Also read in

Author Ashish Ranjan Nath writes a memoir for Anandalal Nath

স্মৃতি চারণ: আয়ু পদ্ম পাতার জল! আনন্দ, তোমারও!

হাহাকার আর হাহাকার। বুকের ভেতর যে ‘হায়’ ‘হায়’ অশ্রুত রব উথাল পাথাল করছে! যদি গলা ছেড়ে কাঁদতে পারতাম তবে কষ্ট কিছুটা লাঘব বোধ করতাম। কিন্তু বিলাপ করে কাঁদতেতো পারছি না। বন্ধু বিয়োগে ভেতরটা কি পাথর হয়ে যাবে! জগন্নাথের( চক্রবর্তী) বিয়োগ ব্যথা ভুলতে সময় লেগেছিল অনেক। আনন্দ’র বিয়োগ ব্যথা ভুলি যে কি করে! বড় অসময়ে চলে গেল! কি নিষ্ঠুর আনন্দ! আঞ্চলিক বাংলায় হাস্যরসের (বাস্তব কটাক্ষও) কবিতা, ছড়া দিয়ে যত রস দিয়েছিল, যাবার সময় নিষ্ঠুরভাবে চলে গেল।

মাত্র ৬৩ বছর বয়স কি চলে যাওয়ার বয়স! জন্ডিস তো অনেকের হয়। সেরে ওঠে জন্ডিস- আক্রান্ত রোগী। আসলে জন্ডিস ছিল উপলক্ষ মাত্র! বুঝি, বাস্তব বড় নিষ্ঠুর! কিন্তু মনকে বোঝাবো কি করে, বলো তুমি আনন্দ? জবাব দাও। হাহাকার আর বিলাপের সুরে আকাশ বিদীর্ণ হলেও জবাব পাবোনা জানি।

কত কথা, কত স্মৃতি ভিড় করে আছে মনে। সেসবের টুকরো টুকরো কথা মনে পড়লেই মন যেন বিদ্রোহ ঘোষণা করে বলে- যেতে নাহি দেব। সদাহাস্যময় মুখখানা ওর যতই চোখের সামনে ভাসে, বিলাপ করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। জানি, আয়ু পদ্মপাতার জল।

বন্ধু, তুমি ছিলে অপ্রতিদ্বন্দ্বী তোমার লেখায়। তুমি জানো না, আমার মাসতুতো দাদা রাজস্থানের কর্মস্থল থেকে আমাকে বলেছিল তোমার সব কবিতার বই সংগ্রহ করে ইন্টারনেটে ওকে পাঠাতে। সে বছর কয়েক আগের কথা। তোমাকে কথাটা বলতে মনে ছিল না। আর দাদাকেও পাঠাতে ভুলে গেছি নিজের কর্ম ব্যস্ততায়।

তবে তুমি জানো, বাঁশকান্দির অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ময়না মিয়া মজুমদারের কথা। আমি ওনাকে চিনি না। দেখিনি কোনও দিন। তুমিও চেনো না। দেখোনি। এইতো বরাক বঙ্গের শিলচরের বইমেলার দিন ৩-৪ আগে আচমকা উনার ফোন পাই। অপরিচিত ফোন নম্বরের কল রিসিভ করতেই উনার পরিচয় দিয়ে বললেন, তোমার কবিতার বই সংগ্রহ করতে চান। আমি যেন সহায়তা করি। আমি উনাকে সরাসরি তোমার সাথে যোগাযোগ করতে ফোন নাম্বার দিয়ে দেই। তোমাকে ফোনে যোগাযোগ করেছিলেন। তিন চারদিন আগে ময়না মিয়া আবারও ফোনে বইয়ের হদিশ চেয়েছেন। আমি উনার ফোন শেষে তোমাকে ফোন করি। তুমি রোগ কষ্টে কাতরাতে কাতরাতে জবাবে বলেছিলে, কিছু বই তোমার রেডি হয়ে আছে। পঞ্চায়েত ভোটের ব্যস্ততায় ছাপাখানা প্রচ্ছদ ছাপতে পারছে না। ভোট পর্বের পর প্রচ্ছদ ছাপা ও বাঁধাই হওয়ার পর ময়না মিয়াকে চাহিদার বই দিতে পারবে বলে বলেছিলে। ভোট পর্ব শেষ হবে। প্রচ্ছদ ছাপা, বই বাঁধাই সবই হয়তো হবে, কিন্তু আনন্দ, তুমি কি ময়না মিয়াকে দিতে পারবে!

শুধু কি কবি ছিলে তুমি! ছিলে এক সফল কৃষকও। গত বছর তোমার মেয়ের বিয়েতে প্রথম যখন তোমার বাড়ি যাই, তখন মাটি চাষ করার পাওয়ার টিলার দেখে অবাক হই। স্বভাবগত হাসি হেসে বলেছিলে, মাটি যথেষ্ট আছে। কিন্তু চাষাবাদের মানুষ পাওয়া যায় না। ফসলি জমি বন্ধ্যা হোক তা চাও না বলেই নিজের চাষের ব্যবস্থা করতে কিনেছিলে যন্ত্রটি। চাষ করতে তুমি আনন্দে। তোমার স্বভাব- কাব্যিক গুণে মাতিয়ে রাখতে সবাইকে। মেয়ের বিয়েতে অতিথিদের যেভাবে মাতিয়ে রেখেছিলে তা দেখে আমার মনে হয়েছিল- এ তোমার পক্ষেই কেবল সম্ভব।

বাংলা ভাষা, ব্যাকরণ, ছন্দ ও অলংকার নিয়ে অত্যন্ত সচেতন ছিলে তুমি। তাইতো তোমার আঞ্চলিক বাংলা কবিতা এত জনপ্রিয় ও হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠেছে। একটা কথা মনে পড়ছে। বেশ কয়েক বছর আগের কথা অবশ্য। কাটলিছড়ায় আমার এক বন্ধু প্রবাল কান্তি নন্দীর সামনে একটা কিশোর ছেলে কিছু পয়সার জন্য হাত পাতে। বন্ধুটিও রসিক বড়! ছেলেটির নাম, বাড়ি-ঘর কোথায় এসব কথা জেনে নিয়ে একথা ওকথার পর হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসে, এই তুই কি আনন্দ লাল নাথ এর নাম জানিস? ছেলেটি অকপটে বলে- জানি তো! ওই কবিতা লেখেন যে আনন্দ লাল, তিনি তো! বন্ধুটি অবাক হয়ে বলে তুই কি দেখেছিস আনন্দলালকে? ছেলেটি বলল- দেখিনি। কিন্তু কবিতা শুনেছি। বন্ধুটি আবার বলে- বলতে পারবি একটা কবিতা? ছেলেটি শুনিয়ে দিল দু’তিনটে কবিতা।

তোমার কবিতার জনপ্রিয়তা কোন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল আনন্দ,সে কি তুমি জানতে! মানুষের মনের কথা তোমার কবিতার ছন্দে উঠে আসতো বলেই সব শ্রেণীর মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছিলে।

তোমার অসময়ে চলে যাওয়া বিরাট ছন্দপতন। শুধু এ কথাটাই তুমি বুঝে উঠতে পারোনি। নইলে এভাবে সবাইকে ফাঁকি দিতে পারতে না।

Comments are closed.