Also read in

Here is a special write-up to celebrate the essence of May 19

This is a special feature and does not have an English

ঊনিশে মে: অস্তিত্বের আগ্রাসন

ডঃ জয়তি চক্রবর্তী

বরাক উপত্যকায় কৃষ্ণচূড়া বা বাঁদরলাঠি জানান দিয়ে যায় ঊনিশে মে’র আগমণ বার্তা। ঊনিশ আমাদের মুখের ভাষা, ঊনিশ আমাদের অধিকার, আমাদের অস্তিত্বের আরেক নাম, চেতনার ঠিকানা।

“মায়ের বুকের দুধ
কথাকলি হয়ে ফোটে শিশু চাতকের মুখে
তৃষ্ণার তৃপ্তি শুধু নয়, প্রাণের দোসর-
নাড়িচ্ছেদ অভিজ্ঞান,
নাভিমূলে সুবাসিত অন্তর্লীন মৃগনাভির হয়ে
সারা জীবনের একান্ত সে সঙ্গোপন।”
বিমল চৌধুরী-মাতৃভাষা ‘ঊনিশের কবিতা ও গান;’
সম্পাদনা-দিলীপ কান্তি লস্কর

একটি শিশু যে ভাষায় বুঝতে শেখে, উপলব্ধি করে, বা ভাব প্রকাশ করতে যে শব্দ বেছে নেয় তা তার মায়ের ভাষা। একথা তো সত্যি একটা মানুষের বেঁচে থাকার প্রথম শর্ত খাদ্য বাসস্থান আর পরিধানের বস্ত্র। এই দাবিকে প্রকাশ করতে সে যে ভাষা ব্যবহার করে তা তার মাতৃভাষা। তার অধিকার, তার মুখের ভাষা। তবে পৃথিবীর যে প্রান্তে যখনই মুখের ভাষার অধিকার কেড়ে নেবার নির্মম আগ্রাসন ঘটেছে তখনই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে সেই জাতিগোষ্ঠী। প্রাণবিসর্জনেও পিছপা হয়নি। বর্তমানে বাংলাদেশের ঢাকার রাজপথও রক্তে রাঙ্গা হয়েছিল ১৯৫২ ইংরেজির
একুশে ফেব্রুয়ারি। স্বাধীন বাংলা ও বঙ্গ ভাষার জন্য সেলিম, বরকতদের আত্মাহুতি ব্যর্থ হয়নি। ১৯৭১ এ জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। ঠিক এমনই ঘটনা ঘটেছিল বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনে। ১৯৬০ সালের ২৪ শে অক্টোবর আসাম বিধানসভায় যে বিলটি গৃহীত হয়েছিল তাতে বলা হয়েছিল আসামে বসবাসকারী অসমীয়া ভিন্ন অন্য সব ভাষা গোষ্ঠীকে অসমীয়া ভাষা ব্যবহার করতে হবে সরকারি কাজকর্মে।

এরপরের ইতিহাস আমাদের প্রত্যেকের জানা। রাজ্য ভাষা বিলের কঠোর বিরোধিতা করে কাছাড়ে সংগ্রাম পরিষদ গঠন হল। সমস্ত কাছাড় জুড়ে চলতে লাগলো হরতাল, ভাষা আন্দোলন গণআন্দোলনের রূপ নিল। এর ফলশ্রুতিতে র ১৯ শে মে কাছাড় বন্ধ ও রেল রোকোর সিদ্ধান্ত নিলেন সত্যাগ্রহীরাকিন্তু সরকারি নির্দেশিকা স্তব্ধ করে দিতে চাইল একটি জাতির মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনকে, অবিরাম গুলিবর্ষণে শহীদ হল
১১টি তরতাজা প্রাণ।

কিন্তু বিপন্ন অস্তিত্বকে রক্ষা করতে সেদিন বরাক উপত্যকার সব বাঙালির স্বপ্ন এক হয়ে গিয়েছিল। তাই তৎকালীন সরকার সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু আইনের নানা ফাঁকফোকরে এখনো অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেবার এক নিরন্তর প্রয়াস চলছে। তাই আসামে বসবাসকারী প্রত্যেক বাঙালির মধ্যে ক্রিয়া করে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। হয় মুখের ভাষাকে অবদমিত করা, নয় বিদেশি চিহ্নিত করে হয়রানি করা। এই মুহূর্তে অসমের বাঙালি আরও এক অস্তিত্ব সংকটের মুখে। অসমীয়া বাঙালি বিভাজন নীতি চার দশক আগে যে আন্দোলনের সূচনা করেছিল তা আজ এত বছরে অনেকটা থিতিয়ে এলেও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সেটাকে আবার চড়াও করেছে। হয়তো আবারও একটা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে হবে আসামের বাঙালিকে, হয়তো আবারও শহীদ হতে হবে কয়েকটি তরতাজা প্রাণ।

কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, এ জাতি, নেতাজির, ক্ষুদিরামের, বিবেকানন্দের। তারা একদিকে যেমন ভারতকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছেন, আবার স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে এ দেশ থেকে বিদায় করেছে বিশ্বের সবচেয়ে সভ্য তথা পরাক্রমশালী ব্রিটিশ জাতিকে। বাঙালিরা বিভাজনের নীতি জানেনা। বাঙালির জীবন সাধনা রবি ঠাকুর শিখিয়ে গেছেন ব্যক্তি ভাবনাকে বিশ্ব ভাবনায় উন্নীত করতে। তাই বিশ্ব নেমে এসেছে ভারতের বুকে, সৃষ্টি হয়েছে ‘বিশ্বভারতী’। বাঙালি বিশ্বাস করে, ধর্ম নয়, জাতি নয়, “সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর নাই”। তাই রবীন্দ্র আদর্শের বার্তা বয়ে নিয়ে যাওয়া বাঙালি বিশ্বাস করে মানবিক দৃষ্টিকোণে, তাই আশা রাখে সাম্প্রদায়িক কূটকাঁচালিতে নয়, জাতি বা বর্ণ, বা ভাষার পরিচয়ে নয়- মনুষ্যত্বের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা- এই ভাব আবেগে উগ্র অসমীয়াভাষাবাদীরা এই রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখবেন, চারিদিকে ছড়িয়ে দেবেন সম্প্রীতির বার্তা, গেয়ে উঠবেন “হৃদ মাজারে রাখবো ছেড়ে দেব না

বক্ষ মাঝে রাখবো ছেড়ে দেব না”।

Comments are closed.