Also read in

"Door": The tale of a girl, her past and the knight; Sunday Special

দরজা, মধুমিতা সেনগুপ্ত

সকালে ঘুম ভাঙতেই ধড়মড় করে উঠে বসে চৈতালি। কিছু কি স্বপ্ন দেখছিল সারারাত ধরে ? মনে পড়ে না । তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে বসার ঘরে এসে দেখে সুমন আর ছেলে জোজো মোটামুটি রেডি হয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে। সুমন টিপ্পনী কাটে ‘যার বিয়ে তার হুঁশ নেই পাড়া-পড়শির ঘুম নেই’। সত্যিই তো । আজকের প্ল্যানটা তো শুধুমাত্র চৈতালির জন্যই । আজ চারদিন হলো চৈতালি বাপের বাড়ি এসেছে মুম্বাই থেকে। প্রতিবারই আসে কয়েক দিনের জন্য । কিন্তু কোনোবারই বালিপুর বাগানে যাওয়া হয়না। এবার সুমন সময় বের করে নিজেই প্ল্যান করেছে। আর ঠিক যাওয়ার দিনই এতটা ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করে দিলো নিজেই। আসলে বাপের বাড়িতে আসলেই ঘুম বেড়ে যায় চৈতালির। ভাগ্যিস মা-বাবা এখনো আছেন বিশেষ করে ‘মা’ । এখনো আসলে নিজেই সব করে জামাইকে খাওয়াবেন। চৈতালি তাড়াতাড়ি করে মায়ের হাতের রুটি তরকারি মুখে পুরলো। স্নানটান সেরে নিয়েছিল আগেই। টুকিটাকি জিনিসপত্র সুমন আগেই ব্যাগে ভরে নিয়েছে। গাড়িও বলা ছিলো। খুব ইচ্ছে ছিল চৈতালির বাবা মাকে সঙ্গে নিয়ে যাবার। কিন্তু সুধাময়বাবুর শরীরটা ইদানিং খুব ভাল যাচ্ছে না। তাই শ্রীময়ী মেয়ের কথায় রাজি হননি। দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর কাটিয়েছেন বালিপুর বাগানে। ইচ্ছে তো তাদেরও করে। কিন্তু আজ আর সেখানে তেমন কেউ নেই। সবই ধ্বংসস্তূপ। কোনোমতে মিলটা চলছে । চৈতালি প্রতিবারই জেদ করে যাবার। যাইহোক এবার মেয়ের আশা পূর্ণ হচ্ছে। সুধাময়বাবু ড্রাইভারকে ভালো করে রাস্তাটা বুঝিয়ে দিলেন। প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার পথ। শহরে বাড়ি করার পর কয়েকবার মাত্র গেছিলেন সুধাময়বাবু। তাও ওই নেহাত প্রয়োজনেই। মেয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন কিংবা কোন অফিশিয়াল কাজে। আসলে কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর নেবার পর সেখানে বারবার যাওয়াটা যে কী অদ্ভুত কষ্টকর, যারা অনুভব করে তারাই বুঝতে পারে ।

গাড়ি ছাড়ার সাথে সাথেই চৈতালির মনটা নেচে উঠলো কোথায় যাচ্ছে সে? বালিপুর । তার স্বপ্নের বালিপুর । কত স্মৃতি কত কথা জীবনে গেঁথে আছে এই বালিপুর নিয়ে ।এই কুড়ি বছরেও ভুলতে পারেনি চৈতালি। জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা,একটু একটু করে কুঁড়ি মেলা সবই তো ওখানে। মা বলতো তোকে আমি কতটুকুই বা মানুষ করেছি। পাড়াপড়শিরাই বড় করে দিয়েছে। পাড়া বলতে পাঁচটি কোয়ার্টার নিয়ে একটি পাড়া। অন্য দুটি পাড়াতে আরো পাঁচ পাঁচটি কোয়ার্টার। টিনের চালের খুব সুন্দর সাদা রং করা বাড়ি গুলি। সামনে পেছনে বড় বারান্দা। তিনটি ঘর আর রান্নাঘর ,বাথরুম। সবুজে ঢাকা প্রতিটি পাড়াই ছিলো টিলার উপরে। বারান্দায় দাঁড়ালে চা’ঘর দেখা যেত। আসলে মিল। সবাই বলতো চা ঘর। মিলের শব্দের সাথে ভেসে আসত চা পাতার গন্ধ। চৈতালি যেন গাড়িতে বসেই অনুভব করতে লাগলো সেই মন কেমন করা গন্ধ। সুমন বই খুলে বসেছে। বই পড়ার খুব শখ সুমনের। গাড়িতে কিংবা বিমানে বই খুলে বসবেই । চৈতালিরও ভালো লাগে বই পড়তে। যদিও আজকের ব্যাপারটা অন্য। আজ কোথায় হারিয়ে গেছে তার মন। চৈতালি নিজেও জানে না। হঠাৎ একটা মজার কথা মনে পড়লো চৈতালির। তাদের কোয়ার্টারের নিচেই মানে সমতলে ছিল ছোট ম্যানেজারের বাংলো। প্রতি দু’বছর পর ম্যানেজার বদলে যেত সেই বাংলোর।কেউ বউ নিয়ে আসতো। কেউ ছিল ব্যাচেলর। চৈতালিদের তখন কী অদম্য কৌতূহল। ম্যানেজারের বউ কী পোশাক পরে ? বিকেল বেলায় কী করে? এগুলো দেখার জন্য উঁকিঝুঁকি দিতো। অবশ্যই বাবাকে লুকিয়ে। বাবার উপর ছোটোবেলা ভীষণ রাগ হতো চৈতালির। কোনোদিন ম্যানেজারের বাংলোয় নিয়ে যেতেন না বাবা। বছরে একবারই মাত্র ডুমুরের ফুল ম্যানেজারের পরিবার গুলোকে দেখা যেত। সেটা হলো পুজোর সময়। বাবারা বলতেন সাহেব। সাহেব না ছাই! আরে বাবা পুজোটা তো সবার । তা না ,ম্যানেজারের দল আসলেই প্যান্ডেলের সামনের চেয়ারগুলো ছেড়ে দিতে হবে। পেছনে গিয়ে বসতে হবে। কী যে নিয়ম ছিল। উনারা হাত পা ছড়িয়ে বসবেন ,আরতি দেখবেন । তারপর নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাব ঘরের একটি সুসজ্জিত ঘরে ,কতগুলো সুসজ্জিত প্লেটে তাদের প্রসাদ পরিবেশন করা হবে । উনারা পেট পুজো করে বাড়ি যাবেন। আর চৈতালিরা কি বানের জলে ভেসে এসেছে ?ওদের জন্য কাগজের ঠোঙা? এখন ভাবলে হাসি পায় চৈতালির। আর তখন মনে মনে রাগ করলেও ম্যানেজারের বউদের মেকআপ ,চুলের স্টাইল এগুলো দেখতো আর গসিপ করত । গসিপের লোকের তো অভাব ছিল না তখন। কত লোক ছিল। সবার মুখ একে একে মনে পড়ে যায় চৈতালির। চৌধুরী কাকুর দুই মেয়ে ,সেন কাকুর মেয়ে, ধরজেঠুর মেয়ে, বিশ্বাস কাকুর অবিবাহিত দুই বোন ওরাও দলে ছিলো। কাকিমনিরা ছিলেন মাদের দলে। পুজোর সময় সবাই সকালে উঠে স্নান করে নিজের ঘরের বঁটি দা নিয়ে ক্লাবঘরে যেতেন। একসাথে বসে ফল কাটতেন। গল্প করতেন । একটু বড়ো হওয়ার পর চৈতালি রাও সেই সব গল্পের ভাগ পেত । ক্লাব ঘরের বারান্দায় পুজো হত প্রতিবার। দিনরাত প্যান্ডেলে পড়ে থাকতে ইচ্ছে হতো । ছেলেরা তো থাকতোই । কিন্তু মেয়েদের একটু চোখে চোখে রাখতেন সবাই। সুধাময়ও চৈতালিকে দুপুরের প্রসাদ নেবার পর আর প্যান্ডেলে বসতে দিতেন না । বসতে যে খুব ইচ্ছে করতো চৈতালির। বয়সটাই ছিল এমন। কোয়ার্টারের সব দাদারা চেয়ার নিয়ে বসতো তখন আড্ডায়। দিদিরাও থাকতো কেউ কেউ । অন্তাক্ষরী খেলা হতো । রাস্তার পাশে নানা রকম সাজ পোশাকে সজ্জিত মানুষের হেঁটে যাওয়া দেখতে ইচ্ছে হতো চৈতালিরও। কিন্তু বাবা সুধাময় ছিলেন একটু রক্ষনশীল। তাই সব ইচ্ছেগুলো চাপা পড়ে যেত । পাড়ার দাদা দিদিরা সবাই মিলে শহরে ঠাকুর দেখতে যেত। সেখানেও অনুমতি ছিলনা তার । বাগানে তো মাত্র দুটো পুজো হতো। একটা ক্লাব ঘরে ,বাবুদের পুজো। আর একটা নাচ ঘরে চা শ্রমিকদের। মন ভরত না চৈতালির । কোনো কোনো বার বাবা অটো ভাড়া করে মাকে আর তাকে শহরে পুজো দেখিয়ে আনতেন। কিন্তু যতবার সুধাময় পুজোর সেক্রেটারি হতেন, সেবার গুলোতে এসব হবার কোন সম্ভাবনা ছিল না।

জোজোর কথায় চমক ভাঙ্গে চৈতালির। ‘মা,খিদে পেয়ে গেল যে।সঙ্গে কিছু খাবার আছে?’ সুমন বই থেকে মুখ তুলে বলে ‘হ্যাঁ, জানি তো ভালো করে খেলেই না সকালে । তাই তোমার জন্য মুড়ির মোয়া করে দিয়েছেন দিদন । নাও এখন এগুলো পেটে সাঁটাও’। চৈতালিও যোগ দেয় কথায় । সত্যিই মা যে এখনো এত এনার্জি ধরে রেখেছে এ বয়সে,আমাদের যে কি হবে’ ? সুমন জানালা দিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে বলে ‘কাহা রাজা ভোজ ঔর কাহা গঙ্গু তেলি’।সুমনের এসব কথায় চৈতালি রাগ করে না । আসলে সুমনকে পেয়ে সত্যিই ধন্য সে। এতটাই তাকে সাপোর্ট করে চলে যে, মাও মাঝে মাঝে বলে ‘তুই সুমনের যোগ্য না’। এছাড়া সুমন যে চৈতালির কাছে কতখানি সে শুধু চৈতালি জানে । জীবনের এমন এক ঝড় বাতাসের দিনে সুমনের আগমন ঘটেছিল তার জীবনে । যদি না আসতো কি যে হতো কে জানে । দীর্ঘ গভীর ক্ষতের উপর হাত রেখেছিল সুমন। ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়েছিল । চৈতালি জানালা দিয়ে তাকিয়ে আবার অন্যমনস্ক হয়ে যায়। কী সুন্দর রাস্তা গুলো। এমন দৃশ্য দেখা যায় না মুম্বাইয়ে।রাস্তার দু’পাশে ধানক্ষেত । বৃষ্টির জলে মাঝেমাঝেই ডোবা হয়ে আছে । মন ভরে যায় সত্যি । খোলা হাওয়ায় বহুদিন পর যেন শ্বাস ফিরে পায় চৈতালি । আর এজন্যই তো স্বপ্নের বালিপুর যাওয়া। সুমন প্রথম থেকেই রাজি ছিল । শুধু সময় করতে পারেনি অন্যবার । বাবা সুধাময় কিন্তু প্রায়ই চৈতালিকে বলেছেন কি হবে ওখানে গিয়ে ? কী আছে ওখানে এখন আর? হ্যাঁ সত্যিই কিছুই নেই এখন আর। সেনকাকু বিশ্বাস কাকু এমনকি পাশের বাড়ির পালকাকুরাও সবাই এখন শহরে বাড়ি কিনেছেন। রিটায়ার্ড করে ওখানে শিফ্ট হয়ে গেছেন । বাগানের অবস্থাও মন্দার দিকে । ঋণ করে করে কোম্পানি সর্বস্বান্ত। তাই এখন সর্দারদের দিয়েই লেখাপড়ার কাজ চালাচ্ছে। সত্যি ।কিছুই নেই হয়তো সেখানে। কিন্তু আজও দীর্ঘ বছর পরেও চৈতালির বুকের ভেতর বালিপুর তার সমস্ত স্মৃতি নিয়ে কিভাবে যে বেঁচে আছে সে শুধু চৈতালিই জানে। বাবা এবং মায়ের কাছে বালিপুর হয়তো একটি সংগ্রাম । নিতান্তই একটা কাজের জায়গা। কিন্তু চৈতালির কাছে বালিপুর তার অস্তিত্ব ,তার সুখকর অতীত । যা সে হয়তো চাইলেও ভুলতে পারবেনা । সুমন এসে সে অতীতে প্রলেপ স্থাপন করেছে ঠিকই। কিন্তু সে যে শুধুমাত্র প্রলেপই। তবে কি সেই গোপন ক্ষত উস্কে দেবার জন্যই এত আয়োজন। চৈতালি নিজেও জানেনা। কোনো এক অজানা আবেশে চৈতালি চোখদুটো বন্ধ করে । শুধু মুখটাই মনে করার চেষ্টা করে একটা খুব প্রিয় চেনা মুখ। সরল অথচ দৃপ্ত।

অনেকটা বছর কেটে গেছে মাঝে।
যেদিন সে ফিরে গেল চৈতালিদের বাড়ির গেট থেকে, ভোর রাতে ক্লান্ত অবসন্ন শরীর নিয়ে। সেদিনের পর আর দেখা হয়নি তার চৈতালির সাথে । লম্বা ,ফর্সা আর কঠিন দুটো হাত দিয়ে সে যখন পুজোর ঢাক বাজাতো, অদ্ভুত এক তেজ খেলা করে যেত তার সারা মুখে। না ,পেশাদার ঢাকি ছিল না হয়তো। কিন্তু বাদ্যযন্ত্রে তার ভালোই হাত ছিল । পাড়ার অনুষ্ঠানগুলোতে শামীমের ডাক পড়তো প্রায়ই। অনেকদিন পর ‘শামীম’ নামটা উচ্চারণ করল চৈতালি মনে মনে । ছোটোবেলা থেকেই দেখেছে শামীমকে। একসাথে বড় হয়েছে। বাগানের হাইস্কুলের হেডমাস্টার আব্দুল স্যারের ছেলে ছিল শামীম। আব্দুল স্যারের কথা মনে পড়ে যায় চৈতালির। দেখা হলেই ‘মা’ বলে ডাকতেন ।বাবুদের কোয়ার্টারে তিনি প্রায়ই আসতেন। বসত চায়ের আসর। গল্প আড্ডা কোন কিছুতেই বাবুপাড়ায় আসতে তার কোনো বাধা ছিলনা। সুধাময় বাবুও খুব ভালোবাসতেন আব্দুল স্যারকে। আব্দুল স্যারের বাড়িতে চৈতালি দের খুব একটা যাওয়া-আসা না থাকলেও একটি দিনের কথা খুব মনে পড়ে চৈতালির । তখন ক্লাস সেভেন হবে হয়তো । প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টির দুপুর। স্কুল থেকে ফিরে আসার সময় ফুলি আর পারুল যখন তাদের বাড়ির দিকে পা বাড়ালো তখন চৈতালি একা। কোনোমতে জামা, ব্যাগ আর ছাতা সামলে আসতে গিয়ে ছাতাটা উল্টে গিয়ে কোথায় যে উড়ে গেল চৈতালি বুঝে উঠতে পারলো না । চারিদিকে অসহায়ের মত তাকাতে তাকাতে প্রায় কান্না পেয়ে যাচ্ছিল চৈতালির।তাও কোনোমতে বাড়ির পথে পা বাড়ালো । কয়েকপা যেতে না যেতেই হঠাৎ দেবদূতের মতো ছাতা হাতে শামীম দা। সদ্য কলেজে ওঠা পাতলা গোঁফের এক যুবক । সম্পূর্ণ অচেনা দৃষ্টি । অদ্ভুত এক ভয় আর লজ্জায় চৈতালি সেদিন কুঁকড়ে যাচ্ছিল। টিলার উপর থেকে ডাক শুনতে পাচ্ছিল আব্দুল স্যারের স্ত্রীর, ‘আহারে মেয়েটা একদম ভিজে কাক। ও বাপজান তাড়াতাড়ি ঘরে নিয়ে আয়।’ তারপর সে যে কি আদর ওই স্নেহময়ীর। চৈতালী কোনোদিনও ভুলবেনা। মাথা মুছে দেওয়া, জামা পাল্টে শামীমের বোন শবনমের সালোয়ার কামিজ পরিয়ে দেওয়া, বিকেলে নিজে নিয়ে গিয়ে বাড়িতে তাকে পৌঁছে দেওয়া। বাবা অবশ্য আগেই জেনে গেছিলেন চৈতালির অবস্থার কথা।চৈতালির আজও ভাবতে ভালো লাগে এটুকু সামাজিক উদারতা বালিপুর বাগানে ছিলো। পুজোর সময় মুসলমান পাড়ার সবাই এসে প্রসাদ নিত ক্লাবঘরে । তারাও একই রকম আনন্দ করত। গানবাজনার অনুষ্ঠানে অংশ নিতো। সেই সূত্রেই শামীমের সাথে চৈতালির মেলামেশা। এছাড়া স্কুলে তো প্রায়ই দেখা হতো তাদের ।স্কুলটাই তাদের একমাত্র ভরসা ছিল। স্কুলের পাশেই যেহেতু মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি, তাই অফ টাইম হলেই সে চলে যেত সেখানে। যথারীতি শামীমের সাথে তারও টিফিন রেডি থাকতো। মাঝে মাঝে শামীমের সাথে গাছ লাগানো শিখতো। কিভাবে মাটি খুঁড়ে চারা লাগাতে হয় শামীম তাকে হাতে ধরে শিখিয়ে দিয়েছিলো। দুজনে মিলে লাগিয়েছিল নানা ধরনের ফুল আর সব্জি গাছ। সব গুণই ছিলো শামীমের। ওর হাতের ঢাকের কাঠির শব্দ শোনার পর থেকে আলাদা করে ঢাকি রাখা হতো না পুজোয় । এতটাই গুণ ছিলো ছেলেটার। সুধাময়ই একদিন আবিষ্কার করেছিলেন শামীমের এই গুণ। অথচ সুধাময়ই একদিন….।

নাহ্, সেই দিনটির কথা আর মনে করতে চায়না চৈতালি। বাগানের ওই রক্ষণশীল পরিবেশে চৈতালিরা তো বেশি দূর এগোতে পারেনি। শুধু গোপনে স্বপ্নের জাল বোনা শুরু হয়েছিল মাত্র। এরইমধ্যে বাবা সব জেনে গেলেন। কি এমন দোষ করেছিল শামীম। চৈতালির একটা ফটোই তুলতে চেয়েছিল শুধু। সুধাময় দেখতে পেয়ে এতটাই ক্ষেপে গেলেন যে, পুজো প্যান্ডেল থেকে চৈতালিকে একেবারে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন । এই অপ্রত্যাশিত ঘটনা শামীমের মতো চুপচাপ শান্ত ছেলেটিকে কোথাও হয়তো আঘাত করেছিলো।হয়তো পৌরুষত্বে লেগেছিল একটু । না হলে হয়তো শেষ বোকামিটা করত না। সেদিনই রাতে নেশা করে চৈতালিদের বাড়ির গেটে এসে শামীম খুব চিৎকার করেছিলো। রীতিমতো চৈতালিকে তুলে নিয়ে যাবার হুমকিও দিয়েছিলো। এই ঔদ্ধত্যটুকু সইতে পারেননি সুধাময়। সেদিনের পর থেকে শামীমের জন্য আর দরজা খোলেনি চৈতালিদের। বন্ধ দরজার দুপাশে দুটি মানুষের স্বপ্নের অপমৃত্যু হয়েছিল সেদিন। শামীম, হ্যাঁ শামীমের মতো একটি ছেলে সারারাত সেদিন গেটে বসে ছিল। শুধু চৈতালির জন্য ।

সুমন হঠাৎ বলে উঠল ,’কোথায় হারিয়ে গেলে ,এই দ্যাখো, বালিপুর ঢুকলাম জাস্ট।’ ‘হ্যাঁ তাইতো,এইতো চাঘর’ -চৈতালিরও চমক ভাঙে। ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল ‘প্রথম কোথায় যাবো ম্যাডাম’? কিছু না ভেবেই চৈতালি বলল, ‘স্কুল । ডান দিকে গিয়ে বাজার হয়ে একটু এগিয়ে গেলেই স্কুল পড়বে’। না জানি এখন কী অবস্থায় আছে স্কুলটি। চৈতালি কি শুধু স্কুল দেখতেই এসেছে এখানে এত বছর পর । নাকি এই বাগানের আলো হাওয়া রৌদ্রে হারিয়ে যাওয়া তার অতীতের নেশা তাকে এখানে টেনে নিয়ে এসেছে। চৈতালি ছাড়া এর উত্তর নেই কারোর কাছে। স্কুলটির সাথে অনেক অতীত জড়িয়ে রয়েছে তাদের দুজনেরই। উচ্চমাধ্যমিক দেওয়ার পর এখানে পার্ট টাইম শিক্ষকতা করতো শামীম।যদিও ছোটো ক্লাসে। আর চৈতালির স্বপ্ন ছিলো ডিগ্রি পাশ করে সে এখানে পাকাপাকি শিক্ষকতা করবে। চা বাগানের শ্রমিকদের সুশিক্ষিত করে তুলবে। শামীমের সাথে চৈতালির এ নিয়ে কথাবার্তাও হতো। শামীম শুধু গাল টিপে দিত চৈতালির। কোনো এক কালবৈশাখী ঝড়ে হারিয়ে গেল তাদের সেই দিনগুলো।

গাড়ি থেকে নেমে স্কুলটির সামনে দাঁড়ালো চৈতালি। সুমন ও জোজোও এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। চৈতালি চারিদিকটা দেখতে থাকে। এখন আর আগের কিছুই নেই। অনেক উন্নতি হয়েছে স্কুলের বলা যায় । আমূল পরিবর্তন । সরকার থেকে তাহলে অনেক টাকা দিচ্ছে বলতে হবে। পাকা বাথরুম,কুয়োও পাকা করা হয়েছে । পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এক বিদ্যায়তন । গাঁদা ফুল ,কলম করা গোলাপ ফুল, আর নানা রকম পাতাবাহারের টব সারি করে রাখা। সুমন খুব খুশি হয়ে বলে উঠলো, ‘বাহ্,প্রত্যন্ত এক বাগানে এমন একটি স্কুল ভাবাই যায়না। নেহাত আজ রবিবার। নইলে কচিকাঁচাগুলোকেও দেখতে পেতাম’। চৈতালি শুধু সুমনের কথায় সম্মতি জানায়।ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে সে শামীমের বাড়ির দিকে উঠতে থাকে।সুমন আর জোজো ওর পেছনে। আজ আর চৈতালির কোনো বাধা নেই । নেই কোনো সংকোচ। এক বাঁধনহারা চঞ্চলতা তাকে ছুটিয়ে নিয়ে চলল যেন। সে জানেনা সামনে কী অপেক্ষা করে আছে তার জন্য । কিন্তু একবার অন্তত শামীমের খোঁজ তাকে নিতেই হবে । যে উত্তরটুকু বন্ধ দরজার ভেতর থেকে সে সেদিন দিতে পারেনি ,আজ অন্তত সেটুকু পূরণের চেষ্টা করবে সে। বাড়িটির উঠোনে দাঁড়াতেই একজন মহিলার কন্ঠ “কারে চাই আপনাদের”। পরনে লাল পেড়ে শাড়ি পরা এক মধ্যবয়সী মহিলা। কোনোদিন দেখেছে বলে মনে পড়েনা চৈতালির। সিঁথিতে সিঁদুর। তবে কি একেবারেই ভোল পাল্টে গেল বাড়িটার? তবে কি আর কোনো আশা নেই ? মাঝখানের বিশ বছর কম কথা নয়। কোনোমতে জিজ্ঞেস করলো সে, ‘এটা মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি ছিল না? উনার একটা ছেলে ছিল’।নামটা উচ্চারণ করতে পারেনা চৈতালি। আটকে যায় কথা । “মাস্টারমশাইয়ের খোঁজে আইছেন?আসেন আসেন ঘরে আইসা বসেন’। মহিলাটি চৈতালিদের নিয়ে গিয়ে বসার ঘরে বসায় । বাড়িটা পুরোনো হলেও ঘরের আসবাবপত্রে সচ্ছলতার ছাপ । মহিলাটি ঘরের ভেতর উঁকি দিয়ে বলে ওঠেন,’ওরে মালতি অতিথি আইছেন একটু চা নিয়ে আয়’। তারপর বলতে শুরু করে, “মাস্টারমশাই তো সেই কবেই গত হয়েছেন। আপনারা চিনতেন নাকি উনাকে? বড়ো ভালো মানুষ ছিলেন । আমার বরও এই স্কুলের মাস্টার। আমরা এখানেই থাকি। আজ আমার বর একটু শহরে গেছেন । শামিম বাবু মানে মাস্টার মশায়ের ছেলে কিছুতেই আমাদের এখান থেকে
যাইতে দেন না। ভাড়াও নেন না। আমরা এখানে থাইক্যা স্কুলের কাজ দেখাশোনা করি। কথাগুলো একসাথে বলে একটু থামে মহিলাটি। চৈতালি আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করে, ‘তা এখন কোথায় থাকেন উনি ?
-‘উনি তো লণ্ডনবাসী। অনেক বছর হয়ে গেলো।’

সুমন মন দিয়ে কথাগুলো শুনছিল। জিজ্ঞেস করে, ‘তা স্কুলের সরকারি সাহায্য বেশ ভালই দেখলাম। উন্নত ব্যবস্থা । মহিলাটি তখন সঙ্গে সঙ্গে বলে, ‘না বাবু সরকারি সাহায্য আর কোথায় আজকাল তেমন পাওয়া যায়। সবই আমাদের শামীম বাবুর দয়া। প্রতি মাসে টাকা পাঠান আমাদের কাছে স্কুলটির উন্নতির লাইগ্যা। সেই অনুযায়ী আমরা ধীরে ধীরে এতদিনে স্কুল টারে একটু দাঁড় করাইছি । এইতো কালই শামীম বাবু এসে দেইখ্যা গেছেন সব কাজ। কিছু টাকাও দিয়া গেলেন। আজ শহর থাইকা উনার ফেরার ফ্লাইট। আপনারা যদি কাল আসতেন দেখা হয়ে যেত’। ইতিমধ্যে এসে গেল, চা, বিস্কুট আর কিছু মিষ্টি । কিন্তু চৈতালির যেন পায়ের নিচে মাটি সরে যাচ্ছিল । ভাবনাগুলো মুহূর্তে ভোঁতা হয়ে গেল তার। শামিমদা এসেছিল কাল। এই বালিপুর বাগানে। সেও তবে ভুলতে পারেনি এই বালিপুরকে। দীর্ঘদিন ধরে বালিপুর বাগানে প্রোথিত চারাকেই তাহলে মহীরুহ বানিয়ে চলেছে সে সযত্নে। আর চৈতালি কি করছে এতদিন ধরে । সংসার ,বাচ্চা মানুষ করা এসব। চৈতালির নিজেকে খুব ছোটো মনে হয় মুহূর্তেই । আজও হেরে গেল সে ব্রিলিয়ান্ট শান্ত স্বভাবের শামীম’র কাছে। কোনোমতে একটা মিষ্টি মুখে দিল চৈতালি । তারপর ব্যাগ খুলে গুণে দেখল পাঁচ হাজার টাকা আছে। সেটুকুই মহিলার হাতে দিয়ে বলল, ‘এবার থেকে আমিও কিছু সাহায্য করব মানা করবেন না’।সুমনের দিকে তাকিয়ে বলল ‘তোমার কোনো আপত্তি নেই তো’? সুমন মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো । মহিলা তখন অবাক ‘দিদি আপনি কি এখানেই থাকতেন আগে? শামীমদাকে কিছু বলতে হবে? আপনার ফোন নাম্বারটা না হয় দিয়া যান’। চৈতালি ব্যাগ নিয়ে উঠতেই যাচ্ছিলো। উঠে দাঁড়িয়ে বললো ‘কিচ্ছু বলতে হবেনা শুধু বলবেন, চৈতালি এসেছিলো’।

টিলা থেকে নেমে আসার সময় হঠাৎ চৈতালির চোখ যায় রক্তবর্ণ কৃষ্ণচূড়া গাছটির দিকে। মনে পড়ে শহর থেকে চারা এনে গাছটি লাগিয়েছিল শামীম । চৈতালিও সাথে ছিল সেদিন । এই বিশ বছরে কত বড় হয়ে গেছে গাছটি।

ফুলের ভারে নুব্জ্য গাছটির চারাও হয়েছে অনেক। চৈতালি গুটি গুটি পায়ে হেঁটে গিয়ে একটি চারা তুলে ব্যাগে ভরে নিলো । সুমন বললো, ‘কি করবে এই বড়ো গাছের চারা নিয়ে’? চৈতালি আপনমনে বলে, ‘আমার বাড়ির টবে লাগাবো। যদি বাঁচে’। বিকেল হয়ে আসছিল। ফেরার পথে প্রচন্ড ঝড়ও উঠেছিল। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়তে লাগলো। চৈত্র মাসের দাবদাহের পর বিকেলের এই বৃষ্টি হৃদয় জুড়িয়ে দিচ্ছিল চৈতালির। নিঃশব্দ গুমোট কাটাতে চৈতালি গাড়ির জানালার বাইরে মুখ বাড়িয়ে দিলো। সুমন শুধু একবার বলল ‘বেশ ভালোই হলো মাঝেমধ্যে একটু সোসিয়াল সার্ভিস করা যাবে। ভদ্রলোকের ফোন নম্বর নিয়ে নিতে পারতে’। চৈতালি শুধু হাসলো, আর বৃষ্টির প্রকোপ বাড়ায় জানালার গ্লাসটা তুলে দিলো। দূরে তখন দিনশেষে সন্ধ্যা নামছে।

লেখিকা মধুমিতা সেনগুপ্ত গুয়াহাটি আর্য বিদ্যাপীঠ মহাবিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপিকা। বরাক উপত্যকার হাইলাকান্দিতে জন্ম এই লেখিকার ছোট পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে লেখালেখির হাতে খড়ি। এরপর গল্প ও কবিতা দুটোই প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।

Comments are closed.