জীবনে অনেক কিছু হারিয়ে গিয়েও হারিয়ে যায় না। অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা পড়ে।সেই অদৃশ্য সুতোর বাঁধনে বাঁধা পড়া জীবনগুলোকে নিয়ে শুক্লা সাহার গল্প অকাল বসন্ত
অকাল বসন্ত
শুক্লা সাহা
ইচ্ছে ছিল না মোটেই। তবু এক প্রকার বাধ্য হয়ে তোমাকে এই চিঠি লিখছি। শুধুমাত্র কর্তব্যের খাতিরে। ও! ভুলেই গেছি একটা কথা বলতে। সম্বোধনে কোন সম্ভাষণ করতে পারিনি। কারণ- ইতর, জঘন্য, জানোয়ার ইত্যাদি বিশেষণে তোমাকে ভূষিত করতেও আমার রুচিতে বাঁধে। আর প্রিয়, প্রিয়তম ইত্যাদির বিশেষণে জগতে ভালোবাসার কতটা অপমান হবে জানিনা- তবে আমার নিজস্ব সত্ত্বার প্রচুর অপমান হবে।
হ্যাঁ, তোমার একটা জিনিস আমার কাছে রয়ে গেছে। দিল্লিতে থাক, তা জানলেও তোমার পুরো ঠিকানা জানা ছিল না- তাই পাঠাতে পারিনি। একটু আগে মৌমিতা আমাকে ফোন করে বলে যে আজ হঠাৎ নাকি তোমার সঙ্গে রাস্তায় ওর দেখা হয়েছে। তুমি জরুরি কাজে এসেছ- কাল ভোরে নাকি চলেও যাচ্ছ। সে যাক্, রান্নার মাসিকে দিয়ে এই চিঠি পাঠাচ্ছি। সন্ধ্যার পরে এসে জিনিসটা নিয়ে যেও। তখন আমি বাড়িতেই থাকব। ইতি ____।
রান্নার মাসিকে দিয়ে চিঠিটা পাঠিয়ে দিল ফুল। তারপর কতক্ষণ থম মেরে বসে ছিল। ভাবছিল মৌমিতার কথাগুলো। পরাগদাকে এখন নাকি চেনাই যায় না। ট্রেন দুর্ঘটনায় ওর বউ অনামিকা মারা গেছে। একমাত্র মেয়েটাকেও হারিয়েছে। আরও কত কথা! হঠাৎ মৌ-য়ের ডাকে ওর সম্বিৎ ফেরে। ফুলের ডিউটিতে যাবার সময় হয়ে গেছে- তাই বোধহয় মেয়েটা খুঁজছে ওকে। এই যে মাম আসছি বলে ছুটে গিয়ে ওর গাল দুটোতে চুমু খেল ফুল। অন্যদিন হলে আদরে আদরে ভরিয়ে দিত। কিন্তু এখন মাথাটা ভীষণ ধরেছে। মা এলেন ঘরে। ‘কিরে তুই কাজে যাবি না? রেডি হস্ নি যে।’
‘না গো মা, মাথাটা ভীষণ ধরেছে। ভালো লাগছেনা শরীরটা।ভাবছি আজ ছুটি নেব।’ ‘তাই কর্’ বলে রান্নাঘরে গিয়ে গরম গরম এক কাপ আদা চা করে ফুলকে দিলেন। ‘নে খেয়ে নে চটপট- আরাম পাবি। এতো খাটনি যাবে কোথায়? আরে বাবা শরীরটার ওতো একটু বিশ্রাম চাই।’ ফুল হাসপাতালে ফোন করে ছুটি নিল। তারপর গা টা এলিয়ে দিল বিছানায়। একটু ঘুমুতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু ঘুম আসছে কই?
পাশের বাড়ির দিকে তাকালো। পরাগদাদের বাড়ি। স্মৃতি- কত স্মৃতি……. এই পরাগদার সাথে সেই ছেলেবেলা থেকে বলতে গেলে এক সঙ্গে বড় হয়ে ওঠা, পড়া, খেলা, ঝগড়া, মারামারি, আচার চুরি করে খাওয়া, দুর্গাপূজায় ভোর বেলা শিউলি ফুল কুড়িয়ে পূজা প্যান্ডেলে দিয়ে আসা,অঞ্জলি দেয়া -আরো কত কি! কত তাড়াতাড়ি চলে গেল সেই দিনগুলো! আড়াই বছরের ছোট ছিল ফুল।তাই অনেক সময় পরাগ কর্তৃত্ব ফলাতো ওর ওপর। ফুল অম্লানবদনে ওর হুকুম তামিল করত। ফুলেরা তিন বোন। ভাই নেই। দু বোনের বিয়ে হয়ে গেছে বাবা বেঁচে থাকতেই। সুখের সংসার ওদের। মেজো বোনের বিয়ের বছর খানেক পর ফুলের বাবা মারা গেলেন। পরাগদার মা মাঝে মাঝেই মাকে বলতেন, ‘দিদি, তুমি ওর বিয়ের চেষ্টা করোনা। আমি ওকে আমার ছেলের বউ করে ঘরে তুলব। ফুল আড়াল থেকে শুনত আর খুব লজ্জা পেত।…….
পড়াশোনায় বরাবরই ভাল ছিল পরাগদা। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে খুব ভালো ফল করে মেডিক্যাল কলেজে ঢুকলো ডাক্তারি পড়তে। তিন-চারটা সেমিস্টারের ফলও ভালোই ছিল। তারপর থেকেই একটু একটু করে বদলে যাচ্ছিল। সারাক্ষণ কেমন যেন একটা উড়ু উড়ু ভাব। পড়াশোনায় গাফিলতি। ফুলকে এড়িয়ে চলা। নতুন নতুন বন্ধু জুটেছে। ওদের নিয়ে মাতামাতি। পরিস্থিতি জটিল হলো দেখে মেসো চাকরি পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে ওকে সময় ও সঙ্গ দিলেন। সবাই অনেক বোঝাল। কিন্তু সময়, সঙ্গ, রাগারাগি, শাসন কোনটাই কাজ দিল না। প্রথম প্রথম মুখ বুজে থাকলেও পরে ওর গলাটাও সমানে চলত। একদিন এই অশান্তি এত চরমে উঠল যে মেসোর হার্ট অ্যাটাক হল।ভর্তি হলেন হাসপাতলে। সাতদিন পর হাসপাতালেই মারা গেলেন। ফুল কি করবে বুঝে উঠতে পারেনা। দিন রাতের মধ্যে যতটুকু সময় পায় মাসিমার কাছে থাকে, দেখাশোনা করে- সঙ্গ দেয়। বুড়ো চাকর চারুদা দিন রাত কাঁদে আর কাঁদে। এরপর শুরু হল আনুষাঙ্গিক আরো কিছু।মদ ধরল। বড়লোকের মেয়ে অনামিকাকে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে এলো। অবশ্যই ওর মায়ের অমতে। অথচ এই পরাগদাই ওকে কত ভালোবাসার কথা বলেছে! এখন ফুল আর ওদিকটা মাড়ায়টা। অপমানের একটা সীমা থাকে। লোক এত নির্লজ্জ হয় কি করে ভেবে পায়না ফুল। পড়াশুনা ছেড়ে দিলো।কলেজ ছাড়ল। সারাক্ষণ চুপচাপ থাকে। কলেজের বন্ধুরা বোঝায়। এই ডামা-ডোলের মধ্যে পরাগদা একদিন চাকরি পেয়েছে বলে বৌকে নিয়ে চলে গেল দিল্লি। আঘাতের পর আঘাতে মাসিমা বিছানা নিলেন। ফুল যায়- যত্ন আত্তি করে। মাসিমা ওকে বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ি করেন। ফুল সে কথা কানে তোলে না। তিন বছর পর মাসিমা মারা গেলেন। মারা যাবার দিন পনেরো আগে একদিন একটি খাম দিয়ে ফুলকে বলেন, ‘আমার দিন ফুরিয়ে আসছে মা। যদি কোনদিন ওই হতভাগাটা ফিরে আসে, তাহলে খামটা ওকে দিস। এটা এ বাড়ির উইল। আমার দৃঢ়য়বিশ্বাস- তুই এটা ওকে দিবি। ফুল কথা দিল। এর ছ মাস পর ফুল নার্সিং ট্রেনিং-এ ভর্তি হল। ততদিনে ও অনেক শক্ত হয়েছে। ট্রেনিং শেষ হবার পর চাকরিটাও পেয়ে যায়। দিন যায়- রাত গড়ায়।
এখন মৌকে নিয়ে দিনগুলো যে কিভাবে কেটে যায় ফুল টেরই পায় না।মা আর মৌকে নিয়ে বাড়িতে সে খুব ভালো আছে। মৌকে পড়ানো, খাওয়ানো, স্নান করানো সবকিছু সে নিজের হাতেই করে। একটাই দুঃখ মৌ কথা বলতে পারেনা। কত ডাক্তার দেখালো। ভোকাল কর্ডে কোন গোলমাল নেই আর কানেও শুনতে পায়, তাই হয়তো কথাও বলতে পারবে একদিন- সব ডাক্তারের একই অভিমত। তবে ফুলও খুব চেষ্টা করে ওকে কথা বলাতে। এখন একটু একটু কথা বলতে পারে। আরো চেষ্টা করবে ফুল। আরও আরও। এই মৌকে নিয়ে কত আশা ওর- কত না স্বপ্ন। দুবছর হলো ওকে স্কুলে ভর্তি করেছে। গেল বছর কত ভালো ফল করেছে মৌ। এবারে আরো ভালো কল করবে এ বিষয়ে নিশ্চিত ফুল। একবারও মনে হয় না মৌ তার নিজের নাড়ি ছেঁড়া ধন নয়। বছর তিনেক আগে ও যখন মাকে নিয়ে হরিদ্বারে বেড়াতে গেছিল তখন স্টেশনের পাশে এক দোকানের সামনে শিশুটিকে দেখে ছিল। মেয়েটি অঝোরে কাঁদছিল। জিজ্ঞেস করায় দোকানের লোকটা বলেছিল, ক দিন আগের এক মর্মান্তিক ঘটনা। বড় দুঃখজনক।সেটি ছিল বাবা মাকে হারানোর এক করুণ ঘটনা!
এরপর ফুল ওর কেউ নেই দেখে মেয়েটিকে নিজের কাছে এনে রেখেছে। অনাথ আশ্রমে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু মেয়েটি যাবে না। কি কান্না- কি কান্না! হঠাৎ শাখের শব্দে ভাবনায় ছেদ পড়ে। কখন দুপুর গড়িয়ে গেছে বুঝতেই পারেনা।……..
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। মা এসে দরজা খুলে অবাক হয়ে ওখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ফুল এসে ঘরে ঢুকে। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে পরাগদা। একি কঙ্কালসার চেহারা হয়েছে ওর! গালগুলো বুড়ো মানুষের মতো তুবড়ে গেছে। কন্ঠার হাড়গুলো কি বিশ্রিভাবে বেরিয়ে আছে! কিছু না বলে ফুল এগিয়ে এল। মাসিমার খামটা হাতে দিল। পরাগ খামটা খুলে দেখে ওদের বাড়ির উইল। কয়েক সেকেন্ড! তারপর কাগজটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলে বলে- এতে আমার কোন অধিকার নেই। চলি। হ্যাঁ, একটা কথা- যদি পারো আমাকে ক্ষমা করে দিও বলে পেছন ফেরে। ঠিক ওই মুহূর্তে কোথা থেকে মৌ পা…..প্পা…….ই বলে ছুটে এসে পরাগকে জড়িয়ে ধরে। একি? দিয়া তুই? তুই কি করে…… আর বলতে পারেনা। গলা রুদ্ধ হয়ে আসে। পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে মউকে আদর করতে থাকে। ততক্ষনে ফুলের চোখ পরাগের ডান হাতের দিকে। পাঞ্জাবির ডানহাতটা ঝুলছে। তাহলে কি সেই অ্যাক্সিডেন্টে ওর ডানহাতটা…… আর ভাবতে পারেনা ফুল। মাথাটা ঘুরে যায়। ধপ করে পাশের চেয়ারে বসে পড়ে। যুগপৎ ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই স্তব্ধ-বিমূঢ়। কিছুক্ষণ পর পরাগ উঠে দাঁড়ায়। গেটের দিকে এগোতে থাকে। হঠাৎ পাঞ্জাবির কোনায় টান পড়তে ফিরে তাকায়। ফুল বলে, কোথায় যাচ্ছ? ঘরে এসো। এসো বলছি। আদেশের সুর। গলায় অদ্ভুত দৃঢ়তা। মাথা নিচু করে ভয়ে ভয়ে পরাগ পা বাড়ায়। ঘরের দিকে।
এই গল্পের লেখিকা শুক্লা সাহা বর্তমানে পুনে বসবাস করলেও মূলত শিলচরের বাসিন্দা। দৈনিক সোনার কাছাড় সংবাদপত্রের সাংবাদিকা তথা একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। জড়িত ছিলেন আকাশবাণী শিলচরের সঙ্গেও। দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখিকার গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে।
Comments are closed.