নস্টালজিক বাঙালি: মাতৃ আরাধনার এই কটা দিনে জটিলতার আবর্ত থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস কুড়িয়ে পাবে
নস্টালজিয়া। শব্দটা খুবই ছোট। কিন্তু জীবনের গভীরের সদর্থে এর ব্যপ্তি অনেক। যে আলোচনা পরে আসছে। বোধকরি পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছেন- যারা কম-বেশি নস্টালজিক। কারণ বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জীবনেই অতীতের সুখ, দুঃখ, ব্যথা, বেদনা, আনন্দের স্মৃতি থাকে। পরিণত বয়সের অবসর মুহূর্তে সেগুলি একবার না একবার এসে মনকে নাড়া দেয় অর্থাৎ স্মৃতিচারণা যাকে বলে। তবে হ্যাঁ, দেশ, জাতি পরিবেশ, পরিস্থিতি, আবহাওয়া সর্বোপরি মানসিকতা হিসেবে এর মাত্রাও ভিন্ন ভিন্ন। এই নস্টালজিয়া শব্দটির মানে হল- বেদনা,অতীতের কোনো কিছুর প্রতি নিবিড় টান, স্মৃতি রোমন্থন ইত্যাদি। ইংরেজিতে এর মানে – Sentimental longing or wishful affection for a period in the past(oxford dictionary)। অবশ্য এটাকে এক ধরনের মানসিক অসুখও বলেন অনেকে। এখানে বক্তব্য একটাই। যেকোনো জিনিস নিয়ে অহেতুক বাড়াবাড়ি করাটা মানসিক অসুখের পর্যায়ে পড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে তা ঘটেও। কিন্তু তা বলে শব্দটির তাৎপর্য পুরোপুরি একতরফা বলে মেনে নেওয়া কঠিন। কারণ যদি শুধুমাত্র অক্সফোর্ড অভিধানের মানেই বিশদে আলোচনা করা যায়- তাহলে শব্দটির সত্যতা প্রমাণিত হবে।
অতীতের প্রতি সঠিক আকর্ষণ অথবা অতীত আর্তি যে জনজীবনে কতটা ফলপ্রদ হতে পারে তার প্রমাণ হলো এই দেশ- ভারত বর্ষ। এখানে ‘নানা ভাষা’ নানা মত’ নানা পরিধান’ সত্বেও ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’। অর্থাৎ বিভিন্নতার সহাবস্থান। যার মূল কারণ হলো ধর্ম। ধর্ম- মানে যা ধারণ করতে হয়- যা একসূত্রে এক-একটি জাতিকে বেঁধে রাখে। এখানে সবাই যে যার ধর্মকে ধারণ করে আছে। বাঙালিরাও এর ব্যতিক্রম নন।বাঙালিদের ভালোবাসার জিনিস আছে অ-নে-ক। তারমধ্যে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্ল রায়, সুভাষচন্দ্র,ক্ষুদিরাম, চুনী গোস্বামী, সৌরভ গাঙ্গুলি প্রমুখ সহ নান্দনিক সকল অনুষ্ঠান। মাছ মিষ্টি সহ আরো কত কিছুর নাম করতে হয়। কিন্তু এর মধ্যে অন্তরের টান সবচেয়ে বেশি বাঙালির দুর্গোৎসবে। তাই এ পুজোর আকর্ষণ বাঙালির সব ভালোবাসার জিনিসকে ছাপিয়ে গেছে। এর পেছনে আছে অনুপম ভক্তি-ভাবনা সহ ভালো থাকার আকুল আর্তি। আর আছে বিশ্বজনীন প্রেমের আভাস। কারণ পুজোয় জাতি-ধর্ম, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের জন্য অবারিত দ্বার। প্রাচীন ভারতের সত্যদ্রষ্টা ঋষিমুনিদের উপলব্ধ ‘সনাতন ধর্ম’- যা চিরন্তন সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত- সেই ধর্মের এক অঙ্গ মাতৃ আরাধনা বা শক্তি পূজা। জাগতিক নিয়মে এক শিশু যখন ভূমিষ্ঠ হয় তখন সে শুধু এই জগত সম্পর্কেই নয় সব বিষয়েই অনভিজ্ঞ থাকে। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যে অজানা এক সহজাত বোধ বা চেতনা দিয়ে প্রথমে সে তার মাকেই চিনতে পারে, তাই তাকে আঁকড়ে ধরে সে তার নিরাপত্তা খুঁজে। ধীরে ধীরে বড় হয়েও সে অনুভব করে মায়ের কোলই তার পরম নির্ভরতার স্থান।তাই হিন্দুধর্মে ‘মা’ এক অফুরান শক্তির ভান্ডার। তিনি একাধারে সৃষ্টি রূপিনী, শক্তিদায়িনী, মঙ্গলকারিণী এক অভয়া মূর্তি। এতো গেল পার্থিব দিক। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে যিনি সৃষ্টি করেছেন স্বাভাবিক ভাবেই তিনি সকলের মা। এই প্রকৃতি, গাছপালা, ফলমূল, নদ নদী, সাগর, পর্বতমালা, পশুপাখি, জীবজন্তু, মানুষ ইত্যাদি সকল কিছুর মধ্যে যিনি প্রাণস্পন্দন জাগিয়েছেন-সেই আদ্যাশক্তি যে সবার মা। তাইতো সকলেই তার কাছে নিরাপত্তা খোঁজে, আশ্রয় মাগে। তাঁর বন্দনা করে, পূজা করে।
দারিদ্র, দৈনন্দিন একঘেয়েমি, সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে টিকে থাকার নাভিশ্বাস লড়াইয়ে এই দুর্গাপূজা এনে দেয় এক ঝলক মুক্তির আস্বাদ। তথা বেঁচে থাকার আনন্দ। যে আনন্দ তার মনে ছেলেবেলার স্মৃতি জাগিয়ে তোলে। মনে পড়ে যায় মহালয়ার ভোরের সেই অনাবিল আনন্দের সোনালী দিনগুলো। সেই কাকভোরে উঠে ঢুলুঢুলু চোখে বিশাল পরিবারের একটা ব্যস্ততা দেখা- পাশে বসে রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের আগমনী আবাহনের উধাত্ত কন্ঠের মন্ত্রোচ্চারণ শোনা – মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়া আবার জেগে ওঠা- মায়ের ধূপকাঠি জ্বালিয়ে ঘরে ঘরে দেখানো- আবার তারই ফাঁকে বড়দের একটু চা পান- মুহূর্তে বাঙালিকে নিয়ে যায় এক মায়াময় অপার্থিব পরিবেশে। তখন আকাশে বাতাসে সর্বত্র যেন এক পবিত্র ভাবের আবেশ। প্রকৃতি যেন কানে কানে বলে ‘মা আসছেন’। নির্মেঘ সোনা ঝরা রোদের দিনগুলোতে আগমনীর আবাহনের সুর বাজে। কাশবন মাথা হেলিয়ে দুলিয়ে মাকে যেন অভ্যর্থনা করে। শিউলি গাছ তার ফুলগুলো দিয়ে যেন মায়ের আসার পথটাকে সাজিয়ে দেয়। জল-স্থল পদ্ম যেন ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠে মাকে সাজানোর জন্য। সবমিলিয়ে একরাশ আনন্দের হাতছানি। বাঙালি নব উদ্যোমে জাগে। মায়ের পূজার আয়োজনে ব্যস্ত হয়। আনন্দময়ী মাকে প্রসন্ন করতে সবাই একসাথে মনের আকুল আর্তি জানায়–
দেবী প্রপন্নার্তি হরে প্রসীদ
প্রসীদ মার্তজগতোহখিলস্য
প্রসীদ বিশ্বেশ্বরী পাহি বিশ্বং
ত্বমীশ্বরী দেবি চরাচরস্য।
বলাই বাহুল্য জগন্মাতার কাছে এই আকুল প্রার্থনায় সংকীর্ণ ‘আমি’ নেই, আছে ‘আমরা’। অর্থাৎ সমগ্র বিশ্ববাসীর ত্রাণের কথা। সকলের দুর্গতি নাশের জন্য শক্তি লাভের প্রার্থনা। এ ব্যাপারে নস্টালজিক বাঙালি এক এবং অদ্বিতীয়। আসলে অন্য কথায় বলা যায় তারা এই জীবনেরই জয়গান করে। কারণ মানুষের জীবনে সুখ দুঃখ, হাসি কান্না, সাম্য বৈষম্য, দিন-রাত, আনন্দ-বেদনা থাকেই। আর থাকবেও। তা না হলে সৃষ্টি যে বাঁচেনা। সাগরের এক ঢেউ ভেঙে গেলেই অন্য ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়। একটা আছে বলেই অপরটি থাকার সার্থকতা। তাই জীবনের জয়গান করা তখনই সম্ভব- যখন প্রতিকূল পরিস্থিতিকে অস্বীকার করে অদম্য মনোবল আর সাহস নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকার লড়াই করে। বর্তমান পরিস্থিতির কথাই ধরা যাক। চারিদিকে ব্যস্ত জীবনের হতাশার ক্লান্তি, পারিবারিক বিশৃঙ্খলা, সামাজিক- রাজনৈতিক চাপান-উতোরের লড়াই, অবুঝ শিশুদের শৈশবকে ছিনিয়ে প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে সামিল করা ইত্যাদি ছাড়াও আছে চারিদিকে করোনা রোগের মারাত্মক দাপট। অন্যান্য মারণ রোগতো আছেই। এ সব কিছুকে অগ্রাহ্য করে এবারও বাঙালি মাতৃ আরাধনার জন্য প্রতিবারের মত তৈরি হচ্ছে। হয়তো এবারে কিছুটা খামতি থেকে যাবে-তবু মায়ের পুজো তো হবে। আর হলোই-বা মাত্র পুজোর কটা দিন। কিন্তু এই বা কম কিসে! জটিলতার আবর্ত থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস- এই ক’টা দিন যে কোন অংশে কম নয়। এটাতো জীবনেরই জয়গান। বেঁচে থাকার আনন্দের জয়গান। সে দিক থেকে নস্টালজিক বাঙালি কথাটা সার্থক। তবে সদর্থে ও সঠিকভাবে নস্টালজিক হলেই জাতির মঙ্গল তথা বিশ্বের মঙ্গল।
(এই প্রবন্ধের লেখিকা শুক্লা সাহা বর্তমানে পুনে বসবাস করলেও মূলত শিলচরের বাসিন্দা। দৈনিক সোনার কাছাড় সংবাদপত্রের সাংবাদিকা তথা একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। জড়িত ছিলেন আকাশবাণী শিলচরের সঙ্গেও। দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখিকার গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে।)
Comments are closed.