Also read in

Part 4 of Arijit Aditya's special series, Corona Countdown

১. আজ সকালে চলে গেলেন বিশুদা। আমার পিসতুতো দাদা। জহর শংকর দত্ত। ভুগছিলেন বেশ কিছুদিন ধরেই। ডায়ালিসস চলছিল। অশক্ত শরীর, শুক্রবার বাড়িতে পড়ে যান। লকডাউনের মধ্যেই নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া হয়। আজ সকালে সব শেষ।
বড় অসহায় লাগে। খুব দূরে তো নয়, অম্বিকাপট্টি। শ্মশানও কাছেই। কিন্তু এই লকডাউন সাঁতরে যাব কী করে! টিভি খুললেই দেখা যাচ্ছে, পুলিশ আটকে দিচ্ছে। তবু হয়তো প্রশাসনের কোন কর্তাকে বলে ব্যবস্থা করা যেত। কিন্তু শ্মশানেও তো বেশি মানুষের যাওয়া বারণ। কী দুঃসহ পরিস্থিতি! পরিজনের মৃত্যুতে শ্মশানযাত্রীও হওয়া যাবে না।
শ্মশানে প্রয়াতের শেষকৃত্যের সনিষ্ঠ আয়োজনের চেয়ে বেশি সতর্ক নজর থাকে মিটার-মাপা সোশাল ডিস্টান্সিঙে আটকে থাকে শোকযাপন। স্বজনের মৃত্যুকে ছাপিয়ে যায় নিজের মৃত্যুভয়, যে-মৃত্যু নিমিষে ছড়িয়ে পড়তে পারে আরও স্বজনের মধ্যে।
মানবসভ্যতা এত বড় সংকটে আর কখনও পড়েনি, আমি নিশ্চিত।

২. আজই শ্রাদ্ধ ছিল আমাদের পাড়ার শুভেন্দু চন্দের। নমঃ নমঃ করে শ্রাদ্ধের নিয়ম পালন। পুরুতঠাকুরই সব উপচার নিয়ে এসেছিলেন, তাঁকে মূল্য ধরে দেওয়া হয়েছে। পাড়ার কয়েকজন গিয়েছিলেন। শুভেন্দুর ছোটবেলার বন্ধু আক্ষেপ করছিলেন, শ্রাদ্ধেও নজর শুধু দূরত্বে।

৩. গত রবিবার ছিল জনতা কারফিউ। কার্যত সেদিন থেকেই সব কিছু বন্ধ। থমকে আছে জীবন। আজ সাত দিন। এই সাতদিনে শিলচর শ্মশানে দাহ হয়েছে সাইত্রিশটি বডি। শ্মশানের কর্মী দিলীপ চক্রবর্তী জানালেন, প্রাপ্তবয়স্কের বডি দাহ করতে গড়ে চার থেকে সাড়ে চার কুইন্টল কাঠ লাগে। শিলচর শ্মশানে এখন প্রায় ৫০ কুইন্টল কাঠ মজুত রয়েছে।একটি বডি দাহ করতে ধরে নিই যদি চার কুইন্টলও লাগে, তাহলে মজুত কাঠে বারোটির বেশি বডি দাহ সম্ভব নয়।

প্রশাসন নিশ্চয় জানে বিষয়টি। নিশ্চয় সাপ্লাই ঠিক থাকবে। আচ্ছা, এই এতো এতো কাঠ আসে কোত্থেকে?
পরক্ষণে মনে ঝিলিক মারে, কেন এসব অলুক্ষুনে কথা ভাবছি আমি? অবচেতনে উঁকি মেরে টের পাই, ইতালির স্তূপাকৃত মৃতদেহ দাহের অন্তেষ্টিআখ্যান। অবচেতনে কোথাও ঘাপটি মেরে পত্রিকার ওই খবরটি। ব্রিটেনে নাকি মুসলিম খ্রিস্টানদেরও দাহ করা হবে। কবর দিলে যদি মাটিতে মিশে যায় মৃত্যুবীজ!

৪. গতকাল মধ্যরাতে হঠাৎ কর্কশভাবে বেজে ওঠে ফোন। আবু ইউসুফ। হ্যাঁ, সেই ইউসুফ, যিনি লকডাউন উপেক্ষা করে গতকাল নিলামবাজার বারৈগ্রাম থেকে বাইকে চেপে হাইলাকান্দির মিজোরাম সীমান্তে চলে গিয়েছিলেন। মিজোরাম থেকে তাঁর ভাই ও গ্রামের আরও কয়েকজন হেঁটে ফিরছেন। রাত দশটা নাগাদ আবু জানান, পাওয়া গেছে ভাইদের, ওদের নিয়ে বাড়ি ফিরছেন তাঁরা। তা হলে এতো ফোন কেন?
আবু জানালেন, হাইলাকান্দি করিমগঞ্জ সীমান্তের কোনও ফাঁড়িতে তাঁদের মেডিক্যাল করানোর সময়ই পুলিশের এক অফিসার বেঁকে বসেন। তাঁর সোজা কথা, ওঁদের ঢুকতে দেওয়া যাবে না। কোনও কাকুতিমিনতি টিকলো না। যে সুমোতে করে আবুরা ফিরছিলেন, সেটাতেই চাপিয়ে মিজোরাম সীমান্তের গারদ পুঞ্জির পাহাড়ে তাঁদের ছেড়ে আসে পুলিশ।
আজ সকালে আবুর কথা শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম। মোট আটত্রিশজন ফিরছিলেন মিজোরাম থেকে। এই আটত্রিশজনকেই ওই সুমোর ভেতর ওপরে তুলে ঘোর অন্ধকারে ছেড়ে আসা হয়। পুলিশর হাতে পড়লে সোশাল ডিস্টান্সিঙের হাল হয়!
তা হলে ফিরলেন কীভাবে?

বারৈগ্রামের বাড়িতে বসে হাসেন আবু। বলেন, ওই ড্রাইভারই পুলিশকে মেনেজ করে। তবে ড্রাইভার আর ঝুঁকি নিয়ে ফিরতে চায়নি। অগত্যা সারা রাত হেঁটে সকালে রামকৃষ্ণনগর পৌঁছেন তাঁরা। না, আর কেউ আটকায়নি।
মানে! এই আটত্রিশজনের কোনও মেডিক্যাল হয়নি।
আবু নির্বিকার। দু দিন ধরে হেঁটেছে স্যার, এখন ধুম ঘুমে।
ঘুমে তো আসলে পুলিশ। প্রশাসন। না হলে মেডিক্যাল ছাড়া এ ভাবে ঢুকতে দেয়!

৫. এরই মধ্যে আসে জীবনের বার্তা। শিলচর মেডিক্যালে এমনিতে দিনে গড়ে সাতাশটি শিশুর জন্ম হয়। লকডাউনের জন্য গ্রাম থেকে হয়তো প্রসূতিরা কম আসছেন, তাও স্তব্ধ গত সাতদিনে মেডিক্যালে গড়ে পনেরোটি শিশুর জন্ম হয়েছে।
গ্রিন হিলস নার্সিং হোমের কর্ণধার রুদ্র নারায়ণ গুপ্ত জানালেন, তাঁদের হাসপাতালে এই সাত দিনে তেরোটি শিশু পৃথিবীর আলো দেখেছে।

হ্যাঁ আলো। পৃথিবীর আলো। জন্মই চিরন্তন আলোকিত সত্য।

মৃত্যু। শ্রাদ্ধ। জীবনের জন্য ঘোর অন্ধকারে বাড়ি ফিরতে রাতভর ক্লান্ত শরীরকে বন্ধুর পথে টেনে হেঁচড়ে এগিয়ে চলা। এবং শিশুর জন্ম। জীবনের উদযাপন। এ সব নিয়েই লকডাউনের দুসঃহ চারদিন কাটিয়ে দিলাম

Comments are closed.

error: Content is protected !!