জল মাটি শিকড়ের তীব্র টানে শুভঙ্করের চোখে জল, যন্ত্রণার চাপা কান্না বুকের মধ্যে গুমড়ে মরে। সেই যন্ত্রণার কথা নিয়ে দীপালি দত্ত চৌধুরীর গল্প 'জল মাটি শিকড়ের টান'
জল-মাটি-শিকড়ের টান
দীপালি দত্ত চৌধুরী
মান্তুন, ওঠ বাবা! তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে।
কোথায় বাবা?
সে পরে বলব খ’ন, দালাল তাড়া দিচ্ছে। রাত ফিকে হয়ে গেল বলে। পিতা-পুত্রের কথার মাঝেই শোনা গেল ইব্রাহিমের দরাজ গলা-
‘ কর্তা দেরি হলে আপনার সাথে আমারও জেলে ঘানি টানতে হবে।’
‘এই তো চলে এসেছে সবাই।’
মাঝি আর কর্তার তাড়ায় নিষ্প্রাণ তিনটে প্রাণী পা চালালো দ্রুত। পা চালালেও পিছুটান কি এতো সহজে ছাড়ে?
– ঠাম্মা, ঠাম্মা- দেখ তোমার ডালিম গাছটা কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল করে ফেলেছে কেমন! আর আমি যে শিউলি চারা লাগিয়ে ছিলাম কত বেড়ে উঠেছে দেখেছো? উঠোনটা সাদা সাদা ফুলে ছয়লাপ।
–হ্যাঁ, মা চালের কুমড়োগুলোও পেকে গেছে। কতদিন এগুলো নামাতে বলেছিলাম।
— ছাড়তো বউমা। কষ্টটা আমারও কি কম? তবু…….।
–এ্যাই, তোমরা পিছিয়ে রইলে, পা চালাও তাড়াতাড়ি।
— হ্যাঁ’ আসছি, আসছি।
****
মান্তুন যার ভালো নাম সায়ন্তন, তখন তার বয়স ছিল মাত্র আট বছর। বর্তমানে তার পেছনে শূন্য একটা যোগ হয়েছে। একটা নামী দামি ছাপাখানার প্রুফরিডার। মা-বাবা গত হয়েছেন বেশ কয়েক বছর হয়ে গেছে। গিন্নিও চলে গেলেন গত বছর।মান্তুন থাকে সরকারের দেয়া টালির ঘরটায়। সামনে টাইম কল। সকাল-বিকেলে সে ওখানেই পরিতৃপ্ত হয়ে স্নান করে। উঠোনে জলের পাইপ টেনে এনেছে।
***
-শুনছো! এ্যাই তোমাকে বলছি। খবরের কাগজ পড়া ছেড়ে অধ্যাপিকা বউয়ের দিকে ঘাড় ফেরায় শুভঙ্কর, সায়ন্তনের একমাত্র ছেলে।
– তোমার বাবাকে বল এইবার টালির ঘরের মায়া ছেড়ে দলিলটায় সাইন করে দিতে। কতদিন আর ভাড়াটে বাড়ির যন্ত্রণা সহ্য করা যায় বল? আজ জল নেই তো কাল ইলেকট্রিক লাইন কাটা। আত্মীয় স্বজন আসলে তো কথাই নেই।
– ঠিকই বলেছ। প্রোমোটার তো বলছে কালই সকালের দিকে আসবে ফাইনাল কথা বলতে।
ঠিক?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, হান্ড্রেড পার্সেন্ট।
শুভঙ্করের প্রেস্টিজের কথা চিন্তা করে ওর বিয়ের আগেই বাড়িটা ঠিক করে দিয়েছেন সায়ন্তন। ভাড়াটা গুনছেন এখনো তিনি।
ওদের ইচ্ছার কথা গুলো মাঝে মাঝে সায়ন্তনের কানে এসে ঠেকে। চোখ বুঁজে ভাবতে থাকেন- এই সেই ছেলে যার শেকড়ে জল মাটি দিয়ে বহু যত্ন-আত্তিতে বড় করে তুলেছেন, লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছেন শিউলি আর ডালিম গাছের মতো। হ্যাঁ, ঠাম্মা-নাতির দুটো সখের গাছ টালির ঘরের সামনেই পুঁতেছেন যেন জেদের বশেই। ওরাও তো এখন শুভঙ্করের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়বাড়ন্ত।
**
সকাল দশটা। গম্ভীরমুখে কলম হাতে তুলে নিলেন সায়ন্তন।
–এই এখানটায় সই করুন। এই দেখুন ম্যাপটা। আপনারা পাচ্ছেন দুতলা আর পাঁচ তলায় থ্রি বিএইচকে ফ্ল্যাট। দেড় হাজার স্কয়ার ফুট। এইখানে কিচেন, বেশ বড়সড়ই হবে ড্রয়িং-ডাইনিংটা। অবশ্য সবগুলো ঘরই মোটামুটি হাত-পা ছড়িয়ে বসার মত। ব্যালকনি দুটোই দিলাম, কারণ তাতে বেডরুম গুলো প্রশস্ত থাকবে। ঠাকুর ঘর তো আছেই।আর কায়দা করে তিনটা রুম করে দিচ্ছি। এবার খুশিতো?
***
দম্ দম্ দড়াম্ দম্।
ক্যাচ, ক্যাচ – করাতের আওয়াজ।
কাট, একদম শেকড় শুদ্ধ তুলে ফেল। এই ঝোপ-ঝাড়-জঙ্গল দিয়ে পুরোটা সাপ-খোপের আড্ডা করে তুলেছে। ক্যামন করে থাকত ওখানে?নেষ্টি!
শুনছেন কথাগুলো সায়ন্তন, বাড়িটা কাছে বলেই। একদম শুভঙ্করের বউয়ের কথার রিপিট।
এক একটা ইট হাতুড়ির ঘায়ে খসে পড়ছে। শব্দটা কানে এসে পৌঁছাচ্ছে। হাত চাপা দিয়েও আটকাতে পারছেন না হৃদয় বিদারক শব্দগুলোকে। দৃশ্য গুলো দেখবেন না বলেই জানলা বন্ধ করে দিয়েছেন। তবু থামছে না বুকের ভেতর শিরা-উপশিরার দপদপানি। হাঁটু মোড়া হয়ে কুঁকড়ে থেকে চোখ বুজে ভেতরের কান্না চাপতে চাপতে বলছেন এটাই তবে জল মাটি শেকড়ের টান। ডালিম-শিউলি-শুভঙ্কর- বউমা একই।
এই গল্পের লেখিকা দীপালি দত্ত চৌধুরী বরাক উপত্যকার বিশিষ্ট কবি ও কথাশিল্পী। তিনি সম্পাদনা করেছেন ‘অঙ্গীকার’ ও ‘সমাহার’ সাহিত্য পত্রিকা। পঁচিশ বছর ধরে একক প্রচেষ্টায় ‘ফুলঝুরি’ নামক বার্ষিক ছড়ার পত্রিকা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থ গুলোর মধ্যে রয়েছে স্বরলিপি মেঘ, কথাকলির বাঁক, অনুরত শব্দের ধারাস্নান কাব্যগ্রন্থ, ভুবন পেরিয়ে ভুবন, ফসলের ঋণ গল্প সংকলন, শিশু-কিশোরদের উপযোগী গল্পসংগ্রহ কথামালার হাট।
Comments are closed.