Also read in

A Special feature on Saraswati Puja

আবার বাজুক তোমার বীণা

ওঁ সরস্বতৈ নমো নিত্যং ভদ্রকাল্যৈ নমো নমঃ বেদ……..। আজ বসন্ত পঞ্চমী। তাই ঘরে ঘরে, স্কুল-কলেজ, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, ক্লাবে, ব্যাংকে আজ বাণী বন্দনার মন্ত্রোচ্চারণে আকাশ-বাতাস মুখরিত। চারপাশের এই পবিত্র অপার্থিব পরিবেশ সকল শিক্ষার্থীর কাছে তো বটেই- সকল নর নারীর কাছেও সমান গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাক্য, বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান, সংগীত, কৃষ্টি সংস্কৃতি এবং সকল রকমের শিল্পকলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতী দেবী। গভীর শ্রদ্ধা, একাগ্রতা আর সৎচেষ্টার দ্বারা প্রকৃত জ্ঞানার্জনই হল এই দেবী পূজার মূল কথা তথা সার্থকতা।

এই পূজা বাঙালি হিন্দুদের একটি পবিত্র উৎসব। শুধু বাংলায় নয়, উত্তর, পূর্ব, মধ্য ও দক্ষিণ ভারত ছাড়াও ভারতের বাইরে যেমন নেপাল, জাপান, মায়ানমার, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি দেশেও এই পূজা প্রচলিত। তবে স্থান কাল পাত্র ভেদে কোথাও দেবী দ্বিভূজা আবার কোথাও চতুর্ভূজা। দ্বিভূজা দেবীর হাতে বীণা আর পাশে থাকে পুস্তক, লেখনী ও মস্যাধার। দেবী এখানে হংসবাহনা। দেবী শ্বেতবর্ণা, শ্বেতাম্বরা, মুক্তাহার শোভিতা, শ্বেতপদ্মাসনা ও স্বেত হংসবাহনা। কিন্তু চতুর্ভূজা দেবী ময়ূর-বাহনা। তিনি অক্ষমালা, বেদ ও বীণাধারিনী। আমরা এই দেবী পূজার প্রথম উল্লেখ পাই ঋগ্বেদে। পরবর্তী কালে দেবী ভাগবত পুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ , স্কন্দপুরাণ, পদ্মপুরাণ ইত্যাদি নানা পুরাণেতো বটেই, এমনকি রামায়ণ মহাভারত ইত্যাদি মহাকাব্যেও এই দেবীর উল্লেখ আছে। তবে এই দেবী পূজার বহুল প্রচলন শুরু হয় বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে। বেদের যুগ থেকেই তিনি জ্ঞান, সংগীত ও সকল রকম শিল্পকলার দেবী হিসেবে স্বমহিমায় অধিষ্ঠাতা। তিনি ব্রহ্মা প্রিয়া এবং ব্রহ্মার স্ত্রী। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,বেদ মতে ব্রহ্মার দুই স্ত্রী- সাবিত্রী ও গায়ত্রী। তবে গায়ত্রী ও সরস্বতী দেবীর মন্ত্রে সাদৃশ্যগত মিল থাকায় সরস্বতী দেবী গায়ত্রী দেবী বলে উল্লিখিতা। অনেক স্থলে এর পরিপূর্ণ ব্যাখ্যাও আছে। দেবীর জন্ম বিষ্ণুর জিহ্বাগ্র থেকে। আর ওই জন্মেরও পূর্বজন্মে তিনি শিবের চতুর্থ মুখ থেকে উৎপন্না বলে জানা যায়। দুই জন্মেই তিনি ব্রহ্মাকে প্রতি রূপে গ্রহণ করেন।

কথিত আছে, সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা যখন একে একে ত্রিগুণাদি অর্থাৎ
সত্ত্ব-রজঃ-তম, মহতত্ব, অহংতত্ব, পঞ্চভূত, ষড়রিপু সহ ব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু সৃষ্টি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন- তখন তিনি অনুভব করেন যে যথার্থ জ্ঞান বিনা এ সৃষ্টি মূল্যহীন। কারণ যেকোন সৃষ্টির প্রাণই হল জ্ঞান। সঙ্গীত, শিল্পকলা, বিদ্যা,বুদ্ধি- চেতনা যার সহচর। জগতের সাম্য রক্ষার জন্য সৃষ্ট ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদি সকল কিছু বোধের শিকড় প্রোথিত সঠিক জ্ঞানের গভীরে। এই ভাবনাতেই যখন বিচলিত ব্রহ্মদেব- তখন দেবী সরস্বতী আবির্ভূতা হয়ে তাকে সৃষ্টির কাজে সাহায্য করেন। ব্রহ্মা খুশি হয়ে তাকে পূজা করেন এবং ভারতের সনাতন ধর্মের যে মূল স্তম্ভ বেদ- তা রক্ষার ভার দেবীকে অর্পণ করেন।’বেদ’ শব্দের উৎপত্তি ‘বিদ’ ধাতু থেকে। বিদ মানে জানা অর্থাৎ জ্ঞান। তাই বেদ মানে অনন্ত জ্ঞান রাশির ভান্ডার। তাই বেদ কোন একক মহাপুরুষের রচিত গ্রন্থ নয় অথবা কোন সম্মিলিত জ্ঞানীগুণীর গ্রন্থও নয়। বেদ মানে প্রাচীনকালের সত্যদ্রষ্টা মুনি-ঋষিদের প্রত্যক্ষ উপলব্ধ আত্মজ্ঞানের ফসল রাশি। ‘সরস্বতী’ নামের অর্থও সেই পরিচয় বহন করে।
সর অর্থে সার আর স্ব অর্থে নিজ। অর্থাৎ উপনিষদের সেই বাণী ‘আত্মানং বিদ্ধি’ – নিজের স্বরূপকে জানা। এই বেদ রক্ষার জন্য দেবীকে একবার নদী রূপ ধারণ করতে হয়েছিল। পুরান মতে, দেবাসুরের সংগ্রামে যখন বারবার অসুরেরা পরাজিত হচ্ছিল, তখন এক সময় তাদের সন্দেহ হয় যে ওই বেদের জন্যই দেবতারা বারবার যুদ্ধে জয়ী হচ্ছেন। অতএব বেদ চুরি করতে হবে। যেই ভাবা সেই মতো কাজ। একদিন দেবী সরস্বতী যখন সুরের জাদুতে বিভোর হয়ে বীণা বাজাচ্ছিলেন- ঐ সময়ে অসুরেরা বেদ চুরি করে। অন্তর্যামী দেবী তা জানতে পেরে তৎক্ষনাৎ নদী রূপ ধারণ করে তাদের পিছু নেন। নদীর বড় বড় ঢেউয়ের আঘাতে বিপর্যস্ত অসুরেরা তখন নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে বেদ নদীতে ফেলে পালায়। এভাবেই দেবী বেদ উদ্ধার করেন। প্রাচীনকালের সেই সরস্বতী নদীই গঙ্গা ও যমুনার সাথে প্রয়াগে এসে মিলেছে। যা আজও এক পবিত্র তীর্থ হিসেবে প্রাচীনকালের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। তবে ধীরে ধীরে কালের বিবর্তনে এবং প্রাকৃতিক কারণে আজ নদীটির গতিপথ রুদ্ধ প্রায়। বেদের যুগ থেকে মহাভারতের যুগ পর্যন্ত এই নদীর উল্লেখ ছিল। প্রাচীনকালে এই নদী তটে মুনি-ঋষিরা যাগ-যজ্ঞ, দানধ্যান, জপ-তপ-ব্রতাদি করতেন। আর সাম গায়কেরা বেদমন্ত্র উচ্চারণে ও সাধনে নিমগ্ন হতেন। তাদের কণ্ঠে সাম সঙ্গীতের প্রতীকই হলো দেবীর হাতে বীণা। সম্ভবত পুণ্যতোয়া এই নদীর নামানুসারেই দেবীর আরেক নাম সুরসাশ্বতী। সু অর্থে ভালো আর রস অর্থে জল বা নদী।

পুরাণের আরেক বহুল প্রচলিত কাহিনী মতে, কশ্যপ মুনির ছেলে প্রবল পরাক্রমশালী অন্ধকাসুরকে দমন করার উদ্দেশ্যে এবং জগতের সার্বিক কল্যাণার্থে ত্রিদেব অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব আরও বেশি শক্তির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তখন তাদের সম্মিলিত নয়নের জ্যোতিতে ত্রিদেবীর আবির্ভাব হয়। যাঁরা হলেন মহা সরস্বতী, মহালক্ষী এবং মহাকালী। জগতের সৃষ্টি- স্থিতি- লয়ের মহাশক্তি স্বরূপা। ব্রহ্মার সত্ব শক্তি থেকে উদ্ভূতা মহা সরস্বতী, বিষ্ণুর রজঃ শক্তি থেকে মহালক্ষী এবং শিবের তম শক্তি থেকে মহাকালী আবির্ভূতা হয়ে সৃষ্টি রক্ষার কাজে ত্রিদেবকে সহায়তা করেন। ত্রিদেব তখন এই ত্রিদেবীকে পত্নী রূপে গ্রহণ করেন। ব্রহ্মা সৃষ্টিকর্তা- তাই তাঁর পত্নী হলেন মহা সরস্বতী, বিষ্ণু জগতের পালনকর্তা- তাই তাঁর পত্নী হলেন মহালক্ষ্মী আর শিবের দুষ্টের দমনকারী সংহারক রূপের পত্নী হলেন মহাকালী। ব্রহ্মার সত্ত্বগুণ থেকে দেবী স্বরস্বতীর সৃষ্টি তাই তিনি সত্ত্বস্বরূপা। সত্য, শুদ্ধ, পবিত্রতার প্রতীক। মানব অন্তরে জ্ঞানের আলো জ্বালান বলে তার আরেক নাম জ্যোতির্ময়ী। দেবীর বসন-ভূষণ-বাহন এই সবকিছু মানব জীবনের সার তত্ত্ব বোঝানোর সংকেত।এ তো গেল বেদ-বেদান্তের তত্ত্বকথা। আমাদের এই ক্ষুদ্র সাধারণ জীবনেও এই পূজার মূল্য অপরিসীম। জাগতিক নিয়মে যে-কোন ক্ষেত্রে সফলতা পেতে গেলে চাই ঐকান্তিক চেষ্টা, একাগ্রতা আর নিষ্ঠা।তা সে লেখাপড়া, সঙ্গীত অথবা যে কোন ক্ষেত্রেই হোক। এতে কেউ সফল হয়, কেউ বা ব্যর্থ।সফল সে-ই হয় যে নিষ্ঠা ভাবে অবিচলিত থেকে নিজের লক্ষ্যের দিকে এগোতে থাকে। চেষ্টা, উদ্যম ইত্যাদি রজো-গুণের আয়ত্তাধীন হলেও জ্ঞানের উন্মেষ না হলে অর্থাৎ দেবীর কৃপা না হলে কোন ক্ষেত্রেই সফলতা আসে না।জ্ঞান লাভ বিনা মানবজীবন পশুর সমান। অতএব হে জ্ঞানদায়িনী, হে বীণাপাণি তোমার চরণে কোটি কোটি প্রনাম। বিশ্ব মানবের অজ্ঞানের অন্ধকার দূর করে মাগো আলোর পথ দেখাও। তোমার অমৃতধারার বারি-সিঞ্চনে এই দীন,জীর্ণ, হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবী আবার হয়ে উঠুক মধুময়। বর্তমানের সাথে পুরনো যুগের মেলবন্ধনে জেগে উঠুক এক নতুন বিশ্ব। একরাশ আলোর ঠিকানা। আজকের এই পুণ্য দিনের পুণ্যক্ষণে একটাই প্রার্থনা–

মাগো, একবার ঝংকারো বীণা ধরহ রাগিনী বিশ্বপ্লাবিনী
অমৃত উৎস ধারা।

(লেখিকা বর্তমানে পুনে শহরে বসবাস করলেও মূলত তিনি শিলচরের।অতীতে সাংবাদিকতার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন এবং সোনার কাছাড় পত্রিকায় কর্মরতা ছিলেন।দীর্ঘদিন ধরে প্রবন্ধ গল্প ইত্যাদি লিখছেন)

Comments are closed.