Corona Countdown: Arijit Aditya's special write up
আচ্ছা, বলুন তো ব্রিটানিয়া মারি বিস্কুটে ক’টা ফুটো রয়েছে?
উঁহুহু, পারলেন না তো!
শুনুন তাহলে। বাইশটা ফুটো। আজ্ঞে, হ্যাঁ, বাইশটি ফুটো।
এই চমৎকার আবিষ্কারটি করেছে রাতুল। রাতুল রায়চৌধুরী। আামার স্কুলবেলার বন্ধু। মানে বয়স ৫০ পেরিয়েছে। সরকারি চাকরি। বরাবরই গম্ভীর টাইপের। লকডাউনের দুই নম্বর দিন রাতুল আমাদের বন্ধুদের হোয়াইটআপ গ্রুপে তার ওই অত্যাশ্চর্য আবিষ্কারের ঘোষণা জানিয়েছে। বলেছে, কাজকর্ম তো নেই। তাই মারি বিস্কুটে ক’টা ফুটো রয়েছে সেটা বসে বসে গুনলাম। যাক কয়েকটা মিনিট তো কাটল।
বুঝুন ঠ্যালা।
তা, শুধু রাতুল নয়, লকডাউনের এই দুঃসহ দিনে এভাবেই অনেকে রিলিফ খুঁজছেন৷ হ্যাঁ, রিলিফ। দমবন্ধ করা প্রহরগুলো কাটতেই চাইছে না। একুশ দিন! ভাবলেই হাত-পা যেন পেটে ঢুকে যাবার উপক্রম।
তবে মানুষ তো আফটার অল মানুষ। ফলে বোরডম কাটানোর একটা না একটা কিছু রাস্তা ঠিক বের করে। এবং মানুষ তো, তাই চেতনে অবচেতনে মানুষ চায় সাহচর্য। চায় তার সুখ দুঃখ সৃষ্টি অন্যের সঙ্গে শেয়ার করে নিতে। চায় লাইক কমেন্ট শেয়ারে ভরে যাক তার মনের ইনবক্স।
সোশাল ডিস্টান্সিঙের এই দুঃসহ কালবেলায় অনিশ্চিত মৃত্যুভয়জর্জর প্রহরে সোশ্যাল মিডিয়া মানুষকে মুক্তির আলোকধারায় ধুইয়ে দিচ্ছে।
ওই সত্যজিত বসু, যাঁকে এ উপত্যকা বেশি চেনে জয় বসু নামে, তিনি যখন ‘এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ নাচেন, তখন মুদ্রায় ফুটে ওঠে মুক্তির আর্তি। মানব সভ্যতার এই অকল্পনীয় সংকট থেকে মুক্তির প্রত্যয়।
বা নাট্যকর্মী মিঠু ভট্টাচার্য পোস্ট করছেন একক অভিনয়। সংকটের অভিঘাতে যখন দিন-তারিখ-ঘন্টা-মিনিট গুলিয়ে যাচ্ছে, তখন মিঠু মনে করিয়ে দিচ্ছেন আজ বিশ্ব নাট্য দিবস।
সৃজনই এই কালবেলা থেকে মুক্ত করে। জীবন আবার ছন্দে ফিরুক, মিলিয়ে নেবেন। বিলয় থেকে বাঁচতে মানুষ তাই সৃজনশীলতায় আশ্রয় খুঁজছে। ট্রাম্পের বৈভবশালী দেশে লকডাউন শুরু হওয়ার আগেই “আমেরিকান সোসাইটি অব পোয়েট” শুরু করে দিয়েছে #Shelterinpoems. সেখানে কবিতা পাঠাচ্ছেন অনেকেই। এই সংকটের প্রহরে তাঁদের নিশ্চিন্ত আশ্রয় কবিতা। ম্যাসাচুয়েটস ইউনির্ভাসিটিতে সায়েন্টিস্ট হিসেবে রয়েছেন অলোকেশ দেবরায়। অলোকেশ কবি। গত বছর কলকাতা বইমেলায় পরিচয়। মেসেঞ্জার ফেসবুকে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। ম্যাসাচুসেটস থেকে অলোকেশ জানালেন, তাঁর শহরে ইতিমধ্যেই ২৫জন মারা গেছে। তিনি কার্যত গৃহবন্দি। এই সময়ে কবিতায় আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। #shelterinpoems-এ কখনও লিখছেন
March madness moves inches
Spring aims homebound
The world spins around with our lives
কখনও বা লিখছেন
Little droplets of words
Fragile just as life
Like water flows to be a poem.
লকডাউন আজ সাত দিনে পড়ল। আরও চৌদ্দদিন৷ আপাতত। যদি সব ঠিকঠাক থাকে। মানুষ এখনও অভাবনীয় এই পরিস্থিতির সঙ্গে চোখে চোখ রেখে জল মাপতে চাইছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এক অসহায় অস্থিরতা তাকে নিয়ত দগ্ধ করে চলেছে। মারি বিস্কুটে ছিদ্র-অন্বেষণ বা ফেসবুকে লাইভ, সব কি আসলে নিজেকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা নয়? হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ইয়ার্কি, মজার মজার মিম পোস্টের অন্তরালে কোথাও যেন পলায়নী মনোভাব কলকাঠি নাড়ছে।
নাট্যব্যক্তিত্ব সুব্রত রায় যেমন অকপটে জানালেন, তাক থেকে ধুলো ঝেড়ে একগাদা নাটকের বই নামিয়েছেন৷ কিন্তু মন দিতে পারছেন কই। প্রতি মুহূর্তে ভাবেন, ধুত্তোরি নিউজ, আজ থেকে আর টিভিই দেখবেন না। শুধু করোনা আর করোনা। আক্রান্ত আর মৃত্যুর পরিসংখ্যান। টিভির পর্দার কোনায় কত আক্রান্ত, কত মৃত আর কত সুস্থের স্কোরবোর্ড। যেন ইন্ডিয়া পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ। কিন্তু যতই ভাবুন, আর দেখব না, চোখ ঠিক সেখানেই চলে। এ যেন টিন এজের কোনও নিষিদ্ধ আকর্ষণ।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড প্রসেনজিৎ ঘোষ বললেন, ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে ক্রোধ জমে উঠবে। নিষ্ফলা ক্রোধ জন্ম দেবে হতাশার৷ এই হতাশা মানসিক বৈকল্যের দিকে ঠেলে দেবে না, তা কেউ হলফ করে বলতে পারে না। আত্মহননের হাতছানিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। জার্মানির মন্ত্রী বলুন বা দিল্লি সফদরজঙের মধ্য-কুড়ির তরুণ হতাশায় জীবনের বৈঠা ছেড়ে দিয়েছেন। ড: প্রসেনজিৎ ঘোষ বলেন, এই মুহূর্তে পজিটিভিটিই একমাত্র সমাধান। মনে করুন, একান্ত নিজের কত কাজ এত দিন করা হয়ে ওঠেনি৷ ভাবুন তো, কত দিন আয়েশ করে গান শোনেননি। বা এই যে ভাবতেন, আহা ক’টা দিন ছুটি পেলে পথের পাঁচালীটা আরও একবার পড়ে নিতাম। তো মিটিয়ে নিন না সেই শখটা৷ সময় দিন সন্তানকে। পরিবারকে।
দিন, কারণ, এ ছাড়া আর আমাদের সামনে বিকল্প কিছু নেই। এবং এই যে ‘ বিকল্প নেই’ ওয়ার্নিংটা, এটাই যাবতীয় পজিটিভিটির সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক। এক জগদ্দল পাথরের মতো। সাত দিনে আমরা ঠিক টের পাচ্ছি, পাথরটা ক্রমাগত চেপে বসছে আমাদের অস্তিত্বে। আমাদের অস্থির অস্থির লাগে।
ড প্রসেনজিৎ ঘোষ, বললেন, সকাল বিকেল এক্সারসাইজ করুন, প্রাণায়াম করুন। করোনা ত্রাস একদিন কেটে যাবে। কিন্তু আমাদের জীবনশৈলী পালটে দিয়ে যাবে। প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও নিবিড় হবে।
হয়তো বা তাই হবে। লকডাউনের প্রথম সাতদিনেই আমরা খানিকটা কি পালটে যাইনি? কোথাও যেন শৈশব আমাদের হাতছানি দিচ্ছে। নতুন পট্টির এই যে কুড়িটি ফ্ল্যাটের আবাসন, আমাদের ছোটবেলায় সেখানে কাঠের দোতলা ছিল। ছোট একটা পুকুরও ছিল। মোবাইল তো দূর অস্ত, টিভিও তখন স্বপ্নের অগোচর৷ সেসময় বিকেলে হাডুডু না হলে আইসপাইস। সন্ধ্যায় দশ পঁচিশ। লকডাউনে অতীষ্ঠ আমি অন্য আবাসিকদের বলছিলাম, আহা একটা দশ পঁচিশ যদি থাকতো৷ নিদেন পক্ষে ক্যারম বোর্ড।
কী আশ্চর্য, আজই সুব্রত বললেন, খেলার জিনিসের ব্যবসা করেন, এমন এক পরিচিতের কাছ থেকে দশ পঁচিশ কিনে এনেছেন। সোৎসাহে আমি সেই ব্যবসায়ীর নম্বরটা নিয়ে নিই। নিলাম তো খুব, কিন্তু যাব কী করে! বাইরে যে পুলিশ সিআরপি।
Comments are closed.