উনিশের কিছু কথা
উনিশ আমার মুখের ভাষা
উনিশ যে চন্দ্র তারা
উনিশ আমার বাঁচার লড়াই উনিশ যে প্রাণের সারা….
১৯৬১ সাল। বাঙালির মাতৃভাষা বাঁচিয়ে রাখার আন্দোলনের এক ঐতিহাসিক সাল। বরাক উপত্যকার বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। ভাষার অধিকার আদায়ের প্রতিবাদী সুর। বাঙালির আত্মিক চেতনার উজ্জ্বলতম প্রকাশ। আসামের বহুভাষিক চরিত্রকে অস্বীকার করে উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং অনঅসমীয়া জাতিগোষ্ঠীর মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে জোর করে অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার যে চক্রান্ত তার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা এবং অবশেষে এগারোটি তাজা প্রাণ গুলিবিদ্ধ হয়ে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে বরাকের তথা শিলচরের মাটিকে রক্তস্নাত করে দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করা, যা আবহমান কাল ধরে যে কোন ভাষাগোষ্ঠী তার মাতৃভাষার জন্য অন্তত একবার স্মরণ করবে।
১৯৪৭ সনে দেশবিভাগের পর করিমগঞ্জ মহকুমার বৃহদংশ কাছাড়কে ছেড়ে দিয়ে সিলেট গেল পাকিস্তানে। শিলচর হাইলাকান্দি করিমগঞ্জ নিয়ে তৈরি হল নতুন কাছাড় জেলা। তখন থেকেই কাছাড়ের জন্য বিড়ম্বনার ইতিহাস। স্বাধীনতা লাভের পর আসাম সরকার ঘোষণা করল যে আসাম কেবল অসমীয়াদের জন্য, বাঙালীদের এখানে কোন স্থান নাই। তখন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় প্রায় ২০ লক্ষ এবং কাছাড়ে প্রায় ১০ লক্ষ বাঙালীর বসবাস। অসমীয়া ভাষীদের সংখ্যাও ঠিক তাই। ১৯৫৩ সনে মে মাসে নলবাড়িতে এক জনসভায় অসমীয়া নেতা মতিরাম বরা ঘোষণা করেছিলেন আসামে খাঁটি অসমীয়াদের জনসংখ্যা ৩০ লক্ষ, তবু সেদিন শোনা গেল আসাম অসমীয়াদের জন্য- বঙ্গাল খেদাও। এর কিছুদিন পর থেকেই বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে চলতে লাগলো বাঙালিদের উপর নির্যাতন। বাঙালি বিদ্বেষের জন্যে কাছাড় জেলায় সমস্ত উন্নয়ন বন্ধ হয়ে গেল। গোয়ালপাড়ায় রাতারাতি বাংলা মাধ্যম স্কুল অসমীয়ায় রূপান্তরিত হয়ে গেল। ১৯৫১ এবং ১৯৫৫ সালে পরপর দুবার ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় হিংসার আগুন জ্বলে উঠলো। আক্রমণের একমাত্র লক্ষ্য বাঙালি। আর আন্দোলনের নামে দেওয়া হলো “বংগাল খেদা” আন্দোলন। বাঙালিদের আসাম থেকে হটাও। ১৯৫১ সালে জীবতাত্ত্বিক বিস্ময় ঘটিয়ে রাজ্যে অসমীয়া ভাষার সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়া হল। কেউ কেউ অবশ্য ভিন্নমত পোষণ করে থাকেন। উদ্দেশ্য কেবল একটাই অসমীয়া কে রাজ্যের সহকারী ভাষা করার প্রস্তুতি।
১৯৬০ সনে ভাষাগত বিদ্বেষ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছালো। সমস্ত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা জুড়ে হিংসার আগুনে হাজার-হাজার বাঙালির বাড়ি নিমেষে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। অসহায় শিশু অবলা নারী গোপন হিংসার আক্রমণে প্রাণ দিলেন। বাঙালিরা বাধ্য হয়ে পালালেন কেউ শিলচর কেউ জলপাইগুড়ি কলকাতায় ও অন্যান্য স্থানে। ১৯৬০ সনের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন রাজ্যে ফিকে হয়ে গেলো।কেন্দ্র সরকারও নীরব। অবশেষে বিধানসভায় পাস হয়ে গেল রাজ্য ভাষা বিল।সমগ্র আসামে সরকারি ভাষা হলো অসমীয়া। কেবল কাছাড়ের জন্যে জেলাস্তরে পড়ে রইলো বাংলা ভাষা। কিন্তু আসাম সরকার ছলে-বলে-কৌশলে কাছাড়ে অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৬১ সনের ৫ ফেব্রুয়ারি করিমগঞ্জের তরুণ নেতা আব্দুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে ডাকা হলো সম্মেলন। এই সম্মেলনে ঘোষণা করা হল আসাম সরকার বাংলাকে অন্যতম ভাষা রূপে স্বীকৃতি দিতে হবে। এই সম্মেলনেই গঠিত হল গণ সংগ্রাম পরিষদ এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো প্রয়োজনে ভাষার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত। কিন্তু সংবিধানের ৩৪৭ নং ধারা বলে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দানের প্রার্থনা বিফল হয়ে গেল। এরপর অহিংস সত্যাগ্রহের প্রস্তুতি। অভূতপূর্ব উন্মাদনার মধ্যে সংগ্রাম পরিষদ ঘোষণা করল রক্তে রাঙা উনিশে মে দিনটিকে। ১৫ই মে পৌরসভার চেয়ারম্যান মহিতোষ পুরকায়স্থ ডাকলেন এক জরুরি সভা। সেই সভায় পৌরোহিত্য করলেন শ্রীযুক্তা জ্যোৎস্না চন্দ। শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাবার আবেদন রাখলেন। অবশেষে ১৯৬১ সনের ১৯ মে, ভোর থেকেই শিলচরে স্টেশনে অগণিত সত্যাগ্রহী সকালের ট্রেন আটকে দিয়ে রেললাইনে অবরোধ তৈরী করলেন। আওয়াজ উঠল বন্দেমাতরম, মাতৃভাষা জিন্দাবাদ, জান দেব জবান দেবনা। দুপুরে অবস্থা আরো চরমে। পুলিশ লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়েও অবস্থাকে সামাল দিতে পারল না। এদিকে তারাপুরের রাস্তায় তখন একটি ট্রাকে ধরলো আগুন। দুপুর দুটো বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট-অবস্থা পুলিশের আয়ত্তের বাইরে। উচ্চারিত হলো ফায়ার। গুলিবিদ্ধ হয়ে রক্তে ভেসে গেল শিলচরের রেলস্টেশন। এরপর তো যা হয় চারিদিকে উন্মাদনা-আতংক- এবং অবশেষে শোক মিছিল- কারফু-সব মিলে পৃথিবীর বুকে ভাষার জন্য ১১ শহীদের আত্মবলিদানের এক বিরল ইতিহাস।এই এগারো শহীদ হলেন কমলা ভট্টাচার্য (১৬), শচীন্দ্র পাল (১৯), চন্ডীচরণ সূত্রধর (২২), হিতেশ বিশ্বাস (২৩), কানাইলাল নিয়োগী (৩৭) কুমুদ দাস (১৮), সুনীল দে সরকার, সত্যেন্দ্র দেব (২৪), সুকোমল পুরকায়স্থ (৩৬), তরণী দেবনাথ (২১), বীরেন্দ্র সূত্রধর (২৪)।
সংক্ষিপ্তভাবে বলতে গেলে উনিশে মে আন্দোলনের উপর ভিত্তি করে যেটুকু ইতিহাস পাওয়া যায় তা হলো আসামে ১৯৬০ সালে ২৪শে অক্টোবর একমাত্র অসমীয়া ভাষাকে রাজভাষা করে বিধানসভায় বিলটি গৃহীত হয়েছিল এবং এই আসাম রাজ্য ভাষা বিল ১৯৬০ সালে ১৭ ডিসেম্বর রাজ্যপালের অনুমোদন পায়। ১৯৬০ সালেই পয়লা জুলাই থেকে ৩রা জুলাই বরাক উপত্যকায় নিখিল আসাম বাংলা ভাষা ও অন্যান্য অনঅসমীয়া ভাষা সম্মেলন হয়েছিল চপলাকান্ত ভট্টাচার্যের পৌরহিত্যে।
আবার এই ভাষা বিলের প্রতিবাদে ১৯৬০ সালের ৫ ও ৬ নভেম্বর হোজাইয়ে নিখিল আসাম বঙ্গভাষী সম্মেলন হয়। ১৯৬১ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী করিমগঞ্জে রাজ্য ভাষা প্রশ্নে উপত্যকার প্রথম জন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলা ভাষাভাষী মানুষ চেয়ে ছিলেন ৬১ এর সংশোধিত ভাষা আইন। তাহলো বরাক উপত্যকার সব স্তরের কাজকর্মে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হবে। সেসময় আসামের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বিমলা প্রসাদ চালিহা। তিনি কিন্তু বরাক উপত্যকার বদরপুর নির্বাচন কেন্দ্র থেকে বিধানসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৬১ এর ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল বিভিন্ন সংগঠন তারমধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হল- কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ, নিখিল আসাম বাংলা ভাষাভাষী সমিতি, কংগ্রেস ভাষা সংগ্রাম সমিতি, ছাত্র যুব সংগঠন এবং কমিউনিস্ট পার্টি ও প্রজাতান্ত্রিক দল। ১৯৬০ সালের এই ভাষা বিলের প্রতিবাদে কাছাড় ছাড়া আরও বিভিন্ন স্থানে কালো দিবস পালিত হয়। শিলংয়ের পার্বত্য নেত্রী সম্মেলনের সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালিত হয় এবং চল্লিশ হাজার নরনারী শিলংয়ের পথে পথে মিছিল করে বিক্ষোভ দেখায়।
এভাবেই জন্ম নিতে থাকে ১৯শে মে। ১৯শে মে ইতিহাস হয়ে যাওয়ার পর শিলচর রেল স্টেশনে সত্যাগ্রহীদের ওপর পুলিশের গুলি চালনার পরিপ্রেক্ষিতে মেহরোত্রা কমিশন গঠন হয়। সে সময় আসাম হাইকোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতি ছিলেন গোপালজি মেহরোত্রা। তারপর নির্মল চন্দ্র চ্যাটার্জির
নেতৃত্বে বেসরকারি তদন্ত কমিশন। উল্লেখ্য একষট্টির ভাষা সমস্যার সমাধানে ত্রিসূত্র ফর্মুলার মাধ্যমে সংবিধানের ৩৪৭ ধারা সংশোধনের দাবি জানিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সেসময়ের মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধানচন্দ্র রায়। তারপর ১৯৬৬ এর ১৫ই এপ্রিল আসামের সংশোধিত ভাষা আইন প্রয়োগ হয়।
১৯৬১ এর ১৯শে মের পর বরাকের নদী দিয়ে কত জল গড়িয়ে গেল কিন্তু আসল ঘটনার কোন বিচার, কোন রিপোর্ট বা সেরকম কোন ইতিহাস সরকারি স্তরে প্রকাশ পেল না। তাই আজও ভাষার জন্য চলছে লড়াই, নাগরিকপঞ্জি নিয়ে লড়াই, নিজভূমিতে আটকে থাকার লড়াই, ভাষা বিপন্ন বলে লড়াই, এক দিশেহারা অবস্থা বরাক উপত্যকার বাংলাভাষাভাষী মানুষদের। কখনও কখনও চিৎকার উঠছে অসমীয়া ভাষার আগ্রাসন- ভাষিক সংখ্যালঘুদের মনে অজানা ভয়। কেউবা আবার ভিটেমাটি ছেড়ে পরবাসী।
প্রতিবছরই গানে-কবিতায় নাটক মিছিলে স্লোগানে ১৯শে মে উদযাপিত হচ্ছে। শহীদদের নিয়ে আলোচনা সভা, স্মরণ সভা এবং নানা পরিকল্পনা। তা সত্ত্বেও কোথায় যেন বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষাভাষী মানুষরা এক চোরাবালির স্রোতে হারিয়ে যাওয়ার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। এ বড় অসহায় অবস্থা। তবে আমরা আশাবাদী এ অচলাবস্থা এক দিন কাটিয়ে উঠতে পারবে উপত্যকাবাসী। সব ভাষাই সমান মর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে, জয় হবে মানবতার-মনুষ্যত্বের।
Comments are closed.