Also read in

Do you know about 'Kinthup'? Ashu Paul's special series Part 1

অনেকেই বিশ্বাস করেন, ১৯২৪ সালের ৯ জুন, ব্রিটিশ পর্বতারোহী জর্জ ম্যালোরি এবং এন্ড্রু আরভিন ২৯০২৮ ফুট (৮৮৪৮ মিটার) উঁচু এভারেস্ট শৃঙ্গে আরোহণ করেছিলেন। কিন্তু তারা যখন শৃঙ্গ থেকে নেমে আসছিলেন, এক ভয়াবহ তুষারঝড়ে দুজনেই প্রাণ হারান। তাঁদের সহ-অভিযাত্রীরা শেষ ক্যাম্প থেকে দূরবীনের সাহায্যে দেখতে পেয়েছিলেন ম্যালোরি এবং আরভিন, এভারেস্ট-চূড়া থেকে মাত্র কয়েক মিটার নীচে এগিয়ে চলেছেন। কিন্তু বরফে সূর্যালোকের তীব্র প্রতিফলনের ফলে এরপর অনেকক্ষণ আর তাঁদের দেখা যায়নি। এর প্রায় আধ ঘন্টা বাদে তাঁদের আবার দেখা যায় নেমে আসছেন। কিন্তু হঠাত করেই তারা ঢাকা পড়ে যান কালান্তক এক তুষারঝড়ে। ১৯৯৯ সালে “আরভিন-ম্যালোরি অনুসন্ধান অভিযান”-এর আগে পর্যন্ত তাঁদের আর কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ১৯৯৯ সালের ১ মে তারিখে অনুসন্ধানকারী অভিযাত্রীরা এভারেস্টের উত্তর ঢালে চূড়া থেকে সামান্য নীচে ম্যালোরির মৃতদেহ উদ্ধার করেন। আরও পরে, ২০১৩ সালে সেখান থেকে কিছুটা দূরে অপর এক অভিযাত্রী দল খুঁজে পান এন্ড্রু আরভিনের মৃতদেহও। শূণ্য ডিগ্রির অনেক নীচে তাপমাত্রার ফলে মৃতদেহগুলিতে পচন ধরেনি। মৃতদেহে তল্লাসী চালিয়ে তাঁদের ব্যবহৃত অনেক বস্তুই পাওয়া গেলেও শুধুমাত্র একটি বস্তুর খোঁজ পাওয়া যায়নি। সেটা হল, ম্যালোরির প্রয়াত স্ত্রীর একখানি ফটো। সবাইকে জানিয়েই ম্যালোরি সেটা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এভারেস্টে উঠতে পারলে প্রিয়তমা স্ত্রীর ছবি রেখে আসবেন পৃথিবীর সেই উচ্চতম স্থানটিতে। তাই আজ অনেকেরই বিশ্বাস, ম্যালোরি ও আরভিন এভারেস্টে পৌছুতে পেরেছিলেন। কিন্তু এইসব তথ্য তাঁদের দুজনকে প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী বলে ঘোষনা করার জন্য যথেষ্ট নয়। তাই বিশ্বের প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী হিসাবে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন তেনজিং নোরগে আর এডমণ্ড হিলারি। শুধু আমরাই নয়, গোটা বিশ্বের বহু মানুষই জানেন, সর্বপ্রথম, দুনিয়ার সবচেয়ে উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট জয় করেছিলেন তেনজিং নোরগে আর এডমন্ড হিলারি জুটি, ১৯৫৩ সালের ২৯ মে তারিখে।

কিন্তু এতক্ষণ যা বললাম, তা আসলে মুখবন্ধ। ম্যালোরি আর আরভিন যেমন ইতিহাসে বিস্মৃতির অন্তরালে চলে গেছেন, ঠিক তেমনি, ভাগ্যের পরিহাসে আজও আমাদের অধিকাংশের জ্ঞানের আড়ালেই থেকে গেছেন আরেক মহান অভিযাত্রী “কিনথাপ”। আমার এই লেখা যারা পড়ছেন, সত্যি করে বলুন তো, আপনাদের ক’জন এর আগে “কিনথাপ”- এই নামটি শুনেছেন ? শতকরা দশজন হবেন বলে মনে হয়না। আমি নিজেও এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত ‘না জানা’র দলেই ছিলাম। ‘কিনথাপ’ কে আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার আগে, চলুন হিমালয়ের বরফঢাকা খাঁজে খাঁজে আরও কিছু পথ ঘুরে আসি।

কিনথাপ ( ছবি উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহীত)

সেটা ১৮৭৮ সালের শীতকাল। দেরাদুনে সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার হেড অফিসের ফায়ারপ্লেসে গনগনে আগুনের সামনে বসে হাত সেঁকছেন প্রধান সার্ভেয়ার জেনারেল স্যার জেমস থমাস ওয়াকার সাহেব। মাথা থেকে পোকাটা কিছুতেই বেরোচ্ছে না। না কোনও সমাধান পাচ্ছেন, না এই চিন্তাকে ঝেড়ে ফেলতে পারছেন। ঘরের মাঝখানে ঢাউস টেবিলে মেলে রাখা আছে গোটাকয় ম্যাপ। দুনিয়ার প্রায় সব নদীর উৎস এবং গতিপথ জানা হয়ে গেছে সভ্যতার। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও আজ অব্দি ব্রহ্মপুত্রের উৎসের কোনও হিল্লে করা গেলনা। অনেকেই বলছেন, কৈলাশ শৃঙ্গের নীচে মানস সরোবরের কাছাকাছি জায়গা থেকে উৎপন্ন হয়ে যে নদীটি তিব্বতের বরফাবৃত গভীর উপত্যকা দিয়ে সোজা পূর্ব দিকে বয়ে গেছে, সেই সাংপো নদীই নাকি ব্রহ্মপুত্র। কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব ? সাংপো বইছে পূর্ব অভিমুখে, আর ব্রহ্মপুত্র এগিয়ে চলেছে পশ্চিমে। তিব্বতে সাংপো রয়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে এগারো হাজার ফুট উচ্চতায়, অথচ শদিয়ায় ব্রহ্মপুত্রের উচ্চতা মাত্র পাঁচ শ ফুটের মত। বরং চীনের ইয়াংসি নদীর উৎসের কাছাকাছি কোনও এক নির্জন বাঁকে সাংপো মিশে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। তা হলে কি সাংপো আসলে ইয়াংসি নদীর উপনদী ? কিংবা হতে পারে ব্রহ্মদেশের ইরাবতীতেই তার জল ঢেলে দিচ্ছে সাংপো। মেকঙের সাথে যোগ হওয়াও অসম্ভব নয়। যদি তাই হয়, তবে ব্রহ্মপুত্রের এই বিশাল জলরাশি আসছে কোথা থেকে ? নাকি হিমালয়ের বরফ সাম্রাজ্যের কোথাও লুকিয়ে আছে বিশ্বের উচ্চতম কোনও জলপ্রপাত ? যদি সত্যিই কোনও জলপ্রপাত লুকিয়ে থাকে তা হলে নায়াগ্রা বা ভিক্টোরিয়া তো তার কাছে নেহাত শিশু ! তবে কি বিশ্বের উচ্চতম জলপ্রপাতের আবিষ্কারক হিসাবে তিনিই হতে চলেছেন ইতিহাস বিখ্যাত, অবিস্মরণীয় ব্যক্তি ? নাহ্‌। মাথাটা আর কাজ করছে না। সার্ভেয়ার জেনারেল ওয়াকার আরও এক পেগ ব্রান্ডি নিলেন রূপোর গ্লাসে। ওভারকোটের বেল্টটা আরেকটু কষে নিয়ে পোক্ত পাইন কাঠের তক্তায় তৈরি মেঝেতে ইতস্তত পায়চারি করতে লাগলেন তিনি। এতক্ষণ হয়ে গেল ক্যাপ্টেন হেনরিকে ডেকে পাঠিয়েছেন, কিন্তু এখনও এসে পৌছালোনা যে ! হার হাইনেস মহারাণীর সামরিক বাহিনীর ছোক্‌রা অফিসার গুলোর হল টা কি ! উর্ধতন অফিসার ডেকে পাঠালে পলকে হাজির হওয়ার আদব কায়দাও ভুলে গেল তারা ? আসলে, বড় সায়েবের আর্দালি যে প্রায় দেড় মাইল পাহাড়ী উৎরাই পথ পায়ে হেঁটে গিয়ে অফিসার্স মেসে খবর দিয়েছে, আর সেই পথ যে হেনরি-কে আবার হেঁটেই আসতে হবে, উত্তেজনায় সে কথাটা বেমালুম ভুলে বসে আছেন ওয়াকার সায়েব। ক্যাপ্টেন হার্মান হেনরি। এলেম আছে লোকটার। নদীর উজানে যাওয়া সম্ভব নয় দেখে দীর্ঘদিন লটবহর সেপাই-সান্ত্রী নিয়ে শদিয়ার নদীচরে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল, জল মেপে দেখবে বলে। তার ধারণা, লোহিত, দিবং আর সিয়াং নদীর মধ্যেই যে কোনও একটা দিয়েই নামছে সাংপোর জল। তেজু আর পাশিঘাটে ছুটে বেড়িয়ে হেনরি তাই তিন নদীর জল মেপে মেপে দিন কাটিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন দেখেছে, সিয়াং নদী দিয়েই নেমে আসছে সবচেয়ে বেশী জল। ভরা বর্ষার দিনে প্রায় ৫৫০০০ কিউসেক। প্রতি সেকেন্ডে পঞ্চান্ন হাজার কিউবিক মিটার জল। তাই সাংপো যদি ইয়াংসি বা ইরাবতীতে মিশে না থাকে, তাহলে সিয়াং নদীই হচ্ছে তিব্বতের সাংপো। কিন্তু বিশাল উঁচু কোনও জলপ্রপাত ছাড়া উচ্চতার তারতম্যের আর কোন যুৎসই যুক্তিই খুঁজে পাওয়া গেল না।
আজকের গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমের জমানায় বাস করে জেনারেল ওয়াকারের চিন্তা-ভাবনার কারণ ও উৎকণ্ঠা অনুধাবন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। উনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদে কোনও এক অসম-সাহসী মানুষের প্রাণ হাতে নিয়ে বাস্তবে সেই সব বিপদসংকুল স্থানে গিয়ে স্বচক্ষে সব কিছু দেখে আসা ছাড়া আর অন্য কোনও পথও খোলা ছিলনা। অথচ শদিয়া থেকে ব্রহ্মপুত্রের উজানে মিশমি পাহাড়ের গহন জঙ্গলে এগিয়ে যেতে চাইলে বর্বর আর ভয়ানক হিংস্র আদি, আবর আর ইদু-মিশমি উপজাতিদের হাতে নির্ঘাত মৃত্যু ছাড়া আর উপায় নেই। একবার দুবার নয়, সাত সাতবার অভিযান চালানো হয়েছে, কিন্তু এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। মাত্র দু-চার জন পালিয়ে কোনোক্রমে প্রাণ রক্ষা করতে পারলেও অধিকাংশই প্রাণ হারিয়েছে পাহাড়ীদের ছোঁড়া বিষাক্ত তীর আর দায়ের কোপে। শেষ পর্যন্ত সেনা সহায়তা নিয়ে চেষ্টা হয়েছিল, অনেক পাহাড়ী উপজাতিকে হত্যা করে কিছুটা এগোনো সম্ভবও হয়েছিল, কিন্তু শোনা যায়, পাহাড়ী মানুষ হত্যার খবর লন্ডনে গিয়ে পৌছাতেই পার্লিয়ামেন্টের বিরোধী সদস্যরা হুলুস্থুল শুরু করায় অভিযান মাঝপথে শেষ করেই ফিরে আসার আদেশ দেয় সরকার। ওদিকে তিব্বত হয়ে এগোনোরও উপায় নেই। সাদা চামড়া দেখলেই পাহাড়ী গ্রামবাসী লেপচা আর লামা-রা অলক্ষ্যে থেকে পাথর আর বরফের চাঙর ছুঁড়ে অভিযাত্রীদের ভবলীলা সাঙ্গ করে দেয়। তা ছাড়া পথ অপরিচিত, অনিশ্চিত। ঠাণ্ডা অপরিমেয়। প্রকৃতির খেয়ালিপনা অনির্বচনীয়। খাদ্য ও ওষুধপত্র বয়ে নিয়ে যাওয়ার শেরপা সংগ্রহ করা অসম্ভব। চাকরির মেয়াদও ফুরিয়ে আসছে সার্ভেয়ার জেনারেলের। ব্রহ্মপুত্রের উৎস আবিস্কারের স্বপ্ন কি তাহলে স্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে ওয়াকার সায়েবের?

চলবে ……

(২০১৬ সালে ডিব্রুগড়ে থাকার সময় খ্যাতনামা সাংবাদিক মৃণাল তালুকদারের লেখা “ছাংপোৰ পৰা ব্রহ্মপুত্রলৈ” বইখানি পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম সংস্কৃতিকর্মী শ্রদ্ধেয়া মৈত্রেয়ী বরুয়া ভৌমিকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে। ওই বইয়েরই এক পরিচ্ছেদে আমি খুঁজে পাই কিনথাপকে। সেই বিশাল ব্যক্তিত্ব আমাকে দারুণ ভাবে নাড়া দিয়ে যান। তারপর থেকে গত চার বছর ধরে তন্নতন্ন করে ইন্টারনেটে তাঁকে খুঁজেছি। ইংরাজিতে কোথাও তাঁকে Kintup আবার কোথাও Kinthup নামে উল্লেখ করা হয়েছে। কোথাও আবার এটিকে একটি ছদ্মনাম বলেও সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। বিভিন্ন লেখায় অল্প বিস্তর অমিল এবং তথ্যের তারতম্য রয়েছে। সব লেখালেখি থেকেই যেহেতু আমার এই কাহিনীর মশলা সংগ্রহ করেছি, তাই সেগুলোর ছাপ আমার লেখায় নিশ্চয় থাকবে। এই লেখাকে তাই ঐতিহাসিক দলিল না ভেবে একজন অচেনা মানুষের কাহিনী হিসেবে দেখতে পাঠকদের অনুরোধ জানাচ্ছি।– আশু পাল।)

Comments are closed.