Also read in

Eid Mubarak

This is a guest article and has been penned in Bengali

”ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন্‌ আসমানি তাগিদ ।।”
বিশ্বের মুসলিম ধর্মাবলম্বী নর-নারীরা দীর্ঘ এক মাস যাবৎ সিয়াম পালনের পর মনের পশুবৃত্তিকে বিনাশ করে, সুন্দর চরিত্র সুষমা হওয়ার আনন্দে, প্রতিনিয়ত জীবন বৈতরণীর নানা প্রতিকূলতা, দুঃখ-কষ্ট, বেদনা সব ভুলে পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হবার আনন্দ মহোৎসব ঈদ।আরবি শব্দমূল ‘আউদ’ থেকে এসেছে ঈদ যার অর্থ ‘বার বার ফিরে আসা’ বা অন্য কথায় খুশির উৎসব।আরবি বর্ষপঞ্জিকা অনুযায়ী রমজান মাসের অন্তে সাওয়াল মাসে আকাশের কোণে এক ফাঁলি বাকা চাঁদ দেখামাত্রই শুরু হয় আনন্দের ফল্গুধারা অর্থাৎ প্রতিবছরের সাওয়ালের মাসের প্রথম দিন ইসলামধর্মালম্বী লোকেরা ইদ -উল -ফিতর পালন করেন।ঈদ মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় উৎসব। সারা বিশ্বের মুসলমানরা দিনটি আনন্দ উৎসবের মধ্যে দিয়ে উদযাপন করে। সাক্ষাৎ,কোলাকুলি, কুশল বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে এ দিনটিতে ছোট-বড়, ধনী–দরিদ্র, আমির-ফকির সব ভেদাভেদ ভুলে পরস্পরের মেলবন্ধনের মধ্যে দিয়ে এক কাতারে সামিল হয়।ঈদ প্রতিটি মুসলমানের ঘরে ঘরে নিয়ে আসে নির্মল আনন্দ।
বৈচিত্রময় মানব জীবনে ক্লান্তির অবসানে আনন্দ বয়ে আনে উৎসব।মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশে অন্যান্য সামাজিক উৎসবের তুলনায় ধর্মীয় উৎসবের গুরুত্ব সব থেকে বেশি।পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মানুসরণকারী মানুষেরা আপন ধর্মীয় ভাবাবেগে বৎসরের বিশেষ কোন দিনকে নিদৃষ্ট করে তাতে আনন্দে মেতে উঠেন।সংস্কৃতি ও সামাজিক পরম্পরায় বছরে বিভিন্ন উৎসব পালিত হলেও ধর্মীয় উৎসবগুলি পৃথকভাবে স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের দাবি রাখে।বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধে উৎসব এক অনন্যমাত্রা এনে দেয়। সহমর্মিতা,মমত্ববোধ,বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ জাগাতে উৎসবগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা বহন করে।আর পবিত্র ঈদ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়।
ইসলামী পরিভাষায় ‘ঈদ’ শব্দের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। সারা বিশ্বের মুসলিমগণ বছরে দু’দিন যেমন ঈদ উল ফিতর ও ইদুদ্দোহা’ উৎসব পালন করে থাকেন।রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে বছরের দু’টি নির্দিষ্ট দিনে ঈদ উৎসব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন।ঈদ সম্পর্কে পবিত্র হাদিসে বর্ণিত আছে যে সাহাবা আনাস (রা) বলেন : ‘রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) যখন মদিনায় উপস্থিত হলেন, তখন তিনি দেখতে পেলেন যে, মদিনাবাসীরা দু’টি জাতীয় উৎসব পালন করে। আর এ জাতীয় উৎসব পালনার্থে তারা মূলত খেল-তামাসা ও আনন্দানুষ্ঠানের আয়োজন করতো।’ রাসূলুল্লাহ্ সা: তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা এই যে দু’টি দিন জাতীয় উৎসব পালন কর এর মূল উৎস ও তাৎপর্য কী?’ তারা বলল : ‘ইসলামের পূর্বে জাহিলিয়াতের যুগে আমরা এ উৎসব এমনি হাসি-খেলা ও আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমেই উৎযাপন করেছি, এখন পর্যন্ত সেটাই চলে আসছে।’ এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘আল্লাহ্তায়ালা তোমাদের এ দু’টি উৎসব দিনের পরিবর্তে এরচেয়ে উত্তম দু’টি দিন ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা দান করেছেন। অতএব, পূর্বের উৎসব বাদ দিয়ে এ দু’টি দিনের নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানাদি পালন করতে শুরু কর।” (আবু দাউদ ও মুসনাদে আহমদ)
ইসলাম ধর্মীয় উৎসব বা সংস্কৃতিতে তাওহিদ, রিসালাতের চেতনায় উজ্জীবিত এবং ইহ-পারলৌকিক শান্তি-মুক্তির লক্ষ্যে নিবেদিত।জীবনের সব দুঃখ-যাতনা ও বৈষম্য-বঞ্চনা ঘোচাতে পারে না বছরের  দুটি মাত্র ঈদ; কিন্তু সবকিছুর ভেতর দিয়েও একটুখানি আনন্দ, একটুখানি সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সম্প্রীতির নজির সৃষ্টি করতে পারে পবিত্র ঈদ।দীর্ঘ একমাস যাবৎ গোপনীয় ভাবে ইবাদত করার পর পুরস্কার প্রাপ্তির দিন ঈদ।সম্মিলিত ভাবে একই কাতারে আমির ফকির গোত্র, বংশ নির্বিশেষে ঈদের ওয়াজিব নামাজ আদায় কর‍তে হয়। প্রিয়নবীর (দঃ) নবুওয়াতের পূর্বে আইয়্যাম জাহিলিয়্যাতের সময়ের আরবীয়দের পালিত ধর্মীয় উৎসবে অবাধে মদ,জুয়া, তীর, লটারি ইত্যাদি অবাঞ্ছিত অবৈধ ক্রিয়াকলাপ নিমজ্জিত থাকত তাদের পালিত উৎসবে, ফলস্বরুপ তৎকালীন সময়ে আর্থিক সমতা,অন্যান্য ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করা হত।ইচ্ছে সত্বেও বিভিন্ন প্রতিকূলতায় সেইসব উৎসবের আনন্দে সবাইকে নিয়ে মেতে উঠা সম্ভব হত না।মহানবী কর্তৃক (দঃ) আল্লাহ প্রদত্ত ঈদোৎসবে পৃথিবীতে বয়ে আনে সাম্যের পরশ, বিভেদের মাঝে ঐক্য,ভ্রাতৃত্ববোধ চেতনা।মানুষে মানুষে মিলনের মধ্য দিয়ে দূর হয় অমানবিকতা ও বিদ্বেষ-বিভেদের পাতানো যত নিষ্ঠুরতার খেলা।
 ইসলামিক উৎসবের তাৎপর্য্য বাহ্যিক আড়ম্বরতা ব্যতিরেকে ইবাদতের সঙ্গে আড়াআড়ি ভাবে সম্পর্কযুক্ত।রমজানের কৃচ্ছ সাধনায় মানুষকে না খেয়ে থাকার কষ্ট বুঝতে সাহায্য করে।এতে দরিদ্র মানুষের ক্ষুধার যন্ত্রণা সহজে উপলব্ধি করা যায়।ঈদের আনন্দ কেবল নিজের এবং নিজের পরিবারের মধ্যে সীমিত না করে এই আনন্দকে যথা সম্ভব সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া, সকলের সাথে ভাগাভাগি করে নেওয়ার মধ্যে দিয়েই ঈদের আনন্দ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।আমাদের আশপাশে অনেক দরিদ্র মানুষ আছেন যারা ঈদের দিনে নতুন পোশাক ক্রয় করা তো দূরের  নিয়মমাফিক প্রতিনিয়ত তাদের ঘরে উদর পূর্তির জন্য সামান্য খাবারও থাকে না। রমজানের একমাসই তারা রোজা থাকার কারণে শুধুমাত্র অভুক্ত থাকে এমন নয়, মাঝে মধ্যেই দিনে রাতে তাদের অভুক্ত থাকতে হয়।সুতরাং ঈদ তাদের জন্য নতুন মাত্রায় দুঃখ বয়ে আনে ।এদের জন্য কবির ভাষায়-“অভুক্ত সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?’’তাই আমাদের আশেপাশের দরিদ্র মানুষদিগকে নিয়ে ঈদের আনন্দে সামিল হওয়া ধনীদের একান্ত কর্তব্য।কেউ যদি শুধু আপনার একান্ত আপনজনকে নিয়ে আত্মসুখ অনুসন্ধান করার প্রয়াসে ঈদ পালন করেন, তাহলে তার ঈদ ইসলামি নীতি আদর্শ অনুযায়ী পালন করা হবে না।আমাদের মনে রাখতে হবে ঈদ উৎসব সার্বজনীন। সবাইকে সম ভাবে আনন্দ পাইয়ে দেওয়ার প্রয়াসই এই ঈদের স্বার্থকতা।ঈদ মানে আত্মার পরিশুদ্ধি, ধনী-গরিব,উঁচু-নিচু সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সৌহার্দ্য ও সংহতি প্রকাশের এক উদার উৎসব।তাই প্রতিবছরের ঈদুল ফিতর প্রেম-প্রীতি,শ্রদ্ধা,ভালোবাসার এক পূণ্যময় বন্ধনের সাক্ষী হয় পৃথিবী।
 ইদের দিনের প্রত্যুষ্যে প্রত্যেক নর-নারী ওয়াজিব গোসল সারেন।পুরুষদের  মহানন্দে মিষ্টিদ্রব্য মুখে দিয়ে গৃহে থাকা সবচেয়ে উত্তম কাপড় পরিধান করে ইদগাহ অভিমুখে রওয়ানা হতে হয় এবং সেখানেই ধনী-গরিব সকলে মিলে একই কাতারে ঈদের সালাত আদায় করেন।সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সামর্থ্যবান লোকের সালাতের পূর্বেই ফিৎরা আদায় করা ওয়াজিব।পবিত্র হাদিসে ফিৎরা আদায়ের অনেক ফজিলত বর্ণিত আছে।রমজান মাস জুড়ে সিয়াম পালনের পর ঈদের দিন যাতে ধনী-গরিব উভয়ে উত্তম পোশাক ও উন্নতমানে খাবার খেতে পারে; অন্যান্য সময়ের মতো অভাব অনুভব করতে না হয় সে জন্যই অভাবী ও গরিব-দুঃখীদের মাঝে  ফিতরা বিতরণ ইদের সালাতের পুর্বে আদায় করা আবশ্যক।উপরন্তু রমজানের মহিমান্বিত পুর্ণ্যলগ্নে অনেকেই নিজের অর্জিত সম্পদের জাকাত আদায় করেন ফলস্বরুপ ধনী গরিব সমহারে ঈদের আনন্দে সামিল হতে পারেন।সব ভেদাভেদের প্রাচীর ভেঙে সাম্য,সৌহার্দ্য,ভালবাসায় একে অপরকে গলা জড়িয়ে নেওয়ার শিক্ষা দেয় পবিত্র ঈদ। মাহে রমজানে মিথ্যাচার অনুশীলনের যে দুর্লভ সুযোগ নিয়ে আসে তার উদ্দেশ্য শুধু কৃচ্ছ সাধনায় সীমিত নয় বরং আমাদের অন্তর আত্মার প্রকৃত বিশুদ্ধতা লাভের পথ প্রসস্থ করে প্রকৃত মানবের উত্তম চরিত্রাবলী অর্জনের শিক্ষা দেয়।
 পরিশেষে বলব,ঈদোৎসবে যেভাবে সাম্য সমতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের দ্বার উদারতায় উন্মুক্ত করে দেয়, তা যেন বছরের প্রত্যেক দিনই একইভাবে উন্নতির দিকে ধাপে ধাপে এগোয়।মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা, জগতের সব মানুষের সুখ-শান্তি, কল্যাণ ও উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি।জীবনে চলার পথে মুসলমানদের আত্মশুদ্ধি, সংযম, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির পরিবেশ পরিব্যাপ্তি লাভ করুক—এটাই হোক ঈদ উৎসবের ঐকান্তিক কামনা। তাই আসুন, ঈদের নির্মল আনন্দ ছড়িয়ে দিতে সবার মনে-প্রাণে; বুকে বুক মিলিয়ে,সবাই সবার হয়ে,সমস্বরে সকলে বলি ‘ঈদ মোবারক আস্-সালাম।’

Yonous Amin Barbhuiya is a teacher by profession, and he wrote this piece on our request. We thank him for his contributory article.

Comments are closed.