Do You Know About 'Kinthup'? Ashu Paul's Special Series- Part 2
মে আই গেট ইন, স্যার ?
আচমকা সম্বিৎ ফিরে পেলেন জেনারেল ওয়াকার। ও হ্যাঁ, তোমাকে কেন জানি ডেকে পাঠিয়েছিলাম ?
স্যার, ব্রহ্মপুত্রের…
আরে হ্যাঁ, হ্যাঁ। হেনরির কথা শেষ হওয়ার আগেই কথা কেড়ে নিলেন জেনারেল। তা তুমি না কে একজন লোকের কথা বলেছিলে আমাকে। কি নাম তার ?
ইয়েস স্যার, ওর নাম কিনথাপ।
এ আবার কেমনতর নাম। পদবী টদবী কিচ্ছু নেই ?
না স্যার, পাহাড়ীদের যে ক্ল্যানে তার জন্ম, তাঁদের কোনও পদবী হয়না।
থাকে কোথায় ?
দার্জিলিঙের কাছেই এক পাহাড়ী গ্রামে।
পেশা ?
সাধারণ গ্রাম্য দর্জির কাজ করে স্যার। তা ছাড়া কখনো-সখনো তিব্বতী বিত্তবান লামা বা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মালপত্র বয়ে নিয়ে যায় বিভিন্ন বৌদ্ধ মঠে। তিব্বতের বিভিন্ন প্রান্তরে কুড়ি পঁচিশ বার যাওয়া আসা করেছে সে। রাস্তাঘাট অনেকটাই চেনে। তিব্বতী ভাষা গড়গড় করে বলতে পারে। দার্জিলিঙে থাকলেও তাঁদের আদি নিবাস সিকিমে। তারও আগে পূর্ব তিব্বতের কোন এক গ্রাম থেকে এসেছিলেন তার পূর্ব পুরুষ।
বয়স কত ?
জন্মের সাল তারিখ সে নিজেও জানেনা। তবে বলেছে, বছর পাঁচ ছয়েক আগেই দেড় কুড়ি পেরিয়ে গেছে।
তার মানে ৩৫-৩৬ ? হতাশায় শ্রাগ করলেন জেনারেল। বললেন, তুমি তো কোনোদিন বরফের রাজ্যে যাওনি, তাই বুঝতে পারছোনা, এই বয়সে মাসের পর মাস পাহাড়ের চড়াই উৎরাই ভাঙা কি কষ্ট !
ক্যাপ্টেন হেনরিও নাছোড়বান্দা। উপরওয়ালার প্রতি যথাযথ বিনয় দেখিয়েই বলল, স্যার, আমার তো মনে হয় এই বয়স টা বরং ভাল। কেন না, আর দশজন পাহাড়ী মানুষের মত কিনথাপ পাহাড় ভাঙতে এখনও যথেষ্ট সাবলীল, আর কম বয়সী ছোকরা নয় বলে তাকে কেউই সন্দেহও করবেনা। আমাদের কাজের জন্য কিনথাপই হবে যথোপযুক্ত ব্যক্তি।
যুক্তিটা মনে ধরল জেনারেলের। আধজ্বলা চুরুটটা ফায়ারপ্লেসে ছুঁড়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, দার্জিলিং যাওয়ার ব্যবস্থা করো। সম্ভব হলে আগামীকালই আমি দার্জিলিং যেতে চাই।
বললেই তো আর হয়না। চিঠি চালাচালি করে সরকারি আজ্ঞা আদায় করে প্রস্তুতি নিতে নিতেই কেটে গেল তিন মাস। জেনারেল ওয়াকার আর ক্যাপ্টেন হেনরি যেদিন দার্জিলিং পৌছালেন, পাহাড়ের আকাশে তখন বসন্তের আগমনী প্রকটিত। পথের বাঁকে বাঁকে ঝরনা গুলোর জলধারা কমে এসেছে। প্রতিটি গাছেই ফুলের বাহার যেন ফেটে পড়ছে। পাখ-পাখালী আর প্রজাপতিরা আনন্দে আত্মহারা। পাতায় পাতায় জমে থাকা তুষারকণা ঝেড়ে ফেলে গগনচুম্বী ফার গাছ গুলো ঘন সবুজে ছয়লাপ। যেন কাজল-বরণী দীর্ঘাংগী পল্লীবালা এইমাত্র চান সেরে এলো পুকুরঘাট থেকে। চুলের গোছা চুঁইয়ে এখনও জলকণা পড়ছে টুপ্ টাপ্। কাঞ্চনজঙ্ঘা তার অপূর্ব রূপ নিয়ে ঝিকমিক করছে।
সরকারি অতিথিশালায় উঠলেন দুজনে। ডেকে পাঠালেন কিনথাপকে। -দশফুট উঁচু দরজার চৌকাঠের তলা দিয়ে যখন অর্ধেক হাইটের লোকটি ঘরে ঢুকছিল, একেবারেই বেঁটে দেখাচ্ছিল তাকে। হাঁটু অব্দি গড়ানো গাঢ় নীল একটা জোব্বা মতন জামা গায়ে দিয়ে যে মঙ্গোলীয় লোকটি এখন জেনারেল ওয়াকারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, তার নাম কিনথাপ। মাথায় রংচটা একটা ইয়াকের চামড়ার টুপি, গলায় গোটা তিনেক মালা। এর মধ্যে একটা বোধহয় রুদ্রাক্ষের, বাকি দুটো রঙচঙে পাথরের। তামাটে রঙের মুখে এই বয়সেই বলিরেখা ফুটে উঠছে। থুতনিতে গোটা কয় দাড়ি, আর নাকের নীচে পঁচিশ তিরিশটা অবিন্যস্ত গোঁফও দেখা যাচ্ছে। খালি পা দুটোতে সামান্য কাদা লেগে আছে। প্রথম দর্শনে বিশেষ পছন্দ হলনা জেনারেলের। কিন্তু দোভাষীর মাধ্যমে কথা বলে বুঝলেন, প্রচণ্ড মানসিক শক্তি আছে লোকটার। যত কঠিন কাজের কথাই তিনি বললেন, সে হয় জবাব দিয়েছে “পারবো” অথবা বলেছে “শিখে নেবো”। শুধু মুখের কথা নয়, লোকটার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ থেকেই মনে হচ্ছিল, পারবে, লোকটা পারবে।
সংসার চালানোর জন্য সামান্য কিছু টাকা তার স্ত্রীর হাতে দিয়ে, তাকে নিয়ে আসা হল দেরাদুনে। শুরু হল ট্রেনিং। অভিযানের সময় হাতে কাগজপত্র কিছু থাকতে পারবে না, অথচ দিন-রাত্রি, সপ্তাহ-মাস সন-তারিখ, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা, সব কিছুই সঠিক ভাবে মনে রাখতে হবে কিনথাপকে। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের পরিবর্তে চাঁদের কলার পরিবর্তনের সাথে হিসাব মনে রাখার পদ্ধতি শেখানো হল। খালি পায়ে না হেঁটে জুতো পায়ে দিয়ে হাঁটা শেখানো হল। প্রতিটি পদক্ষেপ এক সমান দূরত্বে ফেলার কায়দা রপ্ত করানো হল, যাতে দু’ফুটের চেয়ে বেশী না হয়। নামজপের মালা থেকে আটটা রুদ্রাক্ষ সরিয়ে নিয়ে মোট একশ’টি রুদ্রাক্ষ রাখা হল, যাতে গণনা করতে সুবিধা হয়। কিনথাপ ফিরে এসে তার অভিযানের বয়ান দিলে যাতে তিব্বতের একটা বিশ্বাসযোগ্য ম্যাপ তৈরি করা যায়, তার জন্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার দিনের হিসাব দিতে হবে। সেই হিসাবে দিন কে কনভার্ট করতে হবে ঘণ্টায়, ঘণ্টাকে কনভার্ট করতে হবে মিনিটে, আর সেই মিনিটের হিসেবে পদক্ষেপ দিতে হবে কিনথাপ কে। এগুলোও শেখানো হল। এ ছাড়া কিনথাপকে দেওয়া হল ফুট ছয়েক লম্বা একটা বিশেষ লাঠি, যা দিয়ে তার পাহাড়ের চড়াই উৎরাই ভাঙতে সুবিধে হবে। আসলে, সেই লাঠির ভিতরে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল একটা ভাল থার্মোমিটার। সেই আমলে লুকিয়ে কোনও জায়গার উচ্চতা নির্ধারণ করার জন্য থার্মোমিটারই ছিল সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। সমতলে ১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে জল বাষ্প হতে আরম্ভ করলেও বিভিন্ন উচ্চতায় তার তফাৎ হয়। রাতের খাবার রান্নার সময় চুপিচুপি ওই লুকোনো থার্মোমিটার ফুটন্ত জলে ডুবিয়ে দেখে নিতে হবে, কত ডিগ্রি উষ্ণতায় জল ফুটতে শুরু করেছে। সেই হিসেব থেকে বের করতে হবে ওই জায়গাটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কত উঁচুতে রয়েছে। সব কিছুই করতে হবে খুবই আন্তরিকতার সাথে এবং অবশ্যই সঙ্গোপনে। কখনো কাউকে সন্দেহ প্রকাশ করার কোনও সুযোগ দেওয়া চলবে না। তা সত্বেও যদি কিনথাপের আসল উদ্দেশ্য কেউ টের পেয়ে যায়, অত্যাচার চালায়, তা হলেও মুখ খোলা যাবেনা। সংগৃহীত তথ্যাবলী কোথাও লিখে রাখা যাবে না, রাখতে হবে স্মৃতিতে। কষ্ট সহ্য করতে হবে প্রচুর। ভেঙে পড়লে চলবে না। ক্যাপ্টেন জেনকিন্স এবং খোদ জেনারেল ওয়াকারের কঠোর তত্বাবধানে প্রায় ছয়মাস ধরে কিনথাপের ওই ট্রেনিং একদিন শেষ হল।
প্রথম পর্ব এখানে পাবেন: ইতিহাসের বিস্মৃত নায়ক কিনথাপ্ – প্রথম পর্ব
এবার যখন সামনে এসে দাঁড়াল কিনথাপ, জেনারেল ওয়াকারের মনে হল, এ লোকটা পারবে। ছ’মাসে অনেকটাই ধারালো হয়েছে তার দেহ, তার কর্মদক্ষতা ও ক্ষমতা। বেশ কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে জেনারেল শুধালেন, “আর ইউ নাও রেডি ফর দ্য মিশন” ? দোভাষীর বয়ানে প্রশ্নটা শুনে অল্প মাথা নাড়ল কিনথাপ। জেনারেলের পরিকল্পনা সংক্ষেপে এই রকম। কালিম্পং থেকে এক কাপড় ব্যবসায়ীর মালবাহী পোর্টার হিসেবে তিব্বতে ঢুকবে কিনথাপ। তারপর ধীরে ধীরে উত্তরে গিয়ে সাংপো নদী পাওয়ার পর জলধারার সাথে সাথে পূর্বদিকে এগিয়ে যাবে। যতদূর যাওয়া সম্ভব, ততটুকুই যাবে। পার্বত্য দুর্গমতার জন্য যদি সত্যিই এগোনো সম্ভব না হয়, তা হলে ফিরে আসবে। প্রাণের ঝুঁকি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ মরে গেলে যেটুকু তথ্য আহরণ করা যাবে, তাও নষ্ট হয়ে যাবে। তবে শেষ যে জায়গা পর্যন্ত যাওয়া যাবে, সেখান থেকে ফিরে আসবে লাসা-য়। লাসায় থাকা কলকাতার কোনও এক কাপড় ব্যবসায়ীর মাধ্যমে কালিম্পঙে প্রবীণ পর্বতারোহী নেম সিং-এর কাছে অথবা কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে খবর জানাতে হবে, মাস তিনেক পর কোন নির্দিষ্ট দিনে সে আবার পৌছাতে পারবে সেই আগের জায়গায়। তারপর আবার সেই দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হবে সেখানে, যেখান অব্দি আগের বার গিয়েছিল। গোপনে নদীর জলে ভাসিয়ে দিতে হবে ৫০০টি সমান মাপের গাছের ডালের টুকরো। তবে ভাসিয়ে দেওয়ার আগে প্রতিটি টুকরোতে লাগাতে হবে ওয়াকার সাহেবের দেওয়া ধাতুর রিং। ফোর্ট উইলিয়ামে প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী সার্ভে অব ইন্ডিয়ার তিনটি দল শদিয়ায় লোহিত, দিবং আর সিয়াং নদীর তীরে ছাউনি ফেলে খুঁজে দেখবে কোন নদী দিয়ে ভেসে আসছে ওই রিং-পরানো গাছের ডাল গুলো। এ ভাবেই প্রমাণ পাওয়া যাবে, সাংপো আসলে সত্যিই ব্রহ্মপুত্রের উৎস কিনা। সেই সঙ্গে এটাও জানা যাবে, তিনটি বড় নদীর কোনটি আসল সাংপো। সভ্যতাগর্বী ইংরাজের কাছেও সেদিন এর চাইতে বেশী নির্ভরযোগ্য কোনও পদ্ধতি জানা ছিল না।
১৮৭৯ সালের এপ্রিল মাসের কোনও এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে কিনথাপের গলায় সাদা একটি স্কার্ফ পরিয়ে, হ্যান্ডশেক করে জেনারেল ওয়াকার বিদায় জানিয়ে বলেছিলেন, “আশা করছি তুমি এই অভিযানে সফল হবে। সর্বশক্তিমান তোমাকে সব রকম বিপদ থেকে রক্ষা করুন”। শুরু হয়েছিল কিনথাপের সেই ঐতিহাসিক যাত্রা। দার্জিলিঙে পরিবার পরিজনের সাথে দেখা করে দু-দিনের মধ্যেই কিনথাপ চলে গিয়েছিলেন কালিম্পং। সেখান থেকে নাথুলা। নাথুলা থেকে লাসা তখন অনেকটাই ব্যস্ত পায়ে-হাঁটা পথ। কলকাতা থেকে ব্যবসায়ীরা যায় লাসা, আর লাসা থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষু ও তীর্থযাত্রীরা আসে বুদ্ধগয়ায়, লুম্বিনীতে, কলিঙ্গে। লুম্বিনী ফেরত এক তীর্থযাত্রী দলের সঙ্গে মিলে গেল কিনথাপ। মংগোলীয় মুখাবয়ব, বৌদ্ধ ভিক্ষুর বেশভূষা আর অনর্গল তিব্বতী ভাষা জানা থাকায় কেউই কোন সন্দেহ করল না। দিন পনেরোর পদযাত্রার পর দেখা পাওয়া গেল সাংপো-র। পশ্চিম থেকে পুবে নীল হিমশীতল জল বয়ে নিয়ে ছুটে চলেছে ইয়ারলুং জাংবো বা আমাদের পরিচিত সাংপো নদী। কিন্তু এখানে থামলে চলবে না। সঙ্গের অন্য তীর্থযাত্রীরা সন্দেহ করবে। যেতে হবে লাসা। সেই বরফগলা জল পেরিয়ে আরও একদিনের পথ এগিয়ে পৌছালো লাসা নগরে। সুন্দরী লাসা, স্ব-আরোপিত ঘোমটার আড়ালে থাকা রহস্যাবৃত লাসা। কলকাতার বাঙালি ও মাড়োয়াড়ি ব্যবসায়ী ছাড়া অন্য কোনও বিদেশী সেখানে প্রবেশ করতে পারেনি সেইদিন পর্যন্ত। লাসা নদীর উত্তর ঢালে লাল পাথরের পাহাড় মারপো-রি বা অবলোকিতেশ্বর। তারই কোলে পোটালা রাজপ্রাসাদ, আর রাজপ্রাসাদকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে গোটা শহরটি। পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় রয়েছে প্রায় দশটির মত বড় বড় বৌদ্ধ গুম্ফা। ওই গুম্ফা গুলোতে ঘুরতে যাওয়ার নাম করে কিনথাপ সেই তীর্থযাত্রী দলের কাছ থেকে সরে পরে। সুযোগ খুঁজতে থাকে সাংপোর পাড়ে ফিরে যাওয়ার। পেয়েও যায় এক মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত চীনা লামার সাহচর্য। এই লামা-ও যেতে চায় পূর্বে, আরও পূর্বে। একদিন ভোরবেলা দুজনে মিলে লাসা নদীর পাড়ে পাড়ে বেরিয়ে পড়ে সাংপোর দিকে। একদিন এক রাত্রির পর এসে পৌছায় লাসা আর সাংপো নদীর সঙ্গমস্থলে। শুরু হল কিনথাপের আসল অভিযান।
চলবে ……….
Comments are closed.