Also read in

Corona Countdown with Arijit Aditya: Day 3

কৌশানি থেকে সাইরাং/ প্রবাসে দৈবের বশে 

১. জানেন আমার বাবা পারকিনসনের পেশেন্ট। প্রতিদিন ওষুধ দিতে হয়। আমাদের গ্রুপে আরেকজন রয়েছে, বয়স কম, কিন্তু মেন্টাল প্রবলেম আছে। ওরও ডেইলি মেডিসিন নিতে হয়। দুজনের ওষুধই ফুরিয়ে আসছে। ভীষণ কস্টলি মেডিসিন, সব জায়গায় পাওয়াও যায় না। একুশ দিন ওষুধ ছাড়া ওরা কীভাবে থাকবে ভাবতেও পারছি না।

কৌসানি থেকে ভেসে এল সোহম করের অসহায় কণ্ঠ।

বছর তেইশের সোহম কলকাতা লেকটাউনে সাঁতারের ট্রেনার। ওঁরা থাকেন পাইকপাড়ায়। ১৬ মার্চ ছাব্বিশ জনের পারিবারিক দল উত্তরাখণ্ড বেড়াতে এসেছেন। দলে যেমন রয়েছেন সোহমের ৬৪ বছরের বাবা সুবল কর বা তাঁর বন্ধু আটান্নর পুলক সরকার, তেমনি রয়েছে চার থেকে ন’ বছরের পাঁচটি শিশুও। নৈনিতাল হয়ে কৌশানি এসেছেন, সেখান থেকে আলমোড়া হয়ে ফেরার টিকিট। এরই মধ্যে লকডাউন সব প্ল্যান ওলট-পালট করে দিল। এমনই ওলট-পালট যে, পাইকপাড়ায় পৌছনোর আগে পারকিনসন আর মেন্টাল রোগের ওষুধ পাবেন কি না, এর কণামাত্র নিশ্চয়তা নেই। সোহমের অসহায় আত্মসমর্পণ, আমি সিম্পলি জানি না আমাদের কী হবে।

ফেসবুকে একজনের পোস্ট দেখে সোহমকে আজ সকালে ফোন করি। কৌশানির এক হোম স্টে-তে উঠেছেন তাঁরা। লকডাউন ঘোষণার পর হোটেলও প্রায় ফাঁকা। স্টাফদের অনেকেই বাড়ি চলে গেছেন। ফলে হোটেল থেকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, ছাব্বিশজনের তিনবেলার খাবার দেওয়া সম্ভব নয়। তবে, হোটেল থেকে বাসনপত্র, রান্নার স্টোভ, সিলিন্ডার দেওয়া হয়েছে। অবশ্যই মোটা টাকায়। বাজার নিজেরাই করে নিচ্ছেন। সোহম বললেন, উপায় নেই, জানেন, হোটেলের খাবারের রেট বেড়ে গেছে। আশপাশে এটিএমও নেই, যেতে হয় সাত আট কিলোমিটার। গাড়ি ভাড়ায় গুচ্ছের টাকা যায়। আবার গিয়ে দেখবেন, এটিএম ডাউন।

ছাব্বিশজন ছ’টা রুম নিয়ে আছেন। সুযোগ বুঝে রুম রেন্টও বাড়িয়ে দিয়েছে হোটেল। সোহম জানালেন, স্থানীয় মানুষদের কোনও সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে না। আর করবেই বা কারা। লোকজনের দেখাই নেই। পাহাড়ি শহর পুরো শুনশান। পাকদণ্ডিগুলো অলস অজগরের মতো নেতিয়ে পড়ে রয়েছে। সকালে কিছু ক্ষণের ছাড়, তখন ভয়ার্ত কিছু মানুষ বেরিয়ে আসেন। কিন্তু টুরিস্ট দেখলেই সড়াত করে কেটে পড়েন। মানুষের স্পর্শেই তো এখন মৃত্যুর ছোবল।

২১ তারিখ থেকে এভাবেই এক দুঃসহ দমবন্ধ করা পরিস্থিতির মধ্যে আটকে আছেন তাঁরা। হাওয়া সুবিধার নয় বুঝে তৎকালে ট্রেনের টিকিট কেটে ছিলেন। সেদিনই বন্ধ হয়ে যায় ট্রেন। সোহম শুনেছেন, পরদিন রাত দুটোর সময় পাশের টিলার আরেক হোটেলে ৫০ জন এসে উঠেছেন। সবাই বাঙালি।

গত দুদিন ঝলমলে রোদ উঠেছিল, আজ সকাল থেকে পাহাড়ে মন কেমন করা বৃষ্টি। বাবা কাকারা হোটেলের ফাঁকা ডাইনিং হলে তাস খেলছেন। সকালে হোটেলের গাড়ি ভাড়ায় নিয়ে বাজার ঘুরে এসেছেন সোহম। যা পেয়েছেন, নিয়ে এসেছেন। আগামিকাল তাও জুটবে কি না, কেউ জানে না। মহিলারা রুমে রান্না করছেন। এই রান্নায় নেই উৎসব উদযাপনের আনন্দ।

বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। পাকদণ্ডিগুলো মেঘ আর বৃষ্টিতে যেন লুকোচুরি খেলছে। হোটেলের উদাস লনে দাড়িয়ে মোবাইলে অচেনা অদেখা অপরিচিত আমাকে সোহম জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা পারকিনসন আর মেন্টাল রোগের ওষুধগুলো পাওয়া যাবে?
সেলফোনে স্তব্ধতা। কয়েক মুহূর্তের। না কি কয়েক লাইটইয়ারের। আমি বলি, নিশ্চয় পাওয়া যাবে। বিশ্বাস রাখুন।
কখনও কখনও মিথ্যে কথাও বিবেককে বিদ্ধ করে না

“লকডাউনের জাবড়ামি”: অরিজিৎ আদিত্য

২. চাল আর বড় জোর দু’দিন চলবে। ডালও ফুরিয়ে এসেছে। সাইরং বাজারে আলু পেঁয়াজ গতকাল থেকেই আর পাওয়া যাচ্ছে না। ক্যাম্পে মোট দেড়শজন, এরপর তাদের কী খেতে দেবেন জানেন না জীবনজ্যোতি গোহাঁই। সাইরঙের জঙ্গল থেকে জানালেন, করোনা নয় স্যার,আমরা না খেয়েই মরে যাব, দেখবেন।

আইজল ঢোকার বাইশ কিলোমিটার আগে সাইরং। এখানে রেল লাইন বসানোর কাজ চলছে। থামরং, কনপুই, ভাইরাবিতে রয়েছে ক্যাম্প। সব মিলিয়ে প্রায় ছ’শ লেবার। এদের নব্বই শতাংশই অসমের। সাইরং ক্যাম্পের সুপারভাইজার গোলাঘাটের জীবনজ্যোতি।
লকডাউনে আটকে পড়েছেন, এর থেকে নিস্তার কবে পাবেন, আদৌ পাবেন কি না জানা নেই জীবনজ্যোতির। জানালেন, ডিসি, পুলিশ এসে খবর নিয়ে গেছেন, সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন ওয়াইএমসিএ-র স্বেচ্ছাসেবকরা। কিন্তু জীবনজ্যোতি বুঝতে পারছেন, পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে ইচ্ছে থাকলেও আর কেউ কাউকে সাহায্য করতে পারবেন না।

জঙ্গলের মধ্যে ক্যাম্প করে থাকতে হয়। একেক তাবুতে চার পাঁচজন গাদাগাদি করে থাকেন। সোশ্যাল ডিস্টান্সিং এখানে এক নিষ্ঠুর ঠাট্টা। তাদের কাছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার আর মাস্কও নেই। জঙ্গলে ইলেকট্রিসিটি নেই। জেনারেটরে রাতে আলো জ্বালান তাঁরা। কিন্তু ডিজেলও ফুরিয়ে আসছে, বড়জোর দু’দিন। ‘ তারপর তো বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারব না। মোবাইল চার্জ দেবো কী করে।’ নির্বিকারভাবে বলেন জীবনজ্যোতি।

দু দিন। মাত্র দু দিন পর ওদের কোনও খাবার থাকবে না। আলো থাকবে না। কানেক্টিভিটি থাকবে না। জঙ্গলের জীবন। আর মাত্র দু দিন। জানি না স্যার, আমাদের কী হবে। সত্যি জানি না। ড্যাম কেয়ার থাকার চেষ্টা করেন জীবনজ্যোতি। তাঁকে করতেই হবে। দেড়শ মানুষের সুপারভাইজার তিনি।। কিন্তু আমি ঠিক টের পাই, অভিনয়টা একেবারেই আসে না জীবনজ্যোতির।

করোনা-কাউন্টডাউন – ডে-১: “তা হলে কীভাবে ব্যবস্থা হবে আমার মায়ের প্রেশারের ওষুধ”

৩. জনতা কারফিউর আগের দিনই আইজল থেকে বাইকে করে নিলামবাজার বাড়িতে এসে যান আবু ইউসুফ। ভাই সারিমুল হক রয়ে গিয়েছেন সেলিম, আইনুলদের সঙ্গে। ওঁরা সবাই নিলামবাজারের। আইজলে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। ঠিক ছিল, দু দিন থেকেই আইজল ফিরে যাবেন আবু। লকডাউন সব ওলট-পালট করে দিল।

আজ এর ওর মাধ্যমে আবুর সঙ্গে যোগাযোগ। জানালেন, সারিমুলরা হাইলাকান্দি বর্ডার দিয়ে ফিরছেন। কোনও ট্রাকে করে রওনা হয়েছেন সাতজন। সকালে শেষ কথা হয়েছে, এরপর থেকে সারিমুলের মোবাইল অফ।

আবু ততক্ষণে বাইক নিয়ে লকডাউনের মধ্যেই লালা বাজারের দিকে রওনা দিয়েছেন। তিনটে নাগাদ, আবুর ফোন পেলাম, সারিমুলদের সঙ্গে কথা হয়েছে। ট্রাক ওদের মাঝপথে নামিয়ে দিয়ে অন্য রুট ধরেছে। ওরা বিলাইপুর হয়ে হেঁটে আসছেন। কিন্তু ওরা আছে কোথায়, সেটা জানার আগেই মোবাইল নট রিচেবল। সারিমুলের মোবাইলে আমিও বারবার চেষ্টা করি। লাইন ঢোকেই না। আবু এবার আইনুলের নম্বর দেন। এক চান্সেই আইনুলকে পেয়ে যাই।

তখন দুপুর পৌনে চারটে। আইনুল বললেন, আর ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে লালা পৌঁছে যাবেন। সকাল আটটা থেকে বিরামহীনভাবে হাঁটছেন। কখনও ঘন জঙ্গল, কখনও শুনশান জনপথ।

খাননি কিছু?

কোথায় পাব খানি সার। আজ প্রায় দুদিন, পুরো ভুখা পেটে আছি। এখন কোনও মতে,——-
লাইন কেটে যায় আবার। এরপর থেকে আইনুলদের আর ধরতে পারিনি। তবে একটু পর পর ফোন করেই যাচ্ছে আবু। একেক বার পুলিশ বা প্রশাসনের কোনও অফিসারের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিচ্ছে। আবু আমি কে, জানেন না, আমার যে কোনও ক্ষমতা নেই, এটাও তিনি বুঝতে পারছেন না। শুধু বলেন, একবার কথা বলুন স্যার, একবার। বর্ডারে দাঁড়িয়ে আছে আমার ভাই, আমার গ্রামের আইনুল সেলিমরা।

আমি অফিসারদের বলি, দেখুন স্ট্রেট মেডিক্যালে পাঠানো যায় কি না। লোকগুলো খায়নি কিছু। অফিসারও অসহায়। বললেন, মিজোরামে একজন ধরা পড়েছে। স্ট্রিক্ট অর্ডার মিজোরাম থেকে কেউ এলে লায়লাপুর বর্ডার হয়ে আসামে ঢুকতে হবে।

৪. রাত প্রায় আটটা বাজে। লেখাটা পোস্ট করা হয়নি এখনও৷ আবাসনের ছাদে একা দাঁড়িয়ে আছি আমি। আকাশে মেঘ নেই। তারা উঠেছে বেশ। কৌশানিতে কি বৃষ্টি হচ্ছে এখনও? পারকিনসনের ওষুধটা নিশ্চয় পেয়ে যাবে সোহম। আর ওই কম বয়সি ছেলেটা, তার মানসিক রোগের ওষুধটাও নিশ্চয় পাওয়া যাবে। কিন্তু, যদি লকডাউনে আটকে যায় সাপ্লাই লাইন? যদি না আসে ওষুধ? তা হলে?

না, আবু ইউসুফ আর ফোন করেননি৷ আইনুলরা এখন কোথায়? আবার কি আইজল ফিরে যাবে লায়লাপুর হয়ে আসামে ঢোকার জন্য?

হোয়াটসঅ্যাপে পিং। জীবনজ্যোতির মেসেজ। রোমান হরফে লেখা —– স্যার, কী বা এটা করি আমাক রক্ষা করক।
আকাশের দিকে তাকাই আমি। অন্ধকার। নিকষ কালো অন্ধকার।

Comments are closed.