Bhom Bhom Tarak Bhom echoes in the Shiva temples as devotees celebrate Maha Shivrati
মন্দিরের বাইরে লম্বা লাইন। লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন বিভিন্ন বয়সের মহিলারা। পরনে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি। হাতে পুজোর থালা। রয়েছে ফুল আর বেল পাতা। ঘটিতে রয়েছে দুধ আর জল। শিব চতুর্দশী মানে মন্দিরে মন্দিরে এমনই সুদৃশ্য ছবি। শত শত মহিলা কিংবা মেয়েরা ভোলানাথের মাথায় দুধ আর বেল পাতা চড়ানোর আশায় মন্দিরে যান। বলা হয়,দেবাদিদেব মহাদেব খুব সহজে সন্তুষ্ট হয়ে যান। শিবরাত্রিকে ঘিরে বরাবরই মানুষের মধ্যে বিশেষভাবে মহিলাদের মধ্যে উৎসাহ আর উদ্দীপনা প্রচন্ডভাবে পরিলক্ষিত হয়। নিষ্ঠার সঙ্গে উপোস করে মহাদেবকে দুধ,জল, ঘি দিয়ে স্নান করিয়ে মাথায় বেলপাতা চড়ালে শিবের মতো বর পাওয়া যায়।এমন বিশ্বাসকে সম্বল করে প্রচুর সংখ্যক অবিবাহিত মেয়েরা শিবের উপোস করে থাকেন। আরো বিশ্বাস, বিবাহিত মহিলারা মহাদেবকে তুষ্ট করতে পারলে জন্ম জন্মান্তরে শিবের মতো বর পাবেন।
ফাল্গুন মাসের চতুর্দশী তিথিতে শিবরাত্রি ব্রত পালন করা হয়ে থাকে। নিয়ম অনুযায়ী (যদিও এ নিয়ম স্থান ভেদে ভিন্ন হয়) রাত্রি জাগরন করে চার প্রহরে চারবার শিব পূজা করতে হয়। হবিষ্যান্ন করতে হয় ঠিক তার আগের দিন। এই পূজায় বিশেষ করে গঙ্গাজল, গঙ্গা মাটি, শুদ্ধ মাটি, বিলল পত্র, ফুল, দুগ্ধ, দধি, ঘৃত, মধু, কলা, নারকেল, বেল, ফলমূল ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। তীর্থের মধ্যে যেমন শ্রেষ্ঠ তীর্থ হিসেবে বলা হয় গঙ্গা, যজ্ঞের মধ্যে যেমন অশ্বমেধ যজ্ঞ সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ, ঠিক তেমনি ব্রতের মধ্যেও শ্রেষ্ঠ ব্রত হচ্ছে শিব চতুর্দশী ব্রত। বলা হয়ে থাকে, এই ব্রত পালন করলে মানুষের ধর্ম, অর্থ কাম, মোক্ষ চতুর্বিধ লাভ হয়ে থাকে।
মন্দিরে মন্দিরে শিব পুজো দিয়ে যেমন এ দিনটি পালন করা হয় তেমনি কেহ কেহ শুদ্ধ মাটি দিয়ে বাড়িতেই শিব লিঙ্গ তৈরি করে পুজো করে থাকেন। একেক জায়গায় একেক ধরনের নিয়ম থাকলেও মোটামুটি সবাই প্রথমে শিব ঠাকুরকে দুধ, জল, ঘি সমেত স্নান করিয়ে তবেই শিবের মাথায় পুষ্প বিল্ব পত্র দিয়ে পুজো করেন।
আজও তার ব্যতিক্রম নয়। এই দিনটির জন্য শিব ভক্তরা অপেক্ষা করে থাকেন। তাই সারা দেশের সঙ্গে বরাক উপত্যকায়ও শিবরাত্রি নিয়ে প্রচণ্ড উৎসাহ রয়েছে। শিব মন্দিরগুলোতে রাত অব্দি চলবে আজ ভক্তদের আগমন।
বরাক উপত্যকায় ছোট-বড় অনেক শিব মন্দির থাকলেও শিব চতুর্দশীর দিন ভুবন পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত শিব মন্দির, বদরপুর ঘাটের সিদ্ধেশ্বর শিব বাড়ি এবং শিলিগুড়ির বরম বাবার আশ্রমে প্রচুর জনসমাগম হয়।
ভুবন পাহাড
বরাক উপত্যকা তথা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এক সুপ্রসিদ্ধ ও সুপরিচিত নাম। শিব ভক্তদের বিশেষ আকর্ষণ স্থল! মহান পুণ্যস্থান! ভুবন পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত সুপ্রসিদ্ধ শিব মন্দিরে পৌঁছার জন্য শিব চতুর্দশীতে হাজার হাজার তীর্থযাত্রীর দল নামে ভুবন পাহাড়ের দুর্গম পথে। শিব ভক্তদের মনোবল এতটাই দৃঢ় থাকে যে দুর্গম পথ সুগম হয়ে উঠে ইচ্ছাশক্তির জোরে। হাতে লাঠি, মুখে শিব স্তুতিগানে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে থাকেন মহাদেব ভক্তরা। সঙ্গে রয়েছে অদম্য সাহস। শিব চতুর্দশীতে অগণিত সাধু-সন্ন্যাসীরাও ভুবন পাহাড়ে চড়েন।
শিলচর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই ভুবন পাহাড়। রাজ্যের বিভিন্ন স্থান এবং বহিঃ রাজ্য থেকে আগত তীর্থযাত্রীরা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ছোট্ট একটি জায়গা মতি নগর থেকে ছোট গাড়ি করে কিংবা পায়ে হেঁটে পানি চৌকি পৌঁছান। এরপর আর গাড়ি চলাচল না করায় ভক্তদের সাত কিলোমিটার উপরে চড়তে হয় হাতের লাঠির সাহায্যে এবং নিজের মনোবলের উপর ভর করে।
মধ্যিখানে সুপ্রসিদ্ধ লক্ষী গুহা মন্দিরও রয়েছে। তবে বলা হয়, যারা অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ এবং একনিষ্ঠ ভক্ত তারাই শুধু এই মন্দিরে পৌঁছাতে পারেন। অনেকে অবশ্য এতো ঝুঁকি না নিয়ে সোজা ভুবন পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত শিব মন্দিরে চলে যান।
পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে উঠতে ‘জয় বাবা ভোলানাথ’, ‘ভম ভম ভোলানাথ’ , ‘শিব শিব ভম’ বাক্যগুলো শুধু মনোবলই যোগায় না, কষ্টটা অনেক অংশে লাঘব করে দেয়। বলা যায়, ভক্তের নিষ্ঠার কাছে পাহাড় চড়ার কষ্টটা হার মেনে যায়। পাহাড়ে উঠার পথে স্থানে স্থানে চা কিংবা অন্য কিছু খাবার বানিয়ে অনেকে এই ভক্তদের খাওয়ান।
ভুবন তীর্থ নিয়ে অনেকেই গবেষণা করেছেন। এক তথ্য অনুসারে, রংমাই, লংমাই ও জেমি গোষ্ঠীভুক্ত হাজার হাজার হিন্দু নাগাদের তীর্থস্থান হচ্ছে এই ভুবন পাহাড়। এই তিন গোষ্ঠীর হিন্দু নাগারা বছরের একটি দিন সুনির্দিষ্ট করে শিবের বন্দনা স্তুতি করতে করতে পুজো দিতে ভুবন বাবার মন্দিরে যান। তাছাড়া চা বাগানের জনজাতি গোষ্ঠীর বৃহৎ সংখ্যক ভক্তের দল পুজো দিতে ভুবন তীর্থে যান। তথ্য অনুসারে, আরো জানা যায়, বুদ্ধ পূর্ণিমার রাতে বুদ্ধ ভিক্ষুরা ভগবান তথাগতের তপস্যা করতে ভুবন পাহাড়ের নির্জন গুহায় আসতেন।
ভুবন পাহাড় সম্পর্কে আরও এক তথ্যে জানা যায়, কামাখ্যা মন্দিরের সঙ্গে তীর্থের একটা যোগসাজশ রয়েছে। জানা যায়, এই কামাখ্যা তীর্থের আদলে একটি শৈবতীর্থ গড়ে তোলারও প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। কামাখ্যার সঙ্গে এমনকি সুরঙ্গপথে ভুবন তীর্থের যোগাযোগ তৈরি করারও চেষ্টা করা হয়েছিল। লোকমুখে এও প্রচলিত রয়েছে, এর ফলস্বরূপ পরবর্তীতে ভুবন থেকে সুরঙ্গ পথে কামাখ্যা যাওয়া যায়।
সব বছরের মতো এ বছরও শিব পুজো দিতে ভুবন পাহাড়ে চড়ছেন অগনিত ভক্তরা। শুরু হয়েছে ভুবন মেলাও।
সিদ্ধেশ্বর শিববাড়ি
বদরপুর ঘাটে বরাক পাড়ে অবস্থিত সিদ্ধেশ্বর শিব বাড়িতে শিব চতুর্দশীর দিন ভক্তদের ঢল নামে। বৃহৎ সংখ্যায় শিবভক্তরা তাদের আরাধ্য দেবতার মাথায় জল, দুধ, বেলপাতা চড়িয়ে তাঁকে সন্তুষ্ট করার প্রয়াসে এদিন এ মন্দিরে আসেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিবেষ্টিত এই মন্দিরের শান্ত পরিবেশে ভক্তদের এক অপরিসীম শান্তির খোঁজ মেলে।
বহু প্রাচীন এই মন্দিরের অপূর্ব সুন্দর এক কাহিনীও রয়েছে। পূর্বে প্রকাশিত হলেও শিব ভক্তদের জন্য এই লেখায় পুনরায় পুরোহিত শ্যামল চক্রবর্তীর কাছ থেকে শোনা এই পৌরাণিক কাহিনীর উল্লেখ করা হলো।
প্রথমে এই অঞ্চলটি পুরোপুরি জঙ্গল ছিল। আমাদের অনেকেরই জানা, বহুকাল পূর্বে কপিল মুনি বলে এক ঋষি ছিলেন। উনার বাবার নাম করদম ঋষি, মায়ের নাম দেবাহুতি। একসময় তিনি এই স্থানে আসেন এবং শিবের ধ্যান করতে শুরু করেন। সেই ধ্যানে তুষ্ট হয়ে শিব তার সন্মুখে প্রকট হন বলে জানা যায়।
এর বহু কাল পরের কথা, গনেশ গিরি নামে এক সন্ন্যাসী হিমালয়ে ছিলেন। তিনি স্বপ্নে দেখেন যে এই স্থানে অর্থাৎ বর্তমান সিদ্ধেশ্বর শিব বাড়ির স্থলে কারোর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে শিব প্রকট হয়েছিলেন এবং এরপর এখানে শিব লিঙ্গ স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু এরপর কোনও পূজা অর্চনা নেই, এমন কি কোনও মানুষ জনও নেই। গনেশ গিরি সন্ন্যাসী সেই স্বপ্নকে অনুসরণ করে এই স্থানে আসেন। এসে সত্যি সত্যি এইখানে শিব লিঙ্গের সন্ধান পান। তিনি শিবের পুজার্চনা করতে শুরু করেন।তখন এইখানে কেবল একটি নদী ছিল আর সব জায়গা জঙ্গলে ভরা ছিল। জনবসতি বলতে কিছু ছিল না। শুধু বদরপুরের শ্রীগৌরীতে কিছু মানুষের বসতি ছিল।
ওইখানের একজন মহাজন এদিকে ঘুরতে এসে এই সন্ন্যাসীকে দেখেন। কৌতুহল বশে সন্ন্যাসীর কাছে আসেন এবং তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর তিনি সন্ন্যাসীকে অনুরোধ করেন শ্রীগৌরীতে তাঁর বাড়িতে যাওয়ার জন্য। কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ ওই রাতে প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল। সন্ন্যাসী যেতে রাজি হননি এই বলে যে সন্ন্যাসী কারো ঘরে রাত কাটাতে পারেন না। মহাজন এরপর ঘরে ফিরে যান। কিন্তু ঘরে ফিরে তিনি মোটেই শান্তি পাচ্ছিলেন না, বরং ভীষনভাবে ভয় পাচ্ছিলেন। কারণ সে রাত্রে সত্যি সত্যি ভীষনভাবে ঝড় তুফান বৃষ্টি হয়েছিল। তিনি শান্তি না পেয়ে সকালে ঘুম থেকে উঠেই আবার ফিরে আসেন সন্ন্যাসীর কাছে। এসে দেখেন সন্ন্যাসী গাছের নীচে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছেন। তার উপরে একটা কম্বল এবং নীচে একটা কম্বল। এত বৃষ্টি হয়েছে অথচ কম্বল দুটো শুকনো। তিনি স্তম্ভিত হয়ে যান এবং তাঁর মনে সন্ন্যাসীর প্রতি ভীষণ ভাবে শ্রদ্ধার উদ্রেক হয়। তিনি সন্ন্যাসীকে অনুরোধ করেন তাঁকে দীক্ষা দেওয়ার জন্য। এরপর গনেশ গিরি সেই মহাজন অর্থাৎ বিষ্ণু প্রসাদকে তাঁর স্বপ্নের কথা জানান, যে বহুকাল আগে এখানে কপিল মুনি শিবের ধ্যান করার পর শিব প্রকট হয়েছিলেন। এরপর কপিল মুনি এখানে শিব লিঙ্গ স্থাপন করেন।
সেই শিব লিঙ্গটি সন্ন্যাসী বিষ্ণু প্রসাদকে দেখান। তখন তিনি নিজে সন্ন্যাসীকে বলেন, “ আমি আপনার জন্য কি করতে পারি?” সন্ন্যাসী তাঁকে উত্তর দেন, “এখানে একটি মন্দির স্থাপন কর এবং আমিও সবাইকে জানাব এই কপিল মুনির পীঠস্থানের কথা”। তারপরেই বিষ্ণু প্রসাদ চৌধুরী প্রথম মন্দির স্থাপন করেন। শিব লিঙ্গের জায়গা খোদাই করে যখন বেদির আকৃতি দেওয়া হয় তখনই দেখা গেল শিব লিঙ্গের নিচে একটা পুষ্পপাত্র রয়েছে।যা থেকে জানা যায় শিবের সঙ্গে কপিলমুনির কথোপকথন, কোনদিন শিব প্রকট হয়েছিলেন ইত্যাদি। জানা যায়, শিব প্রকট হয়েছিলেন চৈত্র মাসের মধু কৃষ্ণা ত্রয়োদশী শতবিশা নক্ষত্র তিথিতে। ওই তিথি উপলক্ষে বারুনি স্নান ও তর্পণে এখানে হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। এদিকে তারপরে সন্ন্যাসী গণেশ গিরি দেহত্যাগ করলে এখানে তাঁর সমাধি দেওয়া হয়। উনার পরে তাঁরই এক শিষ্য মন্দিরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এভাবেই একের পর এক শিষ্য মন্দির পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত এভাবেই চলে। সর্বশেষ সন্ন্যাসী ছিলেন লছমন গিরি। তাঁর পরে আর কোনো সন্ন্যাসী ছিলেন না। ১৯৪৯ সাল থেকে পুরোহিত দ্বারা মন্দির পরিচালিত হচ্ছে।
চৈত্র মাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী শতভিষা নক্ষত্র তিথিতে অনুষ্ঠিত বারুনি স্নানে করতে সবচেয়ে বেশি ভক্ত সমাগম হলেও, তারপরেই শিব চতুর্দশীর দিন মন্দিরে ভক্তদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হয়।
তাছাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা মনমুগ্ধকর পরিবেশে অবস্থিত শিলকুড়ি অঞ্চলের বরম বাবার
আশ্রমেও শিব চতুর্দশী উৎসাহ উদ্দীপনায় পালিত হয়। প্রচুর সংখ্যক শিব ভক্তদের সমাবেশ ঘটে শিবরাত্রিতে।
ভক্ত আর ভগবানের সম্পর্ক বড় অদ্ভুত। বলা যায় এক বিশ্বাসের সুতোয় বাঁধা। যারা ভগবানে বিশ্বাস করেন, তাদের কাছে ভগবানের কাছে আত্মসমর্পনই শ্রেষ্ঠ। কথায় বলে, “ভক্তিতে মুক্তি”। ভক্তদের কাছে কথাটার মূল্য অনেক।তাছাড়া বিশ্বাসের একটা নিজস্ব শক্তি রয়েছে। তাই এভাবেই ভক্ত আর ভগবানের সম্পর্ক অটুট থাকুক বিশ্বাসকে আধার করে।
Comments are closed.