From Bangladesh to India; the story of a sacred Kali Puja
দুধপাতিলের সাবর্ণ-মন্দিরে পুজো পান বাংলাদেশের নবীগঞ্জে শ্যামানন্দ বাবার হাতে স্থাপিত শ্যামাকালীর মূর্তি
বরাক উপত্যকার অন্যতম জনপ্রিয় মন্দির হচ্ছে বিলপাড়ের শ্যামানন্দ বাবার আশ্রম। শ্যামানন্দ বাবা ভক্তদের কাছে সন্ন্যাসী বাবা বলে পরিচিত। তার পৈতৃক বাড়ি অধুনা বাংলাদেশের নবীগঞ্জ থানার অধীনে বানিয়াচং গ্রামে। কালীসাধক হিসেবে তিনি তার শিষ্য উদয়গোবিন্দ রায় শর্মা চৌধুরীর বাড়িতে মায়ের মূর্তি স্থাপন করেছিলেন। দেশভাগের সময় আক্রমণকারীরা সেই মুর্তি জলে ফেলে দিয়েছিল, পরবর্তীতে পরিবারের সদস্যরা সেটা খুঁজে বের করেন। তারা ঠিক করেন ভারতবর্ষ থেকে আলাদা হওয়া পূর্বপাকিস্তানে স্বাচ্ছন্দ্যে মায়ের মূর্তি পূজা করা যাবে না। তবে শুধু মা-কালীর মূর্তি নয়, সঙ্গে মা মনসার নৌকা পুজোর রুপোর ঘট, পঞ্চমুখী শিবলিঙ্গ, মধুসূদন শিলা, সব নিয়ে পঞ্চাশের দশকে ভারতবর্ষে চলে আসেন পরিবারের সদস্যরা। পরবর্তীতে করিমগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় তারা থেকেছেন, মায়ের পুজো হয়েছে। শেষমেষ শিলচর থেকে অদূরে দুধপাতিল গ্রামে পাকাপাকিভাবে বসবাস করতে শুরু করেন পরিবারের সদস্যরা। সেখানেই ছোট একটি মন্দির বানিয়ে পুজো হচ্ছে শ্যামানন্দ বাবার হাতে স্থাপিত কালীমূর্তির।
অবিভক্ত ভারতের সিলেট জেলার নবীগঞ্জ থানার অধীনে পাঞ্জারাই গ্রামের জমিদার ছিলেন উদয়গোবিন্দ রায় শর্মা চৌধুরীরা। তাদের বংশের বর্তমান প্রজন্মের প্রতিনিধি পূর্ণেন্দু রায় চৌধুরী দুধপাতিলে প্রায় ৩০ বছর আগে পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করেছেন। এর আগে তার বাবা চেঙকুরি সংলগ্ন কাঞ্চনপুর এলাকায় দীর্ঘদিন ছিলেন। ১৯৬৯ সালে সেখানে একটুকরো জমি কিনে বাড়ি করেন এবং মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। বিভিন্ন কারণে সেই জায়গা ছেড়ে তাদের শিলচর শহরে আসতে হয়েছে, ভাড়া বাড়িতে থাকতে হয়েছে। সবখানেই সঙ্গে ছিলেন পৈত্রিক ঐতিহ্য বহনকারী ঠাকুরের মূর্তিরা। কোনও কোনও মূর্তি প্রায় দুইশ থেকে আড়াইশো বছর পুরনো বলেও পরিবারে গল্প রয়েছে। শ্যামাকালীর মূর্তি বানানো হয়েছে কষ্টিপাথর দিয়ে। কালো মূর্তির গায়ে রুপোর গয়না।
বাংলাদেশের বানিয়াচং গ্রামেও শ্যামানন্দ বাবার হাতে স্থাপিত একটি কালী মন্দির রয়েছে। সেই একই ধাঁচে বানানো ছোট মূর্তি শিলচরের পাশে দুধপাতিল গ্রামে পূজিত হচ্ছেন। সম্পূর্ণ শাক্ত মতে তার পুজো হয়। প্রতিদিন একই পদ্ধতিতে পুজো হয়। শুধুমাত্র কালীপুজোর অমাবস্যায় বলি দেওয়ার প্রথা রয়েছে। নানান আর্থিক অনটনের মধ্যে দিয়ে গেলেও একদিনের জন্যও মায়ের পুজো বন্ধ হয়নি, এমনটাই জানালেন পূর্ণেন্দু রায় চৌধুরী। তিনি বলেন, “আমার বাবার ঠাকুরদাদার সময়ে শ্রী শ্রী শ্যামানন্দ বাবা আমাদের বাড়িতে আসেন। সেই সময় আমার ঠাকুরদাদা যুবক, তিনি শ্যামানন্দ বাবার কাছে দীক্ষিত হন। পরবর্তীতে শ্যামানন্দ বাবা আমাদের বাড়িতেই মায়ের মূর্তি স্থাপন করেন। আমাদের পরিবার এবং ঐতিহ্যের মূল প্রতীক হচ্ছেন এই মূর্তিরা। দেশভাগের পর পাকিস্তানের সেনারা একের পর এক হিন্দু মন্দির ভেঙ্গেছে। তারা যখন শুনতে পেয়েছে আমাদের বাড়িতে ঐতিহ্যবাহী মা-কালী রয়েছেন, সেখানেও আক্রমণ করেছে। মায়ের মূর্তি জলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর সেটা খুঁজে পাওয়া গেলেও দেখা যায় মায়ের একটি হাত ভেঙে গেছে। তবে সেই মূর্তি নিয়েই পাকিস্তান অধিকৃত সিলেট ত্যাগ করেন আমাদের পূর্বপুরুষরা। ভারতবর্ষে এসে অনেক জায়গায় থাকতে হয়েছে। ১৯৬৯ সালে কাঞ্চনপুর এলাকায় একটি জমি কিনে বাড়ি বানালেও সেখানে একসময় থাকা যায়নি। শেষমেষ দুধপাতিলে আমরা জমি কিনি। এর একবছর পরেই আমার বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যান। তারপর থেকে প্রতিদিন আমাদের বাড়িতে মায়ের পুজো হয়। আমরা আর্থিক অনটনের মধ্যে থাকলেও কোনওদিন কারও কাছে মায়ের পুজোর জন্য সাহায্য চাইনি। এক সময় আমাদের ঘর সেরকম ভাল ছিলনা, মায়ের আলাদা মন্দির ছিল না। পরবর্তীতে তার আশীর্বাদে ছোটখাটো একটি মন্দির হয়েছে। আমরা যেহেতু সাবর্ণ গোত্রের তাই মন্দিরের নাম দিয়েছি সাবর্ণ মন্দির। এই সাবর্ণ মন্দির আলো করে রয়েছেন শ্রী শ্রী শ্যামানন্দ বাবার হাতে স্থাপিত মা-কালীর মূর্তি এবং সঙ্গে রয়েছেন পঞ্চানন শিব, মা মনসা এবং মধুসূদন শিলা। আমাদের কুলদেবতা হচ্ছেন কালী-মধুসূদন, অর্থাৎ মা-কালী এবং নারায়ন মধুসূদন।”
ছোট মন্দিরে পুজো হলেও জৌলুস কম থাকেনা, এমনটাই বললেন পূর্ণেন্দু চৌধুরীর বোন আভা বাগচী। আভা বাগচীর বিয়ে হয়েছিল করিমগঞ্জের বাসিন্দা বাবুল বাগচীর সঙ্গে। বিয়ে করে অন্য বাড়িতে চলে গেলেও, তারা প্রায় সারাটা জীবন কাছাকাছিই থেকেছেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল মায়ের পুজো। মা-কালী পরিবারকে এক সূত্রে বেঁধে রেখেছেন। আভা বাগচী বলেন, “আমরা সারা জীবন শুনেছি শ্যামানন্দ বাবার পদধূলি আমাদের বাড়িতে পড়েছে। তার স্থাপিত মা-কালীর পূজা সবসময় জৌলুসভরে হয়েছে। নানান আর্থিক অনটনের মধ্যে দিয়ে গেছেন আমাদের বাবা এবং ঠাকুরদারা। দেশভাগের শিকার হয়ে সবকিছু ছেড়ে শুধুমাত্র মাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিলেন। এই দেশেই আমাদের জন্ম হয়েছে এবং ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছি। আমাদের জীবনেও নানান ঝড়ঝাপটা গেছে, কিন্তু মনে হয়েছে সবসময় মা কালী আমাদের রক্ষা করে যাচ্ছেন। এখন আমাদের ছোট্ট বাড়িতে একটি মন্দির হয়েছে, মন্দিরে মা রয়েছেন, বাকি বংশের ঐতিহ্যবহনকারী ঠাকুরের মূর্তি রয়েছে। এরা প্রত্যেকেই আমাদের কাছে পরিবারের সদস্যের মতো। তাদের খাবার থেকে শুরু করে গরম লাগা, ঠান্ডা লাগা পর্যন্ত আমরা অনুভব করি।”
বাড়িতে ছোট্ট মন্দির থাকলেও নানান ঝড়-ঝাপটা সামলাতে হয় রায়চৌধুরী এবং বাগচী পরিবারকে। দুধপাতিলের যে অংশে তারা রয়েছেন তার সামনে একটি পাঠশালা স্কুল রয়েছে। দীর্ঘ ত্রিশ বছর যে রাস্তা ব্যবহার করে মন্দিরে যাওয়া যেত, সেটা এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিদ্যালয়ের সামনে বিরাট দেয়াল গড়ে উঠেছে, এতে বন্ধ হয়েছে মায়ের মন্দিরে পৌঁছানোর রাস্তা। অনেকটা ঘুরে সেখানে যাওয়ার রাস্তা থাকলেও চরম হেনস্তার সম্মুখীন হচ্ছেন পরিবারটি। যারা একসময় বাংলাদেশে জমিদার হিসেবে জীবন কাটিয়েছেন, তাদের আজ প্রায় নিজের বাড়িতে পৌঁছানোর রাস্তাটুকু নেই। দেশভাগের ইতিহাস ঘাটলে এমন অনেক পরিবার পাওয়া যায়, যারা সর্বহারা হয়ে ভারতবর্ষে এসেও আবার নিজেদের জীবন গড়ে তুলেছেন। তবু নানান সময়ে তাদের গায়ে বিভিন্ন তকমা লাগিয়ে বিপন্ন করার চেষ্টা চলে। মানুষের সঙ্গেই উদ্বাস্তু হতে হয় ঠাকুরকেও।
Comments are closed.