Ashu Paul's special writeup on Kinthup - Part 3
এবার ক্রমাগত হাঁটা। সাংপো কোথাও বহুধা বিভক্ত, বিশাল চওড়া, আবার কোথাও পাথুরে পাহাড়ের চাপে শীর্ণকায়া। এগোচ্ছে তো এগোচ্ছেই। প্রতি পদক্ষেপে দেরাদুনের ট্রেনিং অনুযায়ী হিসেব করে নিচ্ছে, কতদিন লাগছে, কত ফুট এগোচ্ছে, কত উঁচু জায়গা, ইত্যাদি। আর সব কিছুই গেঁথে রাখছে স্মৃতিতে। এ এক অসাধ্য সাধন। কখনো নদীর বাম তীর ধরে, আবার যেখানে বাম তীর বেশি খাড়াই, সেখানে নদী পেরিয়ে ডান তীর ধরে এগোতে হচ্ছে। এক নাগাড়ে হাঁটাও যায়না, খানিকটা জিরিয়ে নিতে হয়। তাছাড়া চলার পথে পড়ছে অসংখ্য ছোট আর মাঝারি জলপ্রবাহ। কোনোটা তো বেশ খরস্রোতা। সে গুলো পেরোতে গিয়েও হাজার সমস্যা । ঠাণ্ডার কথা তো আর বলেই লাভ নেই। কিন্তু সবচেয়ে বড় ভয় সঙ্গের সঙ্গীটি। তাকে ছেড়েও যাওয়া যায়না, অথচ ঘুণাক্ষরেও যেন সে টের না পায় কিনথাপের আসল উদ্দেশ্য। দিনের শেষে কোনো গ্রাম বা পর্ণ কুটিরে রাত্রিবাস। শুকনো খড়কুটো সংগ্রহ করে এনে আগুন জ্বালিয়ে জল গরম করা, খাবার সেদ্ধ করে নেওয়া। চুপিসাড়ে সঙ্গীর অলক্ষ্যে থার্মোমিটার ফুটন্ত জলে ডুবিয়ে উচ্চতা বুঝে নেওয়া, আর সেটাকে মনের মধ্যে গেঁথে রাখা। প্রথম রাত কাটলো ডংমুসা গ্রামে। ছোট্ট গ্রাম। গোটা কুড়ি ইয়াক চড়ানো পরিবারের বাস। পরের দিন ঘুম থেকে উঠে আবার হাঁটা। গ্রামবাসীর হাজারো প্রশ্নের জবাব দেওয়াও আরেক ঝক্কি। কোথা অব্দি যাবে? কেন যাচ্ছো? সেখানে কেউ থাকে ? ইত্যাদি। তার পরদিন নুবা, পাংজে প্রভৃতি গ্রাম পেরিয়ে দোরজি দ্রাক গুম্ফা। মাঝারি মাপের এই বৌদ্ধ গুম্ফায় আজকের রাতে শীতের কষ্ট আর খাবার বানানোর কষ্ট কম হবে। কিন্তু বৌদ্ধ লামাদের চোখ এড়িয়ে তার আসল উদ্দেশ্যের কাজ গুলো করতে তাকে সমস্যা পোয়াতে হতে পারে। এখানে ইচ্ছে করেই দিন তিনেক থাকলো তারা। ধর্মীয় অনুষ্ঠান গুলিতে ভক্তিভরে অংশ নিতে হলো। প্রতিটি মুহূর্তেই নিখুঁত অভিনয় করতে হচ্ছে কিনথাপকে। চতুর্থ দিনে আবার বেরিয়ে পড়া। এখান থেকে সাংপো শতধা বিভক্ত হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কত যে তার শাখা। প্রথমেই তারা নদী পেরিয়ে ডান তীরে চলে এলো। এদিকটা বেশ অনুচ্চ এবং তুলনামূলক সুগম। এদিন লাজি, গাৎসা পেরিয়ে এলো একটা বেশ বড় গ্রাম, দ্রানাং। এখানেই রাত কাটালো তারা। বড় একটা নদী এসে মিশেছে উত্তরের পাহাড় থেকে। জল কম, ভাসমান বরফের চাঙর বেশি। পরদিন সুরখার, গাজিউ প্রভৃতি গ্রাম পেরিয়ে জেদাঙে রাত্রিবাস। এর পরের গ্রামটি আরো বড়, সাংগ্রি। পঞ্চাশ মাইলের মত এগিয়ে এসেছে তারা। লুবাং পেরিয়ে ঝাবা গ্রামে আসতেই দেখা গেল, সামনে সুউচ্চ পর্বতশ্রেণীর গভীর উপত্যকায় ঢুকে যাচ্ছে সাংপো। ডান কিংবা বাম, দুই পাড়েই তীব্র খাড়াই। চওড়া কমে গিয়ে বেড়ে গেছে গভীরতা। নদীর পাড় ঘেঁষে এগিয়ে যাওয়া মানে যে কোনো মুহূর্তে পা পিছলে গভীর অতল নীল জলে চিরদিনের মত হারিয়ে যাওয়া। মৃতদেহও কেউ খুঁজে পাবেনা কোনোদিন। দিন কতক থাকতেই হলো এখানে। স্থানীয় মানুষের সাথে গল্পচ্ছলে জেনে নিতে হলো নদীর চরিত্র, তীব্রতা, খাড়াই এবং সম্ভাব্য পথের নির্দেশ। স্থানে স্থানে নদীর ধার ছেড়ে কিছুটা ঘোরাপথে এগোতে হবে। পথ দীর্ঘ হবে, অগ্রগমন হবে কম। কি আর করা যাবে, অন্য কোনো উপায়ও তো নেই।
প্রথম পর্ব পড়তে নিচে ক্লিক করুন :
এভাবেই প্রায় সাত মাস পেরিয়ে যাবার পর কিনথাপ ও তার সহযাত্রীটি গিয়ে পৌছালেন গ্যায়লা জং-য়ের জিলহা গ্রামে। তিব্বতী ভাষায় জং মানে পর্বতশীর্ষে থাকা মালভূমি সদৃশ গ্রাম বা এলাকা। ভূটানেও জং মানে জেলা। ভাষার সাদৃশ্য আছে। কিনথাপের আগেও বার কয়েক চেষ্টা চালানো হয়েছিল সাংপোর গতিপথ খুঁজে নেওয়ার কাজে। সেই সব ক’টি অভিযান শেষ হয়ে গিয়েছিল এই গ্যায়লা জঙে এসে। এর চেয়ে পূর্বদিকে এগোবার সাহস করেননি কোনো অভিযাত্রী। কিনথাপ অবশ্য এই তথ্য জানতেন না। জিলহা গ্রামটি সাংপোর ডান পাড়ে। তার প্রায় উলটো দিকেই সিনযে চোগিয়াল গুম্ফা। নদী পেরিয়ে সেই গুম্ফায় দিন চারেক কাটিয়ে আবার এগোতে লাগলেন দুজনে। নদী এখন পূর্ব অভিমুখ ছেড়ে এগিয়ে যাচ্ছে উত্তরমুখী হয়ে। করাচির সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পনেরো হাজারেরও কিছু বেশি উচ্চতা দিয়ে বয়ে চলেছে রূপসী সাংপো। দুপুরে সূর্যের আলো যখন উলম্ব হয়ে পড়ে তার জলে, তাকানো যায়না। চোখ ধাঁধিয়ে যায়। উত্তাপও বাড়ে তখন সামান্য পরিমাণে। বিকেলে আকাশের নীল বুকে ধারণ করে নেয় নদী। গাঢ় নীল আর সাদা পাহাড়ের চালচিত্রের মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা আকাশনীল সাংপো তখন আকাট মুখ্যুকেও কবি বানিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। সৃষ্টির এক অপূর্ব মাধুর্য তখন ধরা পরে মানুষের চোখের তারায়। কিন্তু কিনথাপ কবি নন। স্রষ্টার অসীম দক্ষতায় গড়া শিল্পকর্ম দেখতে তিনি জীবন বাজি রেখে এখানে আসেন নি। আবার, শুধু লালমুখো ব্রিটিশ সায়েবদের নির্দেশ পালন করতেও তিনি এই প্রাণপাত পরিশ্রম করছেন না। আসলে, হিমালয় তার স্বপ্নের দেশ, সাংপো তার প্রেয়সী। লামাদের ভার বয়ে দার্জিলিং থেকে লাসা আসা যাওয়ার পথে কখন যে তিনি সাংপোর প্রেমে পড়ে গেছেন, তিনি নিজেও জানেন না। তাই জেনারেল ওয়াকারের প্রস্তাব লুফে নিয়ে সেই সাংপোর টানেই সহস্র ভয় শঙ্কাকে তুচ্ছ করে তিনি চলে এসেছেন এই কাজে। এক অমোঘ শক্তির টানে তিনি অকুতোভয়ে শুধু এগিয়েই চলেছেন। সাংপো আবার দিক পাল্টাচ্ছে। খানিকটা পূর্বমুখী গিয়ে দক্ষিণে বাঁক নিলো। পাহাড় এখানে সত্যিই ভয়াল। প্রতিটি পদক্ষেপে মনে হয় এই বুঝি পা হড়কালো। প্রায় সাতশ’ ফুট নীচে, কালচে নীল ফিতের মত সাংপোকে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এ কী ! উত্তর থেকে ছোট্ট একটা নদী এসে সাংপোতে পড়ার সামান্য নিম্ন অববাহিকায় সাংপোকে আর দেখা যাচ্ছে না কেন ? শুধু ধোঁয়ার মত সাদা মেঘের আড়ালে সাংপো গেল কই ? অনেক চেষ্টা করেও নদীর খোঁজ না পেয়ে তারা বাধ্য হয়ে অনেকটা পাহাড় ঘুরে ঘন্টা দেড়েক পর নীচে নদীর কাছাকাছি চলে এলেন। কী আশ্চর্য ! উত্তর থেকে আসা নদীটি আসলে একটি তুষারধারা। তার প্রবল ধাক্কায় এখানে সৃষ্টি হয়েছে এক বিশাল গর্ত। আসলে, বরফের চাঙরের ক্রমাগত চাপেও পাহাড়ের বিশাল শিলা ভাঙতে পারেনি। কিন্তু ক্ষয়ে গেছে মাটি।অধরে মাটি ক্ষয়ে ক্ষয়ে শিলার তলা দিয়ে বয়ে গেছে সাংপো। জল এবং তুষার এসে পড়ছে প্রায় ছয় মিটার গভীর সেই গর্তে, আর তার ফলেই জলকণা ধোঁয়ার মত হয়ে উড়ছে। পুরো এলাকা ছেয়ে গেছে সেই জলকণায় সৃষ্ট মেঘে। এত বড় নদীটা চলে গেছে সেই ধোঁয়াশার আড়ালে। বেশ দীর্ঘ জায়গা অদৃশ্য হয়ে রয়েছে সাংপো। স্থানীয় ভাষায় যার নাম ইয়ারলুং জাংবো। সেই গর্তের কাছাকাছি যাওয়ার সাহস জোটাতে পারলেন না কিনথাপ বা তার সঙ্গীটি। চড়াই বেয়ে ফিরে এলেন উপরে। পাহাড়ি পথ ধরে এগোতে লাগলেন। নদী যাচ্ছে কিছুটা উত্তরমুখী, কিন্তু পথের চিহ্ন কিন্তু পূর্বমুখী, কিনথাপ বুঝলেন, নদী কিছুদূর গিয়ে আবার নিশ্চয় ফিরে এসেছে দক্ষিণে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে হঠাৎ দেখতে পেলেন কালচে নীল জলের এক হ্রদ। জিলহা’য় শুনেছিলেন এই হ্রদের কথা। নাম, কো কালে। তার পার ধরে হাঁটতে লাগলেন দুজনে। সামান্য এগিয়েই পেলেন দুই সুউচ্চ পর্বতের মধ্য দিয়ে এক সঙ্কীর্ণ গিরিপথ। এটাই ‘বেনবা লা’। কিনথাপ বুঝলেন, সঠিক পথেই এগোচ্ছেন তারা। কিন্তু এবার সাবধান হতে হবে। সামনে গভীর গিরিখাত। পা টিপে টিপে নামতে হচ্ছে। নামছেন তো নামছেনই। পায়ের বুড়ো আঙুল ফেটে যাচ্ছে ব্যথায়। প্রতি পদক্ষেপে দেড়-দুই ফুট পাহাড়ি পথ নামতে গেলে বুড়ো আঙুলে প্রচণ্ড চাপ পড়বেই। কিচ্ছু করার নেই। কোথায় গিয়ে এই উৎরাই শেষ হবে কে জানে। টুকটাক কথা বলতে বলতে এগোচ্ছিলেন তারা। কিন্তু এখন আর কেউ কারো কথা শুনতে পাচ্ছেন না। উঁচু থেকে নীচের দিকে ক্রমাগত জল গড়ালে যে শব্দ হয়, সেই শব্দ বাড়তে বাড়তে এখন গর্জনের মত শোনাচ্ছে। একটা বাঁক ঘুরতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল কিনথাপের। প্রায় দেড়শ’ মিটার জায়গা জুড়ে সাংপোর জল হড়হড় করে নেমে যাচ্ছে তীব্র গতিতে। নদীর বুকে থাকা পাথরে পাথরে ধাক্কা খেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে ফেনিল জলরাশি। পরক্ষণেই আবার ঝাপিয়ে পড়ছে নদীতে। মনে হচ্ছে দুধের নদী। আধুনিক জল বিজ্ঞানের ভাষায় এগুলিকে বলে ‘রেপিড’। ওপারে প্রায় দশ হাজার ফুট উঁচু পর্বতশৃঙ্গ আবু জং। আর তারা যেদিকে দাঁড়িয়ে আছেন, এপারেও হাজার নয়েক ফুট উপরে পেমাকো ছুং নামের এক ছোট্ট গ্রাম। গোটা কয়েক লামার বাড়ি। সূর্য এখনো পশ্চিমে পুরোপুরি হেলে পড়েনি, কিন্তু শরীর আর মানছে না। সাথীকে জিজ্ঞেস করে এখানেই রাত্রিবাসের সিদ্ধান্ত নিলেন কিনথাপ। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই গেলেন পাহাড় চূড়ায়। উত্তরপূর্বে এগিয়ে চলা সাংপো তখনও ঝাপসা। আধ ঘন্টার মধ্যেই সাদা বরফে সূর্যের আলো পড়তেই ঝিকমিকিয়ে উঠলো চরাচর। সুগভীর উপত্যকা চিরে সর্পিল গতিতে এগিয়ে চলেছে সাংপোর হিমশীতল জল। দুইপাড়ে খাড়া পাহাড়। ভুবন বিখ্যাত সাংপো গর্জের এটাই সবচেয়ে গহীন উপত্যকা। নদীর তীর ধরে এগোনোর সব আশা ত্যাগ করলেন কিনথাপ। ফিরে এসে লামাদের সাথে আলাপ জুড়লেন। আরো পূর্বদিকে কি কি বৌদ্ধ তীর্থ রয়েছে, পুণ্যশ্লোক বুদ্ধের কি কি বাণী, পুঁথি, থাঙ্কা আর স্মৃতি-অবশেষ রয়েছে ওইসব স্থানে, কি করে কোন পথে যেতে হয়, ইত্যাদি শ্রদ্ধা সহকারে জেনে নিলেন। আলোচনার সময় যত্ন সহকারে খেয়াল রাখলেন যাতে অতিরিক্ত উৎসাহ প্রকাশ না পায়, বা তার আসল উদ্দেশ্য সম্বন্ধে যাতে কারো সন্দেহ না জাগে।
চলবে ……..
দ্বিতীয় পর্ব পড়তে নিচে ক্লিক করুন:
https://barakbulletin.com/bn_BD/do-you-know-about-kinthup-ashu-pauls-special-series-part-2/
Comments are closed.