Also read in

A special writeup on the eve of Mahalaya

আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে……….

আকাশটা ভীষণভাবে নীল। তারমধ্যে পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘের আনাগোনা। ঘাসের ডগায় শিশির। গাছের নিচে অগোছালোভাবে ছড়িয়ে থাকা শিউলি ফুল। মাঠের ধারে দূরে কাশফুল।আকাশে বাতাসে মায়ের আগমন বার্তা। সবমিলিয়ে পুজো পুজো গন্ধ। এরই ফাঁকে মহালয়া মানে দুর্গাপূজা এলো বলে!মহালয়া মানে দেবীপক্ষের সূচনা! শিউলির গন্ধ মাখা ভোরে মহালয়ায় যেন বাঙালি মাত্রেই শুনতে পায় মায়ের ঘরে ফেরার পদধ্বনি।

শরতের শিশির ভেজা ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে চন্ডীপাঠ কিংবা মহিষাসুরমর্দিনী যেন বছরের এই বিশেষ দিনটিকে মহালয়া করে তোলে। অন্যভাবে বললে, আমার মত অনেক বাঙালিই হয়তো বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠকে মহিষাসুরমর্দিনী না বলে ‘মহালয়া’ বলতেই ভালোবাসবেন। ১৯৩১ সালে আকাশবাণীর এই মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানটি শুরু হয়। প্রথম ক’বছর অনুষ্ঠানটি ষষ্ঠীর সকালে প্রচারিত হতো। পরে মহালয়ার ভোরকেই অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারের সময় হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। প্রথমদিকে অনুষ্ঠানটি প্রতিবছর লাইভ সম্প্রচার হতো। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের আবেগমথিত কন্ঠে চণ্ডীপাঠ, সংস্কৃত শ্লোক উচ্চারণ, অনবদ্য কন্ঠে এবং সুরে গান, অসাধারণ আবহসংগীত সব মিলিয়ে অনুষ্ঠানটি অনন্য মাত্রা পেয়েছে, বলাবাহুল্য।তাই হয়তো মধ্যেখানে এক বৎসর উত্তম কুমারের ঘোষণায় অন্য এক মহিষাসুরমর্দিনী সম্প্রচারের চেষ্টা করা হলেও বাঙালি সেটা ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। কারণ বাঙালির কান এবং মন বীরেন্দ্র কৃষ্ণের মহিষাসুরমর্দিনী শোনার জন্যই সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে। ১৯৬৬ সালে সম্পাদনা করা মহিষাসুরমর্দিনী এখন পর্যন্ত সম্প্রসারিত হচ্ছে।

মহালয়া মানে পিতৃপক্ষের শেষ এবং দেবীপক্ষের সূচনা। বলা হয়, এসময় আমাদের পূর্বপুরুষদের আত্মা পিতৃলোক থেকে নেমে এসে মর্তলোকে ঘুরে বেড়ান। এদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ নদীতে, সমুদ্রে, পুকুরে পিতৃ-পুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পন করেন। যদিও পুরো পক্ষ জুড়েই এই পর্ব চলে।

অসুর শক্তির কাছে পরাজিত হয়ে দেবতারা স্বর্গলোকচ্যুত হয়েছিলেন। চারদিকে অশুভ শক্তিরা আস্ফালন ছিল। এই অশুভ শক্তিকে বিনাশ করতে দেবতারা একত্রিত হলেন। অশুভ শক্তির বিনাশে এক মহাশক্তির প্রয়োজন হয়ে পড়ল। দেবতাদের তেজরশ্মি থেকে আবির্ভূতা হলেন অসুরবিনাশিনী দেবী দূর্গা। প্রতিষ্ঠা হল শুভশক্তির।দেবীপক্ষের সূচনায় মর্ত্যে শুরু হয়ে যায় শারদোৎসবের আয়োজন।

আর এই আয়োজনের আনুষ্ঠানিক সূচনা যেন মহালায়া। এদিন ভোরে মহিষাসুরমর্দিনী শুনতে যেমন সবাই ভালোবাসে, তেমনি ভোরের আলো ফুটতেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়ার রেওয়াজও অনেকদিনের। শিলচরেও প্রচুর মানুষ বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। সদর ঘাটের ব্রিজ কিংবা তারাপুরের ওভারব্রিজ আকৃষ্ট করে হাজার হাজার মানুষকে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো মানুষগুলো ব্রিজের দিকে ছুটলেও অনেকের কাছেই স্পষ্ট নয়, মহালয়ার সকালে কেন মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে কিংবা ব্রিজে যায়।কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয়, কোথায় যাচ্ছো? উত্তরটা হয়তোবা এমনই হবে,মহালয়া দেখতে। হয়তোবা শিউলির গন্ধমাখা ভোরে আলোর বেণু বাজিয়ে মহালয়ার অন্য এক রূপ ধরা দেয় ওই মানুষগুলোর কাছে।

এ দিনটি অনেকেই অনেক ভাবে পালন করে থাকেন। ছোটবেলায় মাকে দেখতাম, মহালয়া শুরু হওয়ার আগে ঝাড়ু দিয়ে এবং জল ছিটিয়ে ঘর পরিষ্কার করতেন। পরে ধুপ ধুনো জ্বালিয়ে রাখতেন। এদিন সকালে বিশেষ খাওয়ার ব্যবস্থা থাকতো। চায়ের সঙ্গেও বেকারির সুস্বাদু নানা ধরনের বিস্কিট থাকতো। মায়ের ভালোবাসা মিশে বিশেষ খাওয়াটা আরো সুস্বাদু হয়ে উঠত।

মহালয়ার সকালটা অনন্য হয়ে উঠতো বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরার সুবাদেও। সারা বছরের জমানো পয়সা থেকে বন্ধুরা সবাই কিছুটা হলেও নিয়ে যেত একসঙ্গে কিছু খাবার লোভে। সবাই মিলে মিষ্টির দোকানে গিয়ে মিষ্টি খাওয়ার রেওয়াজটাও মিষ্টি অনুভূতি যোগাতো। মহালয়া থেকে ফেরার পথে বন্ধুদের বাড়িতে গিয়ে পুজোর পোশাক দেখার রেওয়াজ ছিল খুব মজাদার। শুধু একজনের নয়, হয়তোবা অনেক জনের ঘরেই ধাওয়া করা হতো পুজোর পোশাক গুলো দেখার ছলে।

এখন দিন অনেক পাল্টেছে। পাল্টেছে বাঙালির জীবনযাত্রা। ব্যস্ততায় ভরা জীবনে মানুষের আর আগের মত সময় নেই। তবুও প্রিয় উৎসব দুর্গাপূজা বাঙালির ব্যস্ত জীবনেও সাত রঙে রাঙ্গিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। সেভাবেই মহালয়া এলে বাঙালি আগে থেকেই রেডিওটা ঠিক করে রাখে। সারাবছর সকালে ঘুম থেকে উঠতে মোবাইলে এলার্ম সেট করতে লাগলেও মহালয়ার ভোরে কোন বাঙালিকে আজও এলার্ম সেট করতে হয় না। ঘুম ভেঙে যায় সময় মেপে। হাত চলে যায় রেডিওর নবে। এক অমোঘ আকর্ষণে আজও ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। ব্রিজে ভিড় জমায় ঠিক আগের মতই। সময়ের হাত ধরে অনেক পরিবর্তন এলেও মহালয়া আজও অনন্য। আজও মহালয়া চুপিসারে কানের কাছে জানিয়ে যায়, দূর্গা পূজার জন্য সারা বছরের অপেক্ষার দিন ফুরিয়ে আসার হিসেব। জানিয়ে দেয়, কোন এক অদৃশ্য জাদু বলে জীবনের সব কষ্ট, যন্ত্রণা, বিদ্বেষ ভুলে পূজোর আনন্দে কটা দিন মেতে ওঠার সময় প্রায় দোরগোড়ায়।

Comments are closed.