারণ আমেরিকা তখনও লিস্টে ছিল না।

আমি আর বাড়ি গেলাম না। আমার বন্ধুর পরিবারকে পাঠিয়ে দিলাম আমাদের ঘরে। আর আমরা দুই বন্ধু ওর ফ্ল্যাটে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। তারপরের দিনই দেখা গেল তেলেঙ্গানাতে মোট ২২ টি কোভিড ১৯ রোগী ধরা পড়েছে।নিরাপত্তা আরো কড়া হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের ফোন পেলাম। ওরা খোঁজখবর নিতে আসছে।
পুলিশ এসে খবরা খবর নিল। ফটো তুলল। আমাকে এবং আমার বন্ধুকে বলে গেলো কোনভাবেই যেন আমরা বাইরে বের না হই। তারপর এল পুরসভার লোকজন।ওরা আমার হাতে ছাপ বসিয়ে গেল এবং নির্দেশ দিয়ে গেল ৩১ মার্চ পর্যন্ত যেন আমি আমার ঘর থেকে না বের হই।সোসাইটির অন্যদেরকেও বলে গেল, আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিস যেন ঘরেই দিয়ে দেওয়া হয় এবং কোনভাবেই যেন আমরা বাইরে বের না হই।আর কেউ যদি ৩১ মার্চের আগে আমাদেরকে বাইরে দেখে তাহলে যেন পুলিশে খবর দেয়। এরপর অনেকবারই পুলিশ এবং মিউনিসিপ্যালিটির লোকজন এসে খবরা-খবর নিয়েছে। শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চেয়েছে। এসেছে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে লোকজনও। তাছাড়া টেলিফোনে প্রতিনিয়ত আমাদের খবর নিচ্ছিল ওরা। সরকারের উদ্যোগে এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রশংসনীয়।

এই মুহূর্তে সবচেয়ে খুশির ব্যাপারটা হচ্ছে, আমার কোয়ারেন্টাইন পিরিওড শেষ হয়েছে। তাই নিজের অজান্তেই একরাশ খুশি এসে মনের গভীরে যত্ন করে বাসা বেঁধেছে, এতদিন পরে, এত ঝড়-ঝাপটার পর ঘরে ফিরব।ঘরের চার দেওয়ালের আকর্ষণ অমোঘ। তারচেয়েও বেশি পরিবারের প্রতি আকর্ষণ। তাই আমি আমার স্ত্রী এবং মেয়ের সঙ্গে মিলতে মিলতে পারব তার চাইতে বেশি খুশি আর কি হতে পারে! তবে একটা কথা সবশেষে বলবো, সময়টা সংকট পূর্ণ,পরিস্থিতি কঠিন, কিন্তু আমি নিশ্চিত, অন্ধকারের পর আলো ফুটবেই। রাতের পর সূর্যোদয় হবেই। এখন অপেক্ষা মাত্র!

Comments are closed.