Also read in

On Rabindra Jayanti, read this to know Rabindranath Tagore's connect with Barak Valley

This emotional piece has been penned in Bengali and we retained it to stay true to the emotions.

‘হৃদয় দেবতা রয়েছ প্রাণে’ – রবীন্দ্রনাথ ও বরাক উপত্যকা

হৃদয় সিংহাসনে রবীন্দ্রনাথ বসে নেই এমন বাঙালির সংখ্যা হাতে গুনা যাবে। ঠিক তেমনি ‘শেষের কবিতা’ পড়েননি,শুনেননি কিংবা দেখেননি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া ভার। আর সেই শেষের কবিতার নায়ক অমিত রায় চরিত্র যখন শিলচরের কারোর আদলে রবীন্দ্রনাথের কল্পনায় চিত্রিত হয় তখন কবিগুরু যেন আমাদের আরও কাছের একজন হয়ে উঠেন।
গুরুচরণ কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ও অপূর্বকুমার চন্দের আত্মীয় রথীন্দ্রচন্দ্র দত্তের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’র অমিত রায়ের চেহারা ছবি থেকে শুরু করে অনেক কিছুই অপূর্বকুমারের আদলে তৈরি। তথ্যে আরও জানা যায়, ‘শেষের কবিতা’ প্রকাশিত হবার পর কবি অপূর্বকুমারকে পান্ডুলিপিটি উপহার দেন।
ছাত্রাবস্থা থেকেই অপূর্বকুমার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন।তিনি ছাত্রাবস্থা থেকেই পড়াশোনা থেকে শুরু করে অভিনয় সবকিছুতে খুবই সুনাম অর্জন করেছিলেন। কানাডা ভ্রমণের সময় তিনি কবিগুরুর সেক্রেটারি ছিলেন। কবির জাপান ভ্রমণের সময়ও তিনি সেক্রেটারি হিসেবে কবির সঙ্গে ছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন শিলচরের অনিল চন্দ। অনিল চন্দের স্ত্রী রানী চন্দ ছিলেন শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থী ও চিত্রশিল্পী এবং রবীন্দ্রনাথের খুবই প্রিয়ভাজন। রবীন্দ্রনাথের অসুস্থতার সময় অনেক সময় কবি মুখে বলতেন আর রানী চন্দ তা সঙ্গে সঙ্গে লিখে নিতেন। রবীন্দ্রনাথের অন্তিম সময় পর্যন্ত রানী চন্দ তাঁর সঙ্গে ছিলেন। কবির অন্তিম যাত্রায় যখন কবিকে কোঁচানো ধুতি, গরদের পাঞ্জাবি, চাদর, চন্দন, মালা দিয়ে সাজানো হয় তখন রানী চন্দ কবির হাতে তুলে দেন পদ্মকোরক। গুরুদেবের শেষ সময় সময় পর্যন্ত ঠাকুর বাড়িতে ছিলেন রানী চন্দ।

রবীন্দ্রনাথ আর বরাক উপত্যকার সম্পর্ক সন্ধানে আরো একটি তথ্য উঠে এল সামনে। শিলচরের স্বনামধন্য মহেশচন্দ্র দত্তের পুত্র রথীন্দ্রচন্দ্র দত্ত কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় তাঁর ঠাকুর বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। রবীন্দ্র-সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য তাঁরও হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ একবার বিদেশ ভ্রমণ সেরে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে উঠলে তাঁকে সমবেত সঙ্গীতের মাধ্যমে সংবর্ধনা জানানো হয়। সেই সঙ্গীতশিল্পীর দলে সেদিন রথীন্দ্রচন্দ্রও ছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাদস্পর্শে শিলচরের মাটি ধন্য না হলেও তাঁর সাহিত্য কর্মে শিলচরের উল্লেখ
আমাদের অবশ্যই এক ভালোলাগা উপহার দেয়।’শেষের কবিতা’য় আমরা শিলচরের উল্লেখ পাই অমিত যখন ভাবছে- ‘ পালাই, পাহাড় বেয়ে নেমে গিয়ে পায়ে হেঁটে সিলেট শিলচরের ভিতর দিয়ে যেখানে খুশী, এমন সময় আষাঢ় এলো পাহাড়ে, বনে বনে তার সজল ঘনচ্ছায়ার চাদর লুটিয়ে।’
আবার ‘ছড়া’ কাব্যগ্রন্থের সাত নং ছড়ায় রবীন্দ্রনাথ শিলচর নিয়ে ছন্দ গড়েন।
‘শিলচরে হায় কিলচড় খায়
হষ্টেলে যত ছাত্র,
হাজি মোল্লার দাঁড়ি মাল্লার
বাকি একজন ছাত্র।’
রবীন্দ্রনাথের লেখনীতে শিলচরের উল্লেখ অবশ্যই বরাকবাসীর কাছে এক বিরাট প্রাপ্তি।

তবে শিলচরে না এলেও কবির পাদস্পর্শে বদরপুরের মাটি ধন্য হয়েছিল। ট্রেনে যাওয়ার পথে কবি বদরপুরে ছিলেন কিছুক্ষণ। ওই সময় কাছাড়ের লোক সঙ্গীতশিল্পীরা বদরপুর স্টেশনে কবির সামনে লোকসঙ্গীত ও লোকনৃত্য পরিবেশন করেন।
অনরূপভাবে করিমগঞ্জেও কবির সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য ঘটেছিল অনেকেরই।
বদরপুর থেকে সুরমা মেল করিমগঞ্জে পৌঁছালে ট্রেন যেখানে মাত্র তিন মিনিট দাঁড়ানোর কথা সেখানে রেল কতৃপক্ষের অনুমতিতে সুরমা মেল দাঁড়িয়ে ছিল ২৫মিনিট। প্ল‍্যাটফর্মে রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগদান করেন করিমগঞ্জ গভর্ণমেন্ট হাইস্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ক্ষীরোদচন্দ্র পুরকায়স্থ। তাছাড়া তৎকালীন বিশিষ্ট নাগরিক সতীশচন্দ্র দেব, শ্রীশচন্দ্র দত্ত, প‍্যারীচরণ নন্দী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।ক্ষীরোদচন্দ্র পুরকায়স্থ অভিনন্দন পাঠ করেন।কবিগুরু এরপর সংক্ষিপ্ত ভাষণও দেন।
শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র করিমগঞ্জবাসী কুমুদচন্দ্র লুহর রচনা ‘ করিমগঞ্জে রবীন্দ্রনাথ’ এ এই তথ্যের উল্লেখ রয়েছে। করিমগঞ্জ পাব্লিক হাইস্কুলের পত্রিকা ‘প্রদীপ’ এর রবীন্দ্র-শতবার্ষিকী সংখ্যা, ১৩৬৮ এ এই রচনাটি প্রকাশিত হয়েছিল।

শিলচরের খ্যাতনামা আইনজীবী হেমচন্দ্রের একমাত্র কন্যা বিশ্বভারতীতে যখন সংস্কৃত নিয়ে এম এ পড়ছিলেন তখন তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। খুব দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর অকাল মৃত্যু ঘটে ৯ জানুয়ারি ১৯৩৯ এ। যুথিকা খুব ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। সবাই মুগ্ধ হতো তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতে। তাঁর মৃত্যুর তিন দিন পর প্রিয় যুথিকাকে উদ্দেশ্য করে কবি লিখলেন,
যুথিকা,
এসেছিলে জীবনের আনন্দ দূতিকা,
সহসা তোমারে যবে করিল হরণ
নির্মম মরণ
পারে নি করিতে তবু চুরি
তরুণ প্রাণের তব করুণ মাধুরী,
আজো রেখে গেছে তার চরম সৌরভ
চিত্তলোকে স্মৃতির গৌরব।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, দত্ত পরিবার ও যুথিকার অনুরাগীরা শিলচর নারীশিক্ষাশ্রমে যুথিকার স্মৃতিতে ‘যুথিকা পাঠভবন’ স্থাপন করেন।

শিলচরের কিছু পত্রিকা যেমন আশীর্বাদ স্বরূপ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাণী পেয়ে ধন্য হয়েছিল তেমনি ব্যক্তিগত ভাবে কয়েকজন নিজের খাতায় স্বাক্ষর সহ কবিগুরুর লেখনীতে আল্হাদিত হয়েছিলেন।
শিলচরের ‘সপ্তক’ পত্রিকার জন্য অরুণকুমার চন্দের অনুরোধে কবিগুরু তাঁর আশীর্বাদবাণী প্রেরণ করেন।

সাত বর্ণ মিলে যথা দেখা দেয় এক শুভ্র জ্যোতি
সব বর্ণ মিলে হোক ভারতের শক্তির সংহতি।

হেমচন্দ্র দত্তের বোন ও অরুণকুমার চন্দের স্ত্রী জ্যোৎস্না দত্ত ১৩৪৭ সালে শিলচর থেকে নারীদের পত্রিকা ‘বিজয়িনী’ সম্পাদনা করেন। কবি এর জন্যও পাঠালেন বাণী।

হে বিধাতা
রেখো না আমারে বাক্যহীনা
রক্তে মোর বাজে রুদ্রবীণা।।

রাঢ়িশালের শশধর ও সমরেশের বোন কুন্দরাণী সিংহ যখন শান্তিনিকেতনে ক্লাস সেভেনে পড়তেন তখন কুন্দের খাতায় কবি লিখেছিলেন:

কুন্দকলি ক্ষুদ্র কলি নাই দুঃখ নাই তার লাজ,
পূর্ণতা অন্তরে তার অগোচরে করেছি বিরাজ।
বসন্তের বাণীখানি আবরণে পড়িয়াছে বাঁধা,
সুন্দর হাসিয়া বহে প্রকাশের সুন্দর এ বাধা।

কবিগুরুর সঙ্গে বরাকের যোগসূত্রের অন্যরকম একটি রূপও দেখতে পাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সংবাদ ঘোষিত হওয়ার ২ মাসের মধ্যে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের বিরূপ সমালোচনা প্রকাশিত হয় শিলচরের ‘সুরমা’ পত্রিকার ১৩২০ বঙ্গাব্দের ১৩ মাঘ, ২০ মাঘ ও ২৭ মাঘ সংখ্যায়। এ অঞ্চলের সংবাদপত্রের ইতিহাসে ‘সুরমা’একটি উল্লেখযোগ্য নাম। ‘রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি’ শীর্ষক সমালোচনা নিবন্ধে বিস্তারিত ভাবে এর সমালোচনা করা হয়। পরে ‘সুরমা’য় তিন কিস্তিতে এই সমালোচনার প্রতিবাদে উপেন্দ্রকুমার কর এর দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে তিনি আরও প্রবন্ধ পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু সুরমায় প্রকাশিত হয়নি। পরে উপেন্দ্রকুমার তাঁর প্রবন্ধগুলোকে ” ‘গীতাঞ্জলি’-সমালোচনা(প্রতিবাদ)” নামে গ্রন্থাগার হিসাবে প্রকাশ করেন। তিনি বইটি রবীন্দ্রনাথের কাছেও পাঠিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এর প্রাপ্তি স্বীকার করে উপেন্দ্রকুমারকে চিঠিও লিখেছিলেন।
উপেন্দ্রকুমার তাঁর প্রবন্ধে ‘গীতাঞ্জলি’র নিরর্থক বিরোধিতার জন্য রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন।

“সমালোচক বিদ্রূপচ্ছলে রবিবাবুকে একাধিক বার “কবি রবি”এই উপাধি দ্বারা বিশেষিত করিয়াছেন। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি এই অদ্যকার পরিহাস-বাক্য অচিরে সত্যভাবে গৃহীত হইয়া অমর হইয়া যাইবে;- আমি বিশ্বাস করি এই কবি রবির প্রতিভা-রশ্মিই আকাশের সৌর রশ্মির ন্যায় দেশগত জাতিগত সকল ভেদের কৃত্রিম বিভাগ-রেখা মুছিয়া দিয়া সমগ্র সভ্য জগতকে আলোকিত করিয়া সেই একমেবাদ্বিতীয়মের সম্বন্ধ সূত্রে গ্রথিত করিয়া মানবজাতিকে এক অপূর্ব্ব নবজীবনের আনন্দে কৃতার্থ করিবে।”
বলা বাহুল্য উপেন্দ্রকুমার এর ভবিষ্যতবাণী সত্য বলে প্রমাণিত।রবি আজও আকাশে উদ্ভাসিত। আমাদের হৃদয় সিংহাসনে কবি আজও পরম আদরে বিরাজিত।
“হৃদয় দেবতা রয়েছো প্রাণে
মন যেন তাহা নিয়ত জানে।”

তথ্য সংগ্রহ
নীল-সোনালির বাণী
রবীন্দ্র-অসম সম্পর্ক: উষারঞ্জন ভট্টাচার্য
বরাক-সুরমা উপত্যকায়’গীতাঞ্জলি’কাব্যের আলোচনা-সমালোচনা: অমলেন্দু ভট্টাচার্য
দশরূপক নাট্যোৎসব ২০০৫
স্মারক গ্রন্থ
তথ্য সংগ্রহে সাহায্য করার জন্য অমলেন্দু ভট্টাচার্যকে বিশেষ ধন্যবাদ

Comments are closed.