Journalist Sayan Biswas remembers Kalika Prasad Bhattacharya
রতন কাহারকে চেনেন?
ক’দিন আগে বলিউড র্যাপার বাদশা একটি গান বেঁধেছিলেন। বেঁধেছিলেন তার নিজস্ব স্টাইলে। গানটি ছিল, ‘বড় লোকের বেটি লো, লম্বা লম্বা চুল, এমন মাথায় বেন্ধে দিব, লাল গেন্দাফুল’। “গেন্দাফুল” নামেই গানটি ঝড় তুলেছিল। রিলিজ হওয়ার দুয়েকদিনের মধ্যেই মিলিয়ন ভিউয়ার্স পেয়ে যায় ওই মিউজিক ভিডিওটি! অবিশ্বাস্য টিআরপি! যারা র্যাপ সঙ্গীত শোনেন না, তাদের মধ্যেও কেন জানি না, দারুন ভাললাগা তৈরি করেছিল এই ফিউশন বা রিমেক। ফলে বাদশা কে, কোথায় থাকেন, তার চোদ্দ গোষ্ঠীর পরিচয় জেনে নেন নেটিজেনরা। দেখা যায়, ওই গায়ক ভদ্রলোকের নাম আদিত্য প্রতীক সিং সিসোদিয়া। ২০০৬ সালে ইয়ো ইয়ো হানি সিং’এর সঙ্গেই বলিউড-এ পা রাখা তার।মূলত হিন্দি, হারিয়ানভি ও পঞ্জাবি গানের জন্যই তিনি এক আলাদা পরিচিতি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। তবে তাঁর রেকর্ড ব্রেকিং হিট অবশ্যই ‘গেন্দাফুল ‘।
এই গানটি মূলত একটা ফক ফিউশন। মূল গান ও সুর রতন কাহার নামের এক লোকশিল্পীর। অথচ গানটি কার, কোথাকার, গানের প্রেক্ষাপটটাই-বা কী, তার মাথা-মুন্ডু না জেনেই বাদশা ফিউশন করে নিয়েছেন। অথচ এতো বড় একটা প্রজেক্টে নামও উল্লেখ ছিল না মূল গীতিকার ও সুরকারের।
দাদা, এটা ইন্টারনেটের যুগ। তাই গ্রাম বাংলার মানুষ যাদের কাছে এই গান বহুশ্রুত; তারা সুর চড়ালেন। রতন কাহার রাতারাতি ভাইরাল! বীরভূম অঞ্চলের এই লোকশিল্পীর হয়ে হাজার হাজার জনতা বিচার চাইলেন। ব্যস, বাধ্য হয়ে বাদশাও ভুল স্বীকার করে রয়ালিটি মানি হিসেবে পাঁচ লক্ষ টাকা দিয়ে দিলেন রতনবাবুকে। এই ‘লটক লটক’ আর ‘মটক মটক’-এর দুনিয়ায় এভাবেই ‘সম্মান’ জুটলো রতন কাহার নামের ওই লোকশিল্পীর। অথচ নেটে এখনো ‘গেন্দাফুল’ লিখলে রতন কাহার নন, আসে বাদশা বাবাজির ডিটেলসটাই।
এই ইস্যুতে হাজার হাজার নেটিজেনরা যে কাজ করেছিলেন, ঠিক একই কাজ একার জোরে করে যাওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন যিনি, সেই ব্যক্তিটির নাম কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য। বাংলা লোকসংস্কৃতির, কাঁটাতার বিহীন সব বাংলার লোকগানের এক জ্বলজ্যান্ত আর্কাইভ। ২০১৭-র সেই মার্চের অভিশপ্ত ৭ তারিখের সকালে দুরন্ত গতিতে ছুটতে থাকা একটি ইনোভা গাড়ি বার কয়েক পাল্টি খেয়ে একটা জলাশয়ে গিয়ে পড়েছিল। ওই দুর্ঘটনা শুধু একটা মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়নি, বাংলা লোকসঙ্গীতের একটা আর্কাইভকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। যে ক্ষতি কোনোদিন পূরণ হওয়ার নয়।
কালিকাপ্রসাদ তো শুধু গান-বাজনা করেননি, রতন কাহারের মতো শিল্পী, যারা শহুরে গান-বাজনা থেকে বহুদূরে, লোকচক্ষুর আড়ালে নিজের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে মেতে থাকেন, তাদের প্রাপ্য সম্মানের জন্য রীতিমত একটা ‘আন্দোলন’ শুরু করেছিলেন। বাংলার সুবিশাল লোকগানের ভান্ডারকে অবিকৃতভাবে জনপ্রিয় করার এক অদ্ভুত তাগিদ ছিল তাঁর। গানের প্রেক্ষাপট, ভনিতা, শব্দচয়ন, গানটি গান হয়ে ওঠার গল্প, অঞ্চল বিশেষে তার উচ্চারণ, তার মূল সুর, গানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তাতে সঠিক বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার, সব ক্ষেত্রেই গবেষণামূলক কাজের মাধ্যমে নিজের শিল্পীসত্তাকে জনপ্রিয় করে তুলতে পেরেছিলেন কালিকাপ্রসাদ। এতে দুটো কাজ হচ্ছিল। এক, নিজে অদ্বিতীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন; দুই, সেই সঙ্গে লোকগানের সুবিশাল ভাণ্ডারে বিশুদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন করতে পারছিলেন শ্রোতাদের। যতটা সময় তিনি নিজের গানের চর্চায় বা গানের দল দোহারে দিতেন, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় কালিকাপ্রসাদ খরচ করতেন, সেসব বাংলা লোক-সংস্কৃতির গবেষণামূলক কাজে; যা আমাদের নাগালে থেকেও আমরা জানতে চাইনি কখনও। এখনও চাই না।
বউ নাচের সোহাগ চাঁদ গানে ‘হেলিয়া দুলিয়া পরে নাগকেশরের ফুল’ যে একটা মস্ত বড় ভুল ব্যাখ্যা, সেসব কালিকাপ্রসাদ যে কোনো মঞ্চে দাঁড়িয়ে মুখের উপর বলে দিতে পারতেন। বলে দিতে পারতেন ‘ওটা ভুল গান। আসল লাইনগুলি হলো – নাচইন বালা সুন্দরিয়ে, পিন্ধইন বলা নেত। হেলিয়া দুলিয়া পড়ে সুন্দি জালিবেত।’ যুক্তি দিয়ে বোঝাতেন, কীভাবে মূল গানগুলি বিকৃত হচ্ছে। শহুরে মার্কেটিংয়ের ফলেই যে গানগুলি তার ইতিহাস, তার মাধুর্য্য, তার আসল সত্তা হারাচ্ছে, সেসব তুলে ধরতেন খুব সহজিয়া ভাষায়। সঙ্গে গাইতেন, উচ্চারণগুলির বিশুদ্ধতা রেখে।
তাই তো চূড়ান্ত ইলেক্ট্রনিক ইকুয়িপ্টমেন্টের এই গানের ইন্ডাস্ট্রিতে ম্যানুয়াল বাদ্য ও বিশুদ্ধ লোকগানের সমন্বয়ে একটা আলাদাই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পেরেছিলেন, যার নাম দোহার। কালিকাপ্রসাদ বলতেন, ‘আমরা তো লোকশিল্পী নই। শহুরে আলো হাওয়া মাটিতে বড় হয়ে কি লোকশিল্পী হওয়া সম্ভব? আমরা লোকশিল্পীদের সৃষ্টিতে কণ্ঠ দিই মাত্র। দোহারের (কোরাস) কাজ করি, তাই আমরা দোহার’।
জি বাংলা সারেগামাপা’র মত হাইটেক মঞ্চে লোকগান দিয়ে যে ক্যারিশ্মা দেখিয়ে গেছেন কালিকাপ্রসাদ, তা আর কোনোদিন হবে কিনা, কে জানে!কত কত শিল্পী ও তাদের পরিবেশনা আমরা দেখেছি, জাস্ট অবাক হয়ে। দেখেছি, আর ভেবেছি; লোকগান দিয়েও এমনভাবে মঞ্চ মাতানো যায়! সারেগামাপা-র টিআরপি আকাশ ছুঁয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, কালিকাপ্রসাদ-এর ‘আন্দোলন’ যে জোয়ার এনেছে, তার কিছুটা হলেও সুফল পাচ্ছেন লোকগানের পূজারীরা। কমবেশি কদর পাচ্ছেন গ্রাম-শহর সব অঞ্চলের লোকগানের শিল্পীরাও। কদর বেড়েছে রতন কাহার, বলরাম হাজরাদের মতো সেই ‘অনাবিষ্কৃত’ লোকশিল্পীদেরও!
কালিকাপ্রসাদ আজ নেই। অথচ এই নেই থাকা মানুষটিকে তাঁর পঞ্চাশতম জন্মদিনে খুব মনে পড়ছে। তার অকালে চলে যাওয়াটা যে বাংলা লোক সংস্কৃতির কত দুর্দান্ত আর্কাইভ-টাকে ডেডলক করে দিল!
যাই হোক, আমরা আশাবাদী। দোহারের মধ্য দিয়ে কালিকাপ্রসাদ যে আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিলেন, সেটা থেমে থাকবে না। রাজীব দাস, অমিত সূর, মৃগনাভি চ্যাটার্জি, সুদীপ্ত চক্রবর্তীরা কখনো তাদের ‘প্রাসাদ’কে হারিয়ে যেতে দেবেন না। তাদের প্রাসাদ আছে, সেই বিশ্বাস নিয়েই তারা ছুটতে থাকবেন দুর্বার গতিতে।
তবে সবকিছুর মধ্যেও সেই শূন্যতা মাঝেমধ্যেই নাড়া দেবে। শূন্যতা একটাই, ওই ডুবকিটা থাকলেও ডুবকি বাজানোর লোকটা যে নেই!
যেখানেই থাকুন, ভাল থাকুন কালিকাপ্রসাদ।
Comments are closed.