মনের মানুষের ভালোবাসা ফিরে পেতে তৃষার মরিয়া হয়ে উঠার গল্প ঋতা চন্দের পাসওয়ার্ড
পাসওয়ার্ড
ঋতা চন্দ
-পাসওয়ার্ড ভুলে গেছিস ? লিঙ্কটা খুলতে পারছিস না ? লিখে রাখিস না কেন ?
– রেখেছিলাম তো ! কোথায় লিখে রেখেছিলাম, এখন কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না।
-মেসেজগুলো ডিলিট করিস না তো, তাই দু’দিন পরপর তোর মেমরি ফুল হয়ে হ্যাং হয়ে যায় নয়ত ব্লক হয়ে যায়।
-“হ্যাঁ। এইজন্যই ত রিপেয়ারিং-এ দিয়েছিলাম।ছেলেটা কাজ জানে না। সফ্টওয়্যার ভরানোর নামে আমার হোয়াটসঅ্যাপ,ফেসবুক সব উড়িয়ে দিয়েছে। এখন আমাকে বাঁচা।” কাঁদো কাঁদো হয়ে তৃষা বলে শ্রেয়াকে।
শ্রেয়া কিছুক্ষণ ওকে ক্ষ্যাপায়। -তোর দেখি একেবারে প্রাণ যায় যায় অবস্থা।বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাটিং করতে পারছিস না বলে ?এতোই এডিক্টেড হয়ে গেছিস ?
তৃষার হ্যাণ্ডসেটটা একটু টাফ। সহজে হ্যাণ্ডলিং করতে পারে না। আসলে কম্পিউটার নিয়ে পড়াশোনাও করা হয়ে ওঠে নি। এবার ঠিক একটা কোর্স করে নিতে হবে।
শ্রেয়া অনেক এক্সপার্ট। সে-ই ওকে অ্যাপগুলো খুলে দিয়েছে। তাই ওর খোঁচাটা গায়ে না মেখে সকাতরে বলে–না রে, বন্ধু টন্ধু নয়। অনেক ইম্পরট্যান্ট মেসেজ আসে, সময়মত রিপ্লাই দিতে না পারলে অফিসেও কথা শুনতে হয়, সবাই বলে নতুন ফোন কিনতে। কিন্তু আমি এটা ছাড়বো না। ক্যামেরাটাও কত ভালো। তাছাড়া এটা ত নতুনই।
অগত্যা শ্রেয়া বলে, ‘নতুন করে একাউন্ট খোল। নতুন পাসওয়ার্ড দিচ্ছি। লিখে রাখিস।’ সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে দেছে দেখে তৃষা খুশিতে চকাস করে চুমু খায় শ্রেয়ার গালে। ছিটকে সরে গিয়ে গাল মুছতে মুছতে শ্রেয়া বলে- ‘অত আদিখ্যেতায় কাজ নেই। আমি ত লেসবিয়ান নই। ওসব তোর বয়ফ্রেন্ডের জন্যে তুলে রাখ।’
তৃষা লজ্জা পায়।–কি যে বলিস না ! তুই ত আমার প্রাণের বন্ধু। ফোনটা কদ্দিন ধরে খারাপ হয়ে ছিল ,জানিস ! তোর জন্যেই আবার ফিরে পেলাম সবকিছু। তাই একটু কৃতজ্ঞতা জানালাম। জানিস ত ছেলেবন্ধু সম্পর্কে আমার একটু ছুঁচিবাঈ রয়েছে। বিয়ের আগে কাউকে ছুঁতেই দেব না।
-তোর আর হবেও না।
-ঈস্ ! এতোই ফ্যালনা ভাবিস আমায় ! দেখিয়ে দেবো । একদম ট্যারা হয়ে যাবি সেদিন।
-সে নাহয় ট্যারাই হলাম। আগে তো একটা প্রেমিক জুটিয়ে দেখা।
শ্রেয়া জানে তৃষার জীবনে কেউ এলে সবার আগে ওকেই জানাবে।
শ্রেয়া বেশ কিছুদিন হল কর্মসূত্রে অন্য জেলায়। অনেকদিন দেখা হয় না। কথাও কম হয়। মাঝে মাঝে হোয়াটসঅ্যাপে- ফেসবুকে কথা হয়। কিছুদিন থেকে তৃষাকে একদম অনলাইনে দেখা যাচ্ছে না। চিন্তায় পড়ে শ্রেয়া কল করে।— কি রে, হল কি তোর ? একদম সাড়াশব্দ নেই !
–আমার সব শেষ হয়ে গেছে রে !কান্নায় গলা বুজে আসছে তৃষার। কথা বলতে পারছে না।
–সেকি রে ! কী হয়েছে ? আবার ফোনটা খারাপ হয়েছে ? হোয়াটসঅ্যাপ লক হয়ে গেছে ? কতবার বলছি, সেটটা পাল্টে নে। নতুন একাউন্ট খোল।
–কী বলছিস তুই ! নতুন একাউন্ট খুলবো ? আমি আর কিছুতেই পারবো না রে। একদম বরবাদ হয়ে গেলাম।
— কী ফ্যাঁচ্ ফ্যাঁচ্ করছিস ? বোগাস একটা জিনিস নিয়ে পড়ে থাকবি ? ঠিকমত সার্ভিস পাচ্ছিস না তবু ওটা নিয়েই পড়ে থাকবি ? এতো মায়া ! এমনভাবে কাঁদছিস যেন ওটা তোর বয়ফ্রেন্ড। ওকে ছাড়া থাকতে পারবি না।
–ওরে শ্রেয়া রে, কি নিষ্ঠুরের মত কথা বলছিস ! তুইও শেষপর্যন্ত আমার সঙ্গে শত্রুতা করছিস? এতো সহজ ! বললেই হল পাল্টে নেবো! তুই পারবি নীলাঞ্জনকে ছেড়ে দিতে ?
–নীলাঞ্জনের কথা আসছে কেন ? শ্রেয়া আকাশ থেকে পড়ে। হচ্ছে তোর মোবাইলের কথা। ওটা কি তোর বয়ফ্রেণ্ড ?
–তবে আর বলছি কি ? এমনি এমনি কাঁদছি নাকি ? আমাকে একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছে। আজ দশদিন হল একটা মেসেজেরও জবাব দিচ্ছে না। ফোন করলে কেটে দিচ্ছে নয়ত সুইচড অফ দেখাচ্ছে।আগে রিপ্লাই দিতে দেরি হলে কল করে করে অস্থির করে তুলতো।এখন দ্যাখ, বেঁচে আছি কি মরে গেছি একটুও যদি খোঁজ নিতো !
–সেকি রে তৃষা,এতোসব কবে হল ? কে সে ? নামটা বল ? তোর মত মেয়েকে ধোঁকা দেয় ! কোনো খোঁজখবর না নিয়ে মনপ্রাণ দিয়ে দিলে এরকমই হয়। আমাকে একবার জানাবার প্রয়োজন মনে করিস নি। শ্রেয়া রাগ করে বলে।
–তুই কোথায় ছিলি শ্রেয়া ? ভেবেছিলাম তোকে সারপ্রাইজ দেবো। সব শেষ হয়ে গেল।
আমি বাঁচবো নারে। মরেই যাবো।
— রাখ তোর ন্যাকামি। মারবো এক থাপ্পড়।মরে যাবি ! এত সস্তা জীবন ! কী এমন রাজপুত্তুর যে তার জন্যে মরে যেতে হবে ? মনের সাথে আর কি কি দিয়েছিস যে সর্বহারার মত করছিস ? শ্রেয়া এবার সিরিয়াসলি উদ্বিগ্ন হয়।
–আর কি দেবো ? তুই চিনিস না আমাকে ! গায়ে টাচ পর্যন্ত করতে দিই নি। কী ভালো ভালো কথাই না বলতো ! বলতো আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। আমাকে না পেলে নাকি মরেই যাবে ! আর এখন দেখ্ ,সে-ই আমাকে বিট্রে করলো এমন ! ও আর বোধহয় আমাকে ভালোবাসে না রে।
–বেশ হয়েছে সে গেছে। ও কক্ষণোই তোকে ভালোবাসে নি। তোর টেস্ট নিচ্ছিলো। তুই বোকা, তাই বিশ্বাস করেছিস। যাক গে। ওকে ভুলে যা।
–না না। আমি পারবো না।ওকে ভুলতে পারবো না কিছুতেই। আমি শুধু ওকেই চাই। তুই আমাকে বাঁচা। তৃষা সকাতরে বলে।
— হাউ ফানি ! আমি কি করে বাঁচাবো ? আমি কি ওকে চিনি ? তুই নিজেই চিনিস না, জানিস না,প্রেমে পড়ে গেছিস। তবু ভাগ্য ভালো যে বিয়ের আগেই সরে পড়েছে। বিয়ের পর ধোঁকা দিলে কি হত বল দেখি ? ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দে। খুব জোর বেঁচে গেছিস ওই ফেক প্রেমিকের পাল্লা থেকে।
— নারে না। ও ফেক নয়। ফেসবুক ফ্রেন্ডও নয়। তুইও চিনিস ওকে।
–তাই নাকি ? কে বলতো ?
–বোধিসত্ত্ব।
— ও বুদ্ধু ! চেঁচিয়ে ওঠে শ্রেয়া। —ও তো বরাবরই তোর জন্য ফিদা ছিল। বাট তুইই পাত্তা দিস নি। তা হঠাৎ চাল পাল্টে গেল কি করে ? নিশ্চয়ই বদলা নিচ্ছে। বাট, ও তো সেরকম ছেলে নয় !
–তাই ত বলছি। ও একদমই বাজে ছেলে নয়।অনেক ভেবেচিন্তেই ওকে হ্যাঁ করেছিলাম। সব ঠিকঠাক ছিল। তারপর—-তারপর—-সব আমার দোষ। আমারই ভুল। ও আমার উপর অভিমান করেছে। না না। খুব রাগ করেছে। ও আর ফিরবে না আমার কাছে। কিন্তু আমি ওকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারি না আজকাল।
কিছু একটা কর শ্রেয়া। আমাকে তুই বাঁচা।
–হুঁ, বুঝেছি। কেস একেবারে জণ্ডিস করে ফেলেছিস।যাকে এতদিন পাত্তা দিস নি , এখন সে পাত্তা দিচ্ছে না বলে একেবারে জীবন মরণ সমস্যা হয়ে গেছে। না ভাই, আমি এসবের সমাধান করতে পারবো না। ওই লিঙ্কটা তোমার তৈরি। যে পাসওয়ার্ড দিয়ে একাউন্ট খুলেছিলে ওটা তোমাকেই খুঁজতে হবে।
— কীসব উল্টোপাল্টা বকছিস ?
তৃষা একটু থমকায়। পাসওয়ার্ড–লিঙ্ক–একাউন্ট—! ফোনটা দু’তিনবার ঠিক করে দিয়েছিল শ্রেয়া। সেই ভাষাতেই কথা বলছে। তবে খুব একটা ভুল বলে নি। এই লিঙ্কটা তৃষারই তৈরি। মীমাংসা ওকেই করতে হবে। ভাবছে তৃষা। বোধিসত্ত্বের এত দীর্ঘকালের প্রতীক্ষা। অন্য আর কাউকেই মনে জায়গা দেয়নি সে। তৃষার থেকে গ্রীণ সিগন্যাল পেয়ে একেবারে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল। এতো ভালোবাসা মিথ্যে হবার নয়। সে অভিমান করেছে। প্রচণ্ড অভিমান। তৃষা অন্যায় করেছে ওকে সন্দেহ করে। অবিশ্বাস করে। বোধিসত্ত্বের মান ভাঙাতে হবে যেমন করে হোক। ওকে ফেরাতে হবে নিজের কাছে। কিন্তু কীভাবে?
পাসওয়ার্ডটা মনে মনে খুঁজতে থাকে তৃষা।
এই গল্পের লেখিকা ঋতা চন্দের জন্ম এবং বর্তমান কর্মস্থল হাইলাকান্দি শহর। পেশায় শিক্ষিকা হলেও নেশা জুড়ে রয়েছে গল্প কবিতা ও নাটক লেখার তাগিদ। লেখিকার গল্প-কবিতা বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
Comments are closed.