Also read in

Chhath the festival that brings a message of unity

মিলনের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে ছট্ পরব

কঁহয়া সে আয়েলন সুরযদেব
কঁহয়া ভইলে অজীর
পুরব সে আয়েলন সুরয দেব
পূরবে ভইলে অজীর……
কণ্ঠে এমনই কোন এক গান। কোমর জলে দাঁড়িয়ে অজস্র নারী হাতে অর্ঘ্য নিয়ে সূর্য বন্দনায় ব্রতী। এমন দৃশ্য কার্তিক মাসের শুক্লা তিথির চতুর্থী পঞ্চমী বা ষষ্ঠীতে অনেক জায়গায়ই দেখা যায়। কারণ হচ্ছে ছট পূজা। আসলে ছট্ কোন পুজো নয়। এ হচ্ছে পরব বা ব্রত বা উপাসনা। ছট্ কথাটি সংস্কৃত ষঠ বা ষষ্ঠ শব্দের প্রাকৃত রূপ । তাই সেটা থেকেই চলতি কথায় ছট শব্দের উৎপত্তি। এটি মূলত সূর্যের উপাসনা যা বৈদিক কাল থেকে প্রচলিত রয়েছে ।

কথিত আছে, ষষ্ঠীর সঙ্গে ওই সময় সূর্যের মিলন ঘটে। বছরে ওই একবারই ষষ্ঠীর সঙ্গে সূর্যের মিলন ঘটে। সেই মিলনটা কিন্তু ভাই বোনের মিলন। ষষ্ঠী আর সূর্য সম্পর্কে ভাই বোন। এ তো গেল প্রচলিত কাহিনীর কথা। আমার ব্যক্তিগত অভিমত অনুযায়ী, শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়াতে যেমন ভাইফোঁটা হয়, রাজস্থানে হয় ভাইদুজ, ঠিক সেভাবেই সূর্য আর ষষ্ঠীর, ভাই বোনের এভাবেই মিলনের দিনটি হচ্ছে এই ছট্ পরব। আরও কথিত আছে,১৪ বছর বনবাসের পর অযোধ‍্যায় ফিরে রাম সীতা এই ব্রত উদযাপন করেছিলেন । ইন্দ্রপ্রস্থে রাজধানী স্থাপন করার পর দ্রৌপদী ও পঞ্চপান্ডব এই ব্রত পালন করেন ।

উত্তর প্রদেশ ও বিহারের মানুষ বিশেষ করে এই ব্রত উদযাপন করেন।বলা হয়, ছট পূজা মূলত বিহারীদের। কিন্তু বরাক উপত্যকায় বিশেষভাবে বাগানে ছট পূজা বিহারীদের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালিরাও করেন। এমনকি দক্ষিণ ভারতীয়দেরকেও এই ব্রত করতে দেখা যায়।

 

বলা যায়, এটি খুবই কঠিন ব্রত। আমার মতে এ হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন ব্রত। কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের চতুর্থী থেকেই শুরু হয়ে যায় এই ব্রত পালন। এই ব্রত পালনের শর্ত অনুযায়ী ঘরের সব কিছু পরিষ্কার করা উচিত। ঘরের কোন একটা জিনিসও যেন না ধোওয়া না থাকে, এটাই নিয়ম। এমনকি বাড়ি ঘর, উঠোন, রাস্তা সব ধুয়ে পরিষ্কার করতে হয়।

মূলত তিন দিন উপোস থাকতে হয়। পঞ্চমীতে সারাদিন উপবাস করতে হয়। পঞ্চমীর বিকেলবেলা সূর্যাস্তের সময় একবার অর্ঘ্য দিতে হয়। ষষ্ঠীতে নির্জলা উপবাস করেন ব্রতীরা। ষষ্ঠীর দিন রাস্তায় গড়িয়ে গড়িয়ে ব্রতীদের জলাশয়ে পৌঁছতে হয়। উপুড় হয়ে শুয়ে বুকে ভর দিয়ে সূর্য প্রণাম করতে করতে যেতে হয়। তারপর কোমর বা বুক জলে দাঁড়িয়ে সূর্যকে অর্ঘ্য দিতে হয়। যারা অক্ষম তারা হেঁটে সূর্যকে প্রণাম করতে করতে জলাশয়ে পৌঁছাতে পারেন।এই ব্রত পালনের জন‍্য তারা নিরামিষ আহার করেন একমাস।

এই ব্রতে প্রচুর পরিমাণে সব ধরনের ফল, প্রসাদ হিসেবে নিবেদন করা হয়। প্রসাদ হিসেবে এত ফল নিবেদন করতে খুব কম ব্রতেই দেখা যায়। সব ধরনের ফল দিলেও আঁখ দিতেই হয়। তাছাড়া বিভিন্ন মিষ্টি দ্রব্য পোয়া, ঠেকুয়া দেওয়া হয়। যদিও মিষ্টির মধ্যে ঠেকুয়া প্রসাদ হিসেবে দিতেই হয়। ঠেকুয়াটা মিষ্টি প্রসাদ হিসেবে আটা গুড় দুধ দিয়ে বানানো হয়। ভোর হওয়ার আগেই প্রচুর পরিমাণে ফলমূল নিয়ে দলে দলে ঘাটে চলে যান ব্রতীরা।

এখানে আরেকটা জিনিস আমাকে নাড়া দেয়, কারন আমরা সাধারণত মেয়েদেরকে শুধু ব্রত করতে দেখি। কিন্তু এক্ষেত্রে শুধু বাড়ির মহিলারাই করেন না, আবাল বৃদ্ধ বনিতা পুরুষ কিংবা নারী সবাই এই ব্রত করতে পারেন এবং করেও থাকেন। আরো একটা ব্যাপার এখানে আমি উল্লেখ করতে চাই, এই ব্রতে গাওয়া গানগুলোর অর্থ কিন্তু খুবই সুন্দর। কোনও একটা গানের অর্থ ছিল, একজন ব্রতী বলছে, আমি এই ব্রত পালন শুধু আমার জন্য করছি না, এমনকি আমার পরিবারের জন্যও করছি না, আমি ব্রত পালন করছি এই সমাজের মঙ্গলের জন্য। ব্যক্তিগত ভাবনার উর্ধে উঠে সমষ্টিগত ভাবনার এই আবেদন অবশ্যই ভালো লাগার কথা।এই ব্রতে শ্রেণীবিভাগ কিংবা বর্ণভেদেরও কোন স্থান নেই। যেমন ব্রাহ্মণরা এই ব্রতে সামিল হচ্ছেন, তেমনি দলিতদেরও এই ব্রতে অংশগ্রহণ করার উৎসাহ কম নয়।

এই ছট পুজোকে অন্যভাবে বলা হয় প্রকৃতিরও পূজা। প্রকৃতি ছাড়া আমরা অস্তিত্বহীন। সূর্য আমাদের প্রাণের আধার তাই মানুষ সূর্যের উপাসনায় ব্রতী হবে, এটা খুবই স্বাভাবিক ।আবার যেহেতু নদী বা জলাশয়ে কোমর অব্দি জলে দাঁড়িয়ে এই পূজা সম্পন্ন করতে হয়, তাই খুব স্বাভাবিক কারণেই এই পূজার আগে নদীর ঘাট বা জলাশয়কে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে তোলা হয়। সেই অর্থে অবহেলিত প্রকৃতিকে যত্নে সুন্দর করে তোলা হয়।

সবশেষে বলতেই হয়, এই ব্রতের মাধুর্য শুধু বিহারের মানুষদেরই ছুঁয়ে যায় না, এর সৌরভ আমাদের সবাইকে স্পর্শ করে। প্রকৃতি সেজে ওঠে নতুন আঙ্গিকে। আসলে ছট্ পরব শেষ পর্যন্ত এক মিলন উৎসবে পরিণত হয়। কিংবা বলা যায়, এই পরব মানুষের কাছে মিলনের এক বার্তা বহন করে নিয়ে আসে।

Comments are closed.