Gandhimela from the memory lane
The author has penned down the story in her mother tongue and to keep the essence we decided to retain the original version and hence have not translated it.
গান্ধীমেলাঃ সেকাল ও একাল
স্মৃতির পাতা থেকে
পঞ্চদশী কিশোরী লটারির স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে। স্থান গান্ধীমেলা। হাতে চিরকুট। সদ্য সমাপ্ত লটারির ফলাফল বুঝার বৃথা চেষ্টায় ব্যস্ত। পাশ থেকে একজন বলে উঠল, “আরে তুমিতো প্রথম পুরষ্কার পেয়েছ”। হতবাক্ কিশোরী কিছু বোঝার আগেই স্টলের মালিক জিজ্ঞেস করল, “কি পুরষ্কার চাই”? কিছু চিন্তা না করে গ্লাস সেটের দিকে আঙুল চলে গেল। এই প্রথম এভাবে লটারি খেলা আর পুরষ্কার জেতার অভিজ্ঞতা। শুধু তাই নয়, এই প্রথম পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে একা গান্ধীমেলা দেখতে আসা। দুটো অভিজ্ঞতাই মনে শিহরন জাগানোর জন্য যথেষ্ট। বুকের ভেতরে কে যেন হাতুড়ি নিয়ে প্রহার করছে। বন্ধুদের অনুরোধে এক এক করে চার বার খেল্লাম আর আশ্চর্যজনকভাবে চার বারই প্রথম পুরষ্কার পেলাম। এখন এই লটারি খেলাগুলো মেলার ভেতরে বসে না। বাইরে রাস্তার পাশে জুয়োর মত করে লটারি খেলা চলছে। তখন কিন্তু পরিস্থিতি অন্য রকম ছিল। আমার তখন আনন্দ হচ্ছিল তো বটেই কিন্তু মনের মধ্যে একটা মিশ্র অনুভূতিও ছিল। অভিভাবক ছাড়া বন্ধুদের সঙ্গে এসে এগুলো খেলা কি ঠিক?
যদিও একটু পরেই এসব ভুলে বন্ধুদের সঙ্গে মেতে উঠলাম গান্ধীমেলা দেখার আনন্দে। আসলে আমাদের সময় আমরা এই গান্ধীমেলার জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে থাকতাম। গান্ধীমেলার আকর্ষণ তখনকার সময় তীব্র ছিল। দু দশকেরও বেশি সময় আগে শিলচরে বিনোদনের জন্য বেশি কিছু ছিল না বলে গান্ধীমেলায় যাবার জন্য আমাদের আনন্দের শেষ থাকত না। স্কুলে আলোচনার মুখ্য বিষয় গান্ধীমেলাই থাকত। এখন আসলে মল থেকে শুরু করে আরো বিভিন্ন বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে শিলচরে। তাই মেলা ঘিরে আকর্ষণ কিছুটা কমলেও ভিড় কিন্তু এখনও নেহাত কম হয় না। মেলা শুরু হওয়ার প্রথমদিকে রোজ প্রায় এক হাজার, মধ্যবর্তী সময়ে ৪ থেকে ৫ হাজার এবং শেষের দিকে রোজ প্রায় ১০ হাজার মানুষ মেলা দেখতে আসেন। রোববারে ছুটির দিনে ভিড়টা কিন্তু তুলনায় বেশি হয়।
তবে ব্যক্তিগত অভিঞ্জতা থেকে বলতে পারি পরে অনেকবার মেলা দেখতে গেলেও, ছাত্রজীবনে মেলা দেখার সেই আনন্দ তেমন করে আর খুঁজে পাইনি। অথচ এখন প্রবাসে বসে গান্ধীমেলার জন্য মন ছটফট করে। কত বড় বড় মেলাও গান্ধীমেলার স্মৃতির কাছে হার মেনে যায়। মা, বাবা, ভাইবোন, আত্মীয় পরিজন সবার সঙ্গে পালা করে বার কয়েক মেলায় যাবার রেওয়াজ ছিল আমাদের সময়। স্মৃতির পাতা উল্টালে স্পষ্ট মনে পড়ে দুপুরে মা’র হাত ধরে সঙ্গে দিদিদের নিয়ে কতবার মেলা দেখতে গেছি। দুপুরে যাবার কারণ অবশ্যই ভাত খাবার পর অফুরন্ত অবসর সময়। তবে এখন সন্ধ্যের পরেই মানুষ বেশি যায়। দিনের বেলা শিলচরের বাইরে থেকে মানুষ বেশি আসে।
সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ইমিটেশন গহনার দোকানগুলো ছিল তখন অন্যতম আকর্ষণ। দোকানে দোকানে ঢুকে দামদর করে ভালভাবে যাচাই না করে কেনাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয় বলে সবার ধারনা ছিল। অথচ আজ এসব হাস্যস্পদ মনে হয়। কত ধরনের দোকান ছিল! স্থানীয় ছাড়া বিশেষভাবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ব্যবসায়ীরা আসতেন। আমরা কিন্তু স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দোকানে যেতে একদম পছন্দ করতাম না। ভিড় জমাতাম ভিন্ রাজ্য থেকে আসা দোকানগুলোতে। এখনতো পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এমনকি বাংলাদেশ থেকেও ব্যবসায়ীরা মেলায় পাড়ি জমাচ্ছেন ব্যবসার জন্য। তখন মেলা দেখার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ হরেক রকম জিনিসও ক্রয় করত এমনকি হাতী, ঘোড়া বিস্কুটও। তখন মেলায় এমন জিনিসও পাওয়া যেত যা কিনা এমনিতে সহজলভ্য ছিল না। এখন কেনাকাটার আধুনিকীকরণে এবং অনলাইন শপিং এর দৌলতে এক ক্লিকে যখন চাহিদার সব দ্রব্য ঘরে এসে হাজির তখনতো সবই সহজলভ্য। তবু অবুঝ মন বলে দল বেঁধে দোকানে দোকানে ঢুকে মেলা ঘুরে কেনাকাটার আনন্দ যে পেয়েছে সে-ই জানে এর মর্ম।
কেনাকাটার সঙ্গে সঙ্গে নাগরদোলা, চড়কি সহ আরো অনেক কিছু চড়ার আনন্দটা সবকিছুকে ছাপিয়ে যেত। যদিও ব্যক্তিগতভাবে এক অজানা ভয় এই আনন্দকে উপভোগ করার সুযোগ দেয়নি। তবে জনসমক্ষে কথাটা কি আনা যায়? বিশেষভাবে বন্ধুদের সামনে? তাই সেদিনও এমন একটা ভাব করলাম যে এগুলো চড়া আমার মোটেই ভাল লাগে না। কিন্তু বন্ধুরাও নাছোড়বান্দা। আমাকে ছাড়া উঠবেই না। অগত্যা এতদিন ধরে চেপে রাখা সত্যটা বেরিয়েই গেল। হাসির ফুয়ারায় টিকে থাকা মুস্কিল। তবে সেদিন কিন্তু সবাই নাগড়দোলাতে চলে যাবার পর একা নীচে দাঁড়িয়ে লজ্জা লাগছিল। আড়চোখে সবার দিকে দেখছিলাম, ভিতু নাম দিয়ে তাচ্ছিল্য নেইতো কারোর চোখে? আসলে নিজের মনের চোরটাই বেরিয়ে আসতে চাইছিল। এ এক অদ্ভুত অস্বস্তি। যারা এই দলে পড়েন তারাই কেবল এই অনুভূতিটা বুঝতে পারবেন। যদিও তখনও এবং এখনও মেলায় আসা নাগরদোলা ও চড়কিতে শিশু, গৃহবধূ, তরুণী, কখনো কখনো মধ্যবয়স্কাদেরও চড়তে দেখা যায়।
মৌত কি কুয়া, মোটর সাইকেল রাইডিং, ম্যাজিক শো সহ আরো অনেক বিনোদনের ব্যবস্থা থাকলেও মানুষ তার নিজস্ব ভালোলাগা অনুযায়ী ভিড় জমাত ছোট ছোট বিনোদনমূলক দোকানগুলোর সামনেও। বন্দুক দিয়ে ছোট ছোট বেলুন ফোটানোর আকর্ষণ আমাদের সময় খুব ছিল, সে বন্ধুদের সঙ্গেই যাওয়া হোক আর মা বাবার সঙ্গেই। এবারে যদিও ম্যাজিক শো নেই, কিন্তু রয়েছে মৌত কি কুয়া, ছোট সার্কাস, নাগরদোলা, চড়কি সহ নানা ধরনের আকর্ষণ। আর যেটা আগে ছিল না আর এখন খুব বেশি করে দেখা যায় সেটা হচ্ছে সেলফি ম্যানিয়া। মেলায় ঢোকার মুখে গান্ধীজির স্ট্যাচুর সামনে অবস্থিত ফোয়ারা সহ এই স্থানটিকে সেলফি সেন্টার বল্লে বোধহয় ভুল বলা হবে না। বিশ্বজুড়ে যখন সেলফি ম্যানিয়া চলছে তখন গান্ধীমেলা বাদ যায় কিভাবে?
অতি অল্প সময়ের জন্য মেলায় ঢু মারলেও যে অংশে আমাদের না গেলেই না হত সে অংশ অবশ্যই ছিল সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা খাবারের স্টলগুলো। দিল্লি চাট্, বেঙ্গল চাট্, পঞ্জাব চাট্ আরও কত নাম, কত স্বাদের ভিন্নতা! দূর থেকে চাটের গন্ধ আমাদের আকৃষ্ট করত। গন্ধেতেই মুখে জল আসে এমন চাট না খেয়ে কি গান্ধীমেলা দেখা সম্পূর্ণ হতে পারে? সেদিনও এর ব্যতিক্রম হয়নি। মনে করতে অসুবিধে হচ্ছে না আমরা বন্ধুরা সেদিন চাট ভাগাভাগি করে খেয়েছিলাম। অনেক কিছু কিনে, চড়ে পয়সার অভাবে আমাদের কাছে ভাগাভাগি করা ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না। অকপটে এটাও স্বীকার্য স্মৃতির ঘর হাতরালে এখনো অবলীলায় অনুভব করতে পারি সেই আনন্দানুভূতি। আজকালকার দিনের বাচ্চারা অনেক বেশি হাত খরচ পায়। খরচ করতেও ওদের কোথাও বাঁধন নেই। হয়ত ওরা শেয়ারও করে। তবু কোথায় যেন একটা কিন্তু থেকে যায়। এমন আনন্দের সন্ধান কি ওরা জানে?
আবার চাট খেয়েই কিন্তু শেষ হয় না। বাড়ির জন্য প্যাকেট করে নানাবিধ বিস্কুট, মিষ্টি, গরম গরম জিলেবি নিয়ে যাওয়ার রেওয়াজটা খুব ছিল। তবে জিলেবি ক্রয় এবং বিক্রয়ের ঐতিহ্য এখনও বজায় রয়েছে। চাটের ক্ষেত্রে অবশ্য নাম, স্বাদ, দাম, বৈচিত্রতা সব কিছুতেই পার্থক্য এসেছে। আমাদের সময়ের দিল্লি চাট্, বেঙ্গল চাট্, পঞ্জাব চাটের জায়গা নিয়েছে অন্যরা। দক্ষিনের খাবার সহ বিভিন্ন খাবার নিয়ে রেস্টুরেন্টও এখন সংযোজিত হয়েছে মেলার ফুড কোর্টে।
গান্ধীবাগে ছোট পরিসরে শুরু হওয়া গান্দীমেলা আজ তার পরিসর বড় করেছে, স্থান পরিবর্তন করেছে, বর্দ্ধিত হয়েছে তার চাকচিক্য, সাজসজ্জ্বার বাহার। দীর্ঘ পথ পার হয়ে আসার পরও সিনেমার ফ্ল্যাসব্যাকের মতই চোখের সামনে ভেসে উঠে দিনগুলো। গান্ধীমেলার স্মৃতি আজও অম্লান মনের অ্যালবামে। এটা থেকে একটা কথা স্পষ্ট, শিলচর তথা বরাকবাসীর সঙ্গে গান্ধীমেলার সম্পর্ক এতটাই সুদৃঢ় যে শিলচরের বিনোদনের ক্ষেত্রে গান্ধীমেলাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। বরং পরম ভালোলাগার একটা স্থান গান্ধীমেলা। শহরের ঐতিহ্যের সঙ্গে জুড়ে গেছে গান্ধীমেলার নাম।
মেলা দেখে বাড়ি ফেরার পরও প্রকৃত অর্থে কিন্তু এ পর্ব শেষ হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত মেলা থেকে নিয়ে আসা জিনিসগুলো অন্যদেরকে না দেখানো হচ্ছে। আর সেদিনতো লটারিতে প্রাপ্ত চার চারটা পুরষ্কার নিয়ে ঘরে ফিরেছিলাম। তাই বাড়ি ফিরে সবগুলো জিনিস বিছানার উপরে সাজিয়ে বাবার বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করছিলাম। বাবা ঘরে ফিরতেই মুখে এক গাল হাসি নিয়ে বাবার সামনে দাঁড়ালাম। বাহবা পাবার অপেক্ষায় ক্ষণ গুনছিলাম। বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, কোথাও কিছু একটা ভুল হয়ে গেছে। বাবা আস্তে করে উচ্চারণ করলেন, “লটারি মানে তো অন্য অর্থে ভাগ্যের খেলা। বয়সটা তো ভাগ্যের উপর নির্ভর করার নয় বরং কর্মের উপর নির্ভর করে ভাগ্য গড়ার”। সেদিন এর অন্তর্নিহিত অর্থ খোঁজার আগেই মন খারাপের মেঘ কিশোরী মনকে ঢেকে ফেলেছিল। কথাগুলো বাবার মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল বলে দ্বিধা ছিল না মনে মেনে নিতে। কিন্তু আজ যখন পেছন ফিরে তাকাই তখন মনে হয় কত সহজে বাবা সেদিন জীবনের মূল্যবান পাঠ পড়িয়েছিলেন। তাই সেদিনের গান্ধীমেলা দর্শন অন্য অর্থে আমার জন্য শিক্ষনীয় ছিল।
Comments are closed.