Also read in

One day trip to Jiribam, you can also visit.

ছোট শ্যালিকা দিল্লি থেকে এসেই আবদার করল, “এবার কিন্তু কাছেপিঠে নতুন কোন একটা জায়গা আমাদের দেখাতে হবে।” প্রত্যেকবারই বাচ্চাদের পরীক্ষার শেষে এমন সময় ‘দেশের বাড়ি’, শিলচরে আসে। বিগত বছরগুলোতে বরাকের প্রায় সবগুলো চা বাগান, খাসপুর, হাইলাকান্দির বাস্বাবাড়ি, সুতারকান্দি সীমান্ত, এরকম কাছেপিঠে যতটুকু জায়গায় যাওয়া যায়, তা দেখা হয়ে গিয়েছে। তাই এবার চিন্তায় পড়া গেল।

অনেক ভেবে চিন্তে কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে আমাদের কাছাড় জেলার সীমান্ত শহর মনিপুরের জিরিবামে যাওয়ার চিন্তা ভাবনা করলাম। ঝুঁকি কারণ, জিরিবাম সম্বন্ধে আমার কিছুই জানা ছিল না‌। আর মনে মনে ঠিক করেছিলাম, গুগোলকে জিজ্ঞেস না করেই এবারের সফরটা সম্পন্ন করব।

দলে দুই শ্যালিকা এবং আমার নিজের পরিবার এবং পরিচারিকাদের নিয়ে প্রায় পনেরো জন। ছোট গাড়ি নিলে দুটো নিতে হবে, সবাই এক গাড়িতে না গেলে মজাটা কমে যাবে। তাই আই এস বি টি চত্বর থেকে একটা ট্রাভেলার মিনিবাস নেওয়া হলো। সেখানে খাবারদাবার কেমন পাওয়া যাবে জানা নেই, তাই একটু টিফিনও সঙ্গে নিয়ে নেওয়া হলো।

শহর ছাড়াতেই নবনির্মিত চার লেনের সুদৃশ্য রাস্তা। মহাসড়ককে বা পাশে রেখে শিলচর ইম্ফল জাতীয় সড়ক ধরে এগিয়ে চলল গাড়ি। এই রাস্তাও বেশ ভালো, কিছুদিন আগেও এই রাস্তায় যেতে রাস্তার মধ্যে রাস্তা খুঁজতে হতো। ৭০-৮০ কিলোমিটার বেগে অবলীলায় চলছে গাড়ি। বাঁশকান্দি, পয়লাপুল পেরিয়ে যাওয়ার পর প্রকৃতি আমাদের কাছে এসে গেল। ছোট ছোট পাহাড়, চলছে আনারসের চাষ । আনারসের খেত দেখেই সবাই নেমে আরো কাছে থেকে দেখতে চাইল, আনারস গাছকে সঙ্গী করে সেলফিও তো তুলতে হবে । আসলে, আমাদের এত কাছে আনারসের চাষ হয়, কিন্তু আমরা আজও এই আনারস ক্ষেত দেখিনি, এটা ভেবে একটু হীনমন্যতায় ভোগলাম। আমাদের আশেপাশে এত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, কিন্তু আমরা সেটার খবর রাখি না। কোন একটা নগরের কৃত্রিমভাবে তৈরি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে সুদূর চলে যাই। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এরকম, “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে দুইপা ফেলিয়া, একটি ঘাসের শিষের উপর একটি শিশির বিন্দু”।

যাক, আনারসের চাষবাস দেখে সবাই খুব খুশি। আবার জিরিবামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। বরাকের উপনদী জিরি কাছাড় এবং মনিপুরকে আলাদা করেছে, এপাশে জিরিঘাট- ওপাশে জিরিবাম। দুদিকেই রয়েছে দুই রাজ্যের নিজস্ব পুলিশ চৌকি।

মনিপুর রাজ্যে প্রবেশের মুখে সন্দেহবশত ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার গাড়ির কি মনিপুর রাজ্যে ঢোকার পারমিট আছে? ড্রাইভার জানালো , না নেই, তবে জিরিবামে ঢুকলে কিছু হয় না। আমরাও দেখলাম কাছাড়ের অটোরিকশা ও অন্যান্য ছোট যানবাহন গুলো চলছে নির্দ্বিধায়।

মনিপুর রাজ্যে ঢুকেই স্বাধীনতা সংগ্রামী জননেতা হিজাম ইরাবত সিংয়ের স্ট্যাচু। ইরাবত সম্বন্ধে বলা হয়ে থাকে যে, তিনিই ঘুমন্ত মণিপুরকে জাগিয়ে তোলেন। ইরাবতের নেতৃত্বেই ‘মণিপুর কৃষক সম্মেলন’ গঠিত হয়। কৃষকদের ওপর ধর্মীয় কর চাপানোর বিরুদ্ধে ইরাবত আন্দোলন চালিয়েছিলেন। আমাদের এই কাছাড় জেলায় তাকে অনেক দিন থাকতে হয়েছিল।

স্ট্যাচু পেরিয়ে ডানদিকে রেল স্টেশনের রাস্তা। জিরিবাম স্টেশন নিয়ে আমাদের উৎসাহ থাকতেই পারে। কারণ শিলচর থেকে অরুণাচল, নিউ শিলচর, ময়নারবন্দ হয়ে মনিপুরের প্রথম রেলওয়ে স্টেশন জিরিবাম। এই লাইন ধরেই ইম্ফল পর্যন্ত যাবে ট্রেন কিছুদিনের মধ্যেই। তারপর, পরিকল্পনা অনুযায়ী এই রেলওয়ে লাইন পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হবে। এই লাইন ধরে এগোলেই পাওয়া যাবে বিশ্বের সব থেকে উঁচু রেলব্রিজ যা তৈরি হতে চলেছে মনিপুরের ইজাই নদীর ওপর । এই রেলব্রিজের উচ্চতা হবে ১৪১ মিটার (বর্তমানে ১৩৯ মিটার উঁচু একটি রেলব্রিজ রয়েছে ইউরোপের মন্তেনেগ্রোতে ); কাজ চলছে পুর্নোদ্দমে।

ষ্টেশনে চা খাওয়ার মজাটাই আলাদা, জিরিবাম স্টেশনে পৌঁছানোর আগেই চায়ের স্টলের মত দেখা গেল, চায়ের তেষ্টাটাও যেন বেড়ে গেল। স্টেশনে পৌঁছে আক্কেলগুড়ুম। পুরো স্টেশন চত্বরেই সেনাবাহিনীর ছাউনির মত রয়েছে। নির্বাচনী প্রস্তুতি কিনা, সশস্ত্র প্রহরীকে সাহস করে জিজ্ঞেস করলে সে জানালো, অনেক দিন ধরে ওরা এখানে আছে। মাঝেমধ্যে ট্রেন আসলেও যাত্রী খুব কম এবং তারা স্টেশনে দাড়ায় না। তাই স্টেশন চত্বরে কয়েকটা ছবি তুলে সবাইকে ফিরতে হলো।

সেখান থেকে জিরিবাম বাজারে এসে চায়ের তেষ্টা মেটাতে হলো। অন্যরা যে যার মত চিপস, মিষ্টি, ঠান্ডা পানীয় নিল। ভাবছি, এবার কোথায় যাব । গাড়ির পার্কিং ফি নিতে আসা লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম এখানে দেখার মত কি কি আছে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে জানালো এখানো দেখার মত তেমন কিছুই নেই। আমি বললাম যে, একটা পার্ক আছে, শুনেছিলাম, সেটা কোথায়। “পার্ক একটা আছে তবে সেটা তেমন কিছু নয়, এখান থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূর। গোলারথল বাজার থেকে ডান দিকে যেতে হবে”, জানালেন সেই মনিপুরী ভদ্রলোক।

আর যখন তেমন কিছু দেখার নেই, তবে পার্কেই যাওয়া যাক, কিন্তু গোল বাঁধালো ড্রাইভার। এই গাড়ি তো মনিপুরের আর ভেতরে যাবেনা, দৃড়ভাবে জানালো সে। আমার দিল্লি প্রবাসী ভায়রাভাই উত্তেজিত হয়ে বলল, সেটা আমরা জানিনা, তোমাকে যেতেই হবে। ওকে পিছন দিকে পাঠিয়ে আমি ড্রাইভারের পেছনের সিটে বসলাম, আর মোলায়েম ভাবে বললাম, দেখো, কিছুই তো দেখা হলো না, তা একটু এগিয়ে গিয়ে শহরটা একটু দেখে নেই। ড্রাইভার নিমরাজি হয়ে এগোতে শুরু করল। স্থানে স্থানে মাঠের মধ্যে খেলা চলছে- মজার মজার খেলা। এক জায়গায় দেখলাম প্রায় পঁচিশ ফুট উঁচু একটা কলা গাছ পুঁতে রাখা হয়েছে, ডালপালা ছেঁটে। বাচ্চাদেরকে ওই কলা গাছ বেয়ে উপরে উঠতে হবে, যে সবচেয়ে বেশি উপরে উঠবে সেই প্রথম পুরস্কার পাবে। মজাদার খেলা, কিন্তু দাঁড়াবার সময় তো নেই। এছাড়া চিরাচরিত খেলাও চলছে – ওদের কোন একটা উৎসবের দিন হবে মনে হল। ছেলেদের থেকে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। ছোট্ট ঋক বলে উঠল ‘হ্যাঁ, এটাই তো মেরি কমের দেশ’। সত্যিই তাই, মনিপুর থেকে এতো খেলোয়াড় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে স্থান পায় কি করে আমরা বুঝতে পারলাম।

শিলচরের নাম্বার প্লেটযুক্ত ছোট যানবাহন, অটোরিকশা আসা-যাওয়া করছে। যেতে যেতে গোলারথল বাজারে পৌঁছে গেলাম, যেখান থেকে ডান দিকে মোড় নিয়ে কিছুটা এগোলেই পার্ক। এবার ড্রাইভারকে বোঝালাম আমরা তো প্রায় এসেই গেছি পার্কে, তাহলে যাওয়াই যাক। যদি কোনো অসুবিধা হয়, আমরা দেখব এবং তোমাকে টাকাটাও কিছু বাড়িয়ে দেব। ড্রাইভার রাজি হল এবং হাসপাতালের রাস্তা ধরে পার্কে পৌঁছানো গেল।

গেইটে একটা দোকান। দোকান থেকেই পার্কে ঢোকার টিকেট নিতে হবে- জনপ্রতি কুড়ি টাকা। বললাম আমাদের সাথে ছোট বাচ্চারা আছে, ওদেরও কি টিকিট লাগবে। আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কাউন্টারে বসে থাকা মনিপুরি মহিলা; বাংলা, হিন্দি, ইংলিশ কোনটাই বোধগম্য নয় তার। কাছেই এক ভদ্রলোক আমাদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিলেন, তাকে দোভাষী হিসেবে ডেকে নিলাম। বাচ্চাদের টিকিট না নিলেও চলবে, তবে বড়দের লাগবে- সে অনুযায়ী টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকলাম।

নিংশিংখুন (Ningshingkhun Bio diversity park) বায়োডাইভারসিটি পার্ক। ঢুকেই বাঁদিকে বাচ্চাদের খেলার জন্য বেশ কিছু সরঞ্জাম দেখা গেল দোলনা টোলনা সহ। একসময় এখানে টয় ট্রেনের ব্যবস্থা ছিল এখন শুধু লাইনটাই রয়েছে অবশিষ্ট । বিশাল বড় ঝিল আছে পাশেই, বোঝা গেল একসময় এখানে বোটিং এরও ব্যবস্থা ছিল । হয়তো পর্যটকের অভাবেই বন্ধ হয়ে গেছে। বাচ্চারা সবাই এই পার্কে দোলনা টোলনা চড়ে কিছুটা আনন্দ নিয়ে নিল। আমিও একটা দোলনায় চেপে বসলাম, সবাই হাসাহাসি করলো, কেউ কেউ ফটো তুলে নিল। প্রায় ঘন্টা খানেক এখানে কাটিয়ে আমরা রাস্তা ধরে পার্কের ভেতরের দিকে চললাম। দুদিকে জঙ্গল- প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে পাওয়া গেল। এমনিতে পাখির ডাক ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না, মাঝে মধ্যে দু’চারজনকে দেখা গেল। কয়েক জোড়া কপোত-কপোতিকে পেলাম নিভৃতে জঙ্গলের পাশে বসে হাতে হাত রেখে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে গল্প করছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর পার্কের ভেতর দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে আমরা পৌঁছলাম মনিপুরের বীর শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত একটা জায়গায় যেখানে রয়েছে সুদৃশ্য মন্দির, অনেকগুলো স্ট্যাচু, বসার জায়গা এবং সুবিন্যাস্ত গাছপালা। এখানে প্রকৃতিকে নিজের মতো করে সাজান হয়েছে। অনেক উঁচুতে থাকা এই জায়গা থেকে দূরে আমাদের গাড়িকে অনেক ছোট দেখাচ্ছিল, এখানে বসলাম কিছুক্ষণ। এখানেও অনেক লোক আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে গল্প করছে। আমরাও বসলাম কিছুক্ষণ, যে যার মতো। পুরো পার্কে বোধহয় কয়েক শত ছবি তোলা হলো দশ বারোটা মোবাইলে। এক সময় আমাদের ফটো তুলতে হলে ক্যামেরার ফিল্ম কিনতে হতো, ৩৬টা ফটো হত একটা ফিল্মে, দক্ষতা থাকলে ৩৮টাও করা যেত। এখন অবলীলায় হাজার হাজার ফটো উঠছে, পছন্দ না হলে মুহূর্তে মুছে ফেলা হচ্ছে।

যাক, এবার ফেরার পালা। পার্ক থেকে বেরিয়ে এসে মোটামুটি সবাই পরিতৃপ্ত, আমি মনে মনে ভাবলাম ঝুঁকিটা ভালয় ভালয় উতরানো গেল। ফেরার পথে গাড়িতে উঠে শুরু হলো রবীন্দ্র সংগীত, ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মত নাচেরে’- নব প্রজন্ম ছাড়া সবাই গলা মেলালো।

প্রকৃতিকে যারা ভালোবাসে, তারা এই রকম ছোট্ট সফরে স্বচ্ছন্দে ঘুরে আসতে পারে প্রতিবেশি রাজ্যের জিরিবাম থেকে। তবে, কেউ যদি ঝাঁ চকচকে একটা সফরের আশা করে যেতে চায়, তবে হতাশ হতে হবে ।

Comments are closed.