Also read in

Durga Pujo fun is incomplete when you are not in Silchar" Rai, Nilima, Dolonchapa

শিলচর। চার অক্ষরে সমৃদ্ধ। একটি শহরের নাম। কিন্তু আমাদের কাছে শিলচর শুধু নিছক একটি শহর নয়। এক আকাশ ভালোবাসা। এক বুক অভিমান। গর্বে মাথা উঁচু হয়ে যাওয়া। যারা শিলচরে থাকেন তাদের জন্য এটি ‘আমার শহর’। কিন্তু যারা শহর থেকে অনেক দূরে প্রবাসে থাকেন তাদের হৃদয়ের অনেকটা জুড়ে এই শহর শিলচর। আসলে কর্মসূত্রে কিংবা আরও বিভিন্ন কারণে প্রবাসে থাকলেও জড়টাতো রয়ে গেছে শিলচরেই।শহরটা আজও অস্তিত্বের অনেকটা জুড়ে আছে।
সেই পুরোনো দিনের গল্প, শহর ঘিরে অফুরান স্মৃতি, সুখে দুঃখের অফুরন্ত কথা যাতে করে ভাষা খুঁজে পায়, তাই যারা শহর থেকে দূরে অন্য শহরে কিংবা অন্য দেশে থাকেন তাদের কথা ভেবেই আমাদের এই নতুন কলাম। এখানে নির্বাচিত ব্যক্তিদের পাশাপাশি অন্যান্যরাও অংশগ্রহণ করতে পারবেন। তাদের স্মৃতি, শহর ঘিরে অনুভূতি, ভালোলাগা, হারিয়ে যাওয়া কথা আমাদেরকে মেইলের মাধ্যমে লিখে পাঠাতে পারেন।

রাই ধর
আইনজীবী
পুনে

প্রতিনিয়ত যে শহরটা আমার মনের মধ্যে ঘোরাঘুরি করে সেই শহর শিলচরকে নিয়ে আজ কিছু লেখার সুযোগ পেয়েছি । লিখতে বসে চিন্তা করছি কি দিয়ে শুরু করব।কারণ লেখার বিষয়তো ফুরোবার নয়,যাক যেহেতু দূর্গা পূজা আসন্ন,তাই আজ তাকে কেন্দ্র করেই আমার ভাবনার জাল ভাষা খুঁজছে।
দূর্গা পূজার কথা মনে হলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে শিশির ভেজা ঘাসে পড়ে থাকা শিউলি ফুল, গাছ ভর্তি স্থল পদ্ম ফুল। আমাদের বাড়ির পেছনে বিশাল পুকুর ছিল যার পাড় ধরে প্রচুর গাছগাছালি ছিল। সকাল বেলা ঠাম্মার সাথে গিয়ে ফুল তোলা আজও খুব মনে পড়ে।

মহালয়ার দিন থেকেই শুরু হয়ে যেতো পুজোর প্রস্তুতি। ভোর বেলা ঠাম্মা রেডিওতে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডী পাঠ চালিয়ে দিতেন আর তা শুনে মহালয়ার দিন শুরু হত। ছোটবেলাকার অভ্যাস আজও একটুকুও বদলায়নি। আজও কিন্তু প্রবাসে থেকেও মহালয়ায় চণ্ডী পাঠ শুনতে ভুলি না আর অফিস থেকে ছুটিও নিই। দুই বোন মিলে প্রচুর নাচের অনুষ্ঠানও করতাম তখন পুজোর আগে।

এখনকার মত আগে এত প্রাচুর্য ছিল না জামাকাপড়,জুতো এসবের। তাই সারাবছরে কেউ উপহার দিলে সেগুলো জমিয়ে রাখতাম পুজোতে পড়ব বলে। সকাল বেলা উঠে স্নান করে নতুন জামা কাপড় পড়ে রাধামাধব রোড এর মণ্ডপে যাওয়া আর বিকেল বেলা বাড়ির সবাই মিলে প্যাণ্ডেলে প্যান্ডেলে পূজা দেখা, বাইরে খাওয়া, আহা কি আনন্দের দিনটাই না ছিল! যেহেতু তখন বাইরে খাওয়া দাওয়া করার এত প্রচলন ছিল না তাই বছরে এই একবারই সুযোগ আসত। সত্যি সবমিলিয়ে খুব মজার দিনগুলো ছিল।পুজো এলেই ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করে আমার প্রিয় শহর শিলচরে।

আমাদের যেহেতু একান্নবর্তী পরিবার তাই আলাদা করে কেউ কিছু কিনত না। আমাদের ছোটকাকু ব্যবসার কাজে যখন কলকাতা যেতো পূজার আগে, তখন সবার জন্য বাজার করত কলকাতা থেকে। যেদিন জিনিসগুলো শিলচরে পৌঁছোত সেদিন সে কি আনন্দ বলে বোঝাবার নয়! ঠাম্মা তার বিছানার উপর পসার নিয়ে বসে একে একে সবাইকে ডেকে জামা কাপড়গুলো হস্তান্তর করত।যদিও বাবার কাছ থেকে আলাদা করে কিছু পেতাম না। তবে বাবা স্কুলের ছুটি পড়লে দুই বোনকে নিয়ে স্কুটারের পেছনে বসিয়ে সেন্ট্রাল রোডের সন্তোষকাকুর পাটোয়া স্টোর এ নিয়ে যেতো চুড়ি, মালা, কানের দুল আর নেইলপলিশ কিনতে। তবে হ্যাঁ, সেটা শুধু দুই বোনের জন্য কেনা হত না , কেনা হত মিষ্টি পিসি, পিসতুতো দুই বোনের জন্যও।

দশমীর দিনে সকাল থেকে আলপনা দেবার তোড়জোড় চলতে থাকতো। কে কত বেশি জায়গা দখল করে সারা বাড়ি জুড়ে আলপনা দেবে,কারটা কত বেশি সুন্দর হয়, তা নিয়ে প্রতিযোগিতা। দুপুর বেলা সবাই আসত বাড়িতে একসাথে খাওয়া দাওয়া করবে বলে। দশমীর দিন বিকেল বেলা দোকানের বারান্দায় পরিবারের সবাই বসে মূর্তি বিসর্জন দেখা চলত।সেটা চলতে থাকত সন্ধ্যা পর্যন্ত। তারপর বড়দেরকে প্রণাম করা, মিষ্টি মুখ করা……ইস্, দিনগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে! কিন্তু সেটাই শেষ ছিল না, পরের দিন থেকে ঠাম্মার সাথে আত্মীয় স্বজনের বাড়ি গিয়ে প্রণাম করার পর্ব শুরু হত। আর তখন তো
কেউ কেনা মিষ্টি খাওয়াত না, ঘরে বানানো নাড়কেল নাড়ু,কুচো নিমকি,এলোঝেলো, শুকনো পুলিপিঠে, আরও কত কি যে খাওয়াত! সেই দিনগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেল, ভাবলেই চোখে জল আসে। তবে এখনও যখন শিলচরে যাই তখন দেবদূতের সামনে চাট খেতে ভুলি না, আর ভগবতীর সামনে ঘটি গরম আর ফুচকা খেতেও ভুল হয় না। আজও যখন ভাই বোনেরা একসাথে বসি তখনও আড্ডাটা শিলচর দিয়ে শুরু হয় আর শিলচর দিয়েই শেষ হয়।

নীলিমা চক্রবর্তী
গৃহবধূ
নয়া দিল্লি

আজ “মহলয়া”র রেকর্ডটা শোনা শেষ হবার সাথে সাথেই আমার মন চলে গেল আমাদের স্বপ্নের শহর শিলচরে।আমার জন্ম থেকে প্রায় ৬১ বছর বয়স পর্যন্ত কাটিয়েছি যেখানে।এখনও প্রত্যেক বছর বা দুবছরে একবার যাই।তাই সব সময় স্মৃতি গুলো মনে আসে।

কয়েকদিন পরেই শুরু হয়ে যাবে “দূর্গা”পূজা।কত স্মৃতি যে মনে ভিড় করে আসছে বলে শেষ করতে পারবনা। পুজোর জন্য কাপড় কেনা শুরু হয়ে যেত দু-তিন মাস আগে থেকেই। কারণ তখন নিজেদের আত্মীয় স্বজনদেরকে নতুন কাপড় দিতে পারলে মনটা খুব ভাল লাগত। বিশেষ করে বাচ্চা আর বুড়োদেরকে দিলে ওদের খুশির চেহারাটা দেখে মন ভরে যেত।

আজ লিখতে বসে “মহলয়া”র কথা মনে পড়ে গেল। ভোর বেলাতেই রাস্তায় লোকের ঢল নামত।আর বরাক নদীর ব্রিজে তো মেলা চলছে মনে হত। আমরাও বেরিয়ে পড়তাম। বাড়ি ফেরার পথে “অন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার”বা ‘রাধামাধব মিষ্টান্ন ভাণ্ডার” এ ঢুকে চা আর সিঙ্গারা খেয়ে ঘরে ফিরতাম। তারপর শুরু হতো কে কার জন্য কি কিনল এগুলো দেখানো। এটা খুব ভাল লাগত। দূর্গাপূজা‌র আনন্দ যতটা, ততটাই মজা পেতাম দূর্গাপূজা উপলক্ষে কেনা এই জিনিসগুলো দেখতে। আমাদের “চাঁদমারিতে” আমার ছোট বেলায় দূর্গা পুজো হতনা। তাই আমরা ঐ সময় বিকেলে কয়েক জনের গ্রুপ করে বেরোতাম পুজো দেখতে। আমার বেশ বয়স কালে আমাদের চাঁদমারিতে শুরু হলো দূর্গাপূজা। সেই দিনগুলো মুহুর্তে স্মৃতির হাত ধরে সব কিছুকে পেছনে ফেলে সামনে এসে দাঁড়াল। আর তাই পৌঁছে যেতে ইচ্ছে করছে সেই দিনগুলোতে আর আমার প্রিয় শহরটাতে।

পূজার “ষষ্ঠী থেকে বিজয়া দশমী”র শান্তি জল পর্যন্ত কাজ সব ভাগ করে নেওয়া হতো যার যার সুবিধা মত। তবে তখন ছেলেরাই বেশি কাজ করত। মেয়েদের দায়িত্ব ছিল পূজার নৈবেদ্য তৈরি করা আর ভোগের রান্না করা। দুপুরের খাওয়া তিন দিনই হতো প্যাণ্ডেলে। (এখন সবকিছুই মেয়েদের দায়িত্ব। কিন্তু প্রত্যেক কাজে ছেলেরাও থাকে।খুব সুন্দর হয় সবকিছু।) প্যাণ্ডেলে খাওয়ার সময় খুব মজা হত। সন্ধ্যায় আরতি হত। ছেলে মেয়েরা মিলে ঢাক,কাশী, শঙ্খ বাজাত।তিন দিন পর বিজয়া দশমী এলে বিসর্জন দেখতে আমরা তারাপুর সদর রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতাম। অনেকেই মূর্তির সঙ্গেও যেত। ঘরে ফিরে সবাই অপেক্ষা করতাম, আর বিসর্জন করে পাড়াতে ট্রাক নিয়ে ফিরতেই চলে যেতাম প্যাণ্ডেলে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে।তখন ভাবতাম আবার অধীর আগ্রহে একটা বছর অপেক্ষা করতে হবে মায়ের আগমনের ।

দোলনচাপা দে
গৃহবধূ
বিলাসপুর, ছত্তিশগড়

শিলচর আমার জন্মস্থান। আজ যখন শিলচর নিয়ে লিখতে বসেছি, তখন অনেক পুরোনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।দূর্গাপুজো দোরগোড়ায়। সকালে শরতের আকাশ দেখলেই শিলচরের কথা মনে পড়ে যায়।মহালয়ার ভোরে লোকারণ্য বরাক ব্রিজ,যদিও কখনো যাওয়া হয়নি।

আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে পূজোর দিনগুলো পারিবারিক উৎসব হিসেবে কাটতো।ভাইবোনরা মিলে বাড়িতেই খুব আনন্দ করতাম।তাছাড়া বাড়ির সামনেই পুজো প্যাণ্ডেল , সন্ধেবেলা যেখানেই যাই না কেন আরতির সময় ঠিক চলে আসতাম। বিজয়া দশমীতে মায়ের সাথে ঠাকুরের পায়ে বই ছোঁয়াতে যেতাম। বিসর্জনের সময় যখন ঠাকুর নিয়ে যেতো মা কাকীমারা উলুধ্বনি দিয়ে মাকে বিদায় জানাতেন। পাড়ার ছেলেরা বিসর্জন থেকে ফিরে এলে তারপর আমাদের বিজয়া শুরু হতো। প্রথমে বাবা-কাকা, মা-কাকীমা, তারপর দাদা বৌদিদের প্রণাম করতাম। পিঠোপিঠি ভাইবোনেরা , তাদের মধ‍্যেও যারা বড় তাদের প্রনাম করতে হতো।তাই নিয়ে খুব হাসাহাসিও চলতো।অম্বিকাপট্টি চৌরঙ্গীতে পুজোর পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে যেতাম।
ভাইফোঁটাতে আমাদের বাড়িতে তিন প্রজন্মের(বাবা, দাদা ও ভাইপো) ফোঁটা হতো।সে ও এক উৎসব।আজ সবটাই স্মৃতি। তবু চোখের সামনে ছবির মত ভেসে উঠছে। আজ দূরে বসে সেসব দিনের কথা আরো বেশি করে মনে পড়ে।

Comments are closed.