Also read in

Here is a special writeup from Papri Bhattacharjee on the occassion of Women's Day

সিলেটিতে একটা শব্দ ছোট বেলায় খুব শুনতাম, ‘কল্লা’। এক বাংলা দেশি দাদু পাশের বাড়ি আসতেন বছরে দু তিনবার। দাদুমণি বলে ডাকতাম, তার মুখেই শোনা।শব্দের মানে বোধহয় ‘আলজিব’ । আর বুৎপত্তি দেশি, বিদেশি বা অন্য কোনো শব্দের অপভ্রংশ কিনা জানা নেই আমার। এই সাথে ‘দরাজ’নামক সুন্দর ফার্সি প্রিফিক্স যুক্ত হয়ে তৈরি করতেন দারুন আর একখানি নতুন শব্দ…. কল্লাদরাজ। যার কল্লার মানে বাকযন্ত্রের গঠন দরাজ হাতে হয়েছে। এই বিশেষনের সাথে ‘ মাইয়া’ বিশেষ্য যোগ করে সেই দাদু আমায় একগাদা কথা বলিয়ে, ঝগড়া করিয়ে তারপর বলতেন… “কল্লাদরাজমাইয়া”!! এই শব্দগুচ্ছের সাথে অসম্ভব সুন্দর ছন্দোমিলে আর একটি শব্দ শুনেছি চাকরি জীবনের প্রথমে … “জল্লাপল্লা”। এর বুৎপত্তি এবং সঠিক অর্থ আমার অজানা। আন্দাজে অর্থ যা দাঁড় করাই তা বোধহয় ‘উত্তেজনার’ সমতুল্য কিছু। কোনো ‘কল্লাদরাজ’ যখন ‘জল্লাপল্লা’ হয়ে শুকনো লংকার ঝাঁজের বাক্যবাণ ছড়াবে তার স্বাদ ছাড়া আর কিছুর মত আমি ভাবতে পারি না। শব্দগুলো নারীবাদের পর্যায়ভুক্ত নয় মোটেও, অর্থাৎ নারী কে ‘বাদ’ দিয়ে নয়। পুরোটাই স্ত্রীয়াশ্চরিত্রমের পাকাপোক্ত দলিল। অর্ধেক নয়, একেবারে পুরো আকাশের অধিকার। বরং পুরুষই ‘বাদ’ বলা যায়। নাক গলাবে পুরুষরা এমন ফাঁক টুকুও নেই।তারা তো পুরুষ শার্দুল, বৃষস্কন্ধ, পরুষ ঋষভ, পুরুষ সিংহ, বীরপুঙ্গব, যশস্বী, তার্কিক ইত্যাদি ইত্যাদি। আর একটু অসন্তুষ্টির উষ্মা প্রকাশ করার ইচ্ছে হলে ইষৎ বাঁকা করে তর্কবাগীশ, কুতার্কিক। ব্যাস। কিছু শব্দ আলগা করাই আছে যেন, যেগুলোর পুংলিঙ্গ হয় না ঠিক, মানে তেলে জলে মেশে না। যেমন ‘ মুখরা’ । মুখেন মারিতং পুরুষ হয়, কিন্তু মুখরা? নেভার। পুরুষ ইগোয় আঘাত হানার মত ব্যাপার হয়ে যাবে! ‘মুখরা বধূরা আমারে সর্বদা জ্বালায়’। কুলীনদের এই দু:খ 

যুগের সাথে এদিক সেদিক হেলদোল হয়েছে শুধু, ফ্যাশনের মত। তাই মাইয়্যা মানুষের ‘চোপা’ হওয়াটা যেমন ন্যায় সম্মত নয়, তেমনি কাংস্যবিনিন্দিত স্বর যন্ত্রের অধিকারী হতে খুব কম পুরুষকেই শোনা যায় । তাই পুরুষরা চির সুন্দর বলিয়ে ! তারা বাগ্মী,তারা বাচষ্পতি। এমনই যুৎসই বাগবিধির প্রয়োগ তাদের যে হাতাহাতি থেকে যুদ্ধ, ধ্বংস, বাটোয়ারা, লুট, শহর, গ্রাম, সভ্যতা, পুঁথিঘর নিকেশ করে আনবিক বোমার ধুম ফটাস পর্যন্ত গড়িয়ে তবেও ‘আলোচনা ‘ আর শেষ হয় না। প্রজন্ম বয়ে যায় ক্ষত ঢাকতে । তবুও দেখো ‘চোপা,’’ কল্লা’, ‘চুলোচুলি’ , ‘এর কথা তাকে লাগানো’ সব স্ত্রী লিঙ্গ শব্দ!! পুরুষেরা মুখর হন, মুখরিত করেন, ….”এপারে মুখর হল কেকা ওই”। আর ওপারে? বেশি ‘মুখ’ করলে জিভটাই কাটা পড়ে যায়, ইতিহাস সাক্ষী । …”আমি কান পেতে রই ” আজও আদর্শ অধিকাংশের কাছেই।

কোনো কারণে এই গলায় যদি সেঁধিয়ে যায় এমন কিছু দুষ্টু চালিয়াত মানে ফেরিংজাইটিজের ভাইরাস এবং কয়েকদিনের জন্য চোপার ভ্যলিয়ুম কমিয়ে দেয়, তখন? তখন ‘এমন হলে কেমন হয়’ একটা সত্যিকারের গল্প শোনাই। আগের গুলো আসলে ধান ভানতে শিবের গীত ছিল। যদিও একমাত্র শিবকেই তো পাই ফেয়ার এন্ড ল্যাভলির অ্যাড এর মত equal equal মনোভাবের বেশ খানিকটা । এই ঠাকুর তার বৌ বাচ্চা বাহন, ভক্ত, সাংগ পাংগ, জনগণ, শত্রু সবাইকে বেশ স্পেস দেন। অযথা দেবতা বলে, গার্জিয়ান বলে সবার উপরে বসে ছড়ি ঘোরানোর বাতিকটা নেই। বৌ মরলে দু:খ হলে সেটা দেখাতে লজ্জা টজ্জাও পান না একদমই। তার ক্ষেত্রে গাঁজার নেশা বোধহয় পেট্রিয়ার্ক হওয়ার নেশার থেকে চড়া। এই দেবতা বেশ নর্মাল। অন্তত বৌকে দিয়ে সৃষ্টির শুরু থেকে পদসেবা তো করাচ্ছেন না।

গুনোৎসব জ্বর আর গলা ব্যথায় গেলো। তারপরই
পঞ্চয়েত নির্বাচনের গণনার দায়িত্ব পেলাম। গলা প্রায় বন্ধ। সকালে যাই, ফিরতে প্রায় ১১ টা রাত। আদাজল( গরমজল) খেয়ে লেগে পড়েছি একেবারে।
দিন থেকে কখন রাত হয় বুঝতেও পারি না। চারিদিক সরগরম। খাঁচার ভেতর আমি আর খাঁচার বাইরে তারা যাদের ফল বেরোবে। কথা বলতে পারি না বেশি তাই সংকেতে আর দুজন সহকর্মীর সাহায্যে কাজ এগিয়ে চলে তরতর। খাঁচার বাইরের মানুষজন সবাই গ্রামের বা চা বাগানের। আমাদের ভাষায় ‘গাউয়া’ , ‘বাগানি’। মাঝে মাঝে তাড়াহুড়োতে আমার গুনতে ভুল হলে তাদের মধ্যে কেউ খুব আন্তরিক ভাবে বলেন, ‘দিদি আর একবার প্লিজ। জানি কষ্ট হচ্ছে’। বা কোনো বাগানের ছেলে বলল, “মিস, মনে হয় দুইটা বেশি গোনা হল।” চা বাগানের ছেলেগুলো খুব মিষ্টি করে ‘সিস্টার ‘ ডাকে। আমাদের রুমের ইনচার্জ যে এডিসি তিনিও মহিলা। মহিলা প্রার্থীরা, পরুষদের সাথে সমান তালে দাঁড়াচ্ছেন, কথা বলছেন, দেখছেন, বুঝছেন। বাক্সের পর বাক্স বদল হয়, খাঁচার বাইরের মানুষরাও। যারা জেতেন তারা খুশি, যারা হারেন তারাও ‘আসি ম্যাডাম ‘ বলেই তবে যান। কম বেশি নরম গরম কথা, টয়লেটের অসুবিধা এসব যে ছিল না এমন নয়। তবু দিনের শেষে খাঁচা, তার ভেতর বাইর, সেদিনের পরিবেশ, সেই সময়খন্ড আমার বড় স্বাভাবিক লাগছিল। equal equal অনুভূতি।

দ্বিতীয় দিন, তখন প্রায় রাত ন’টা। ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসছি। এই উপমহাদেশীয় পুরুষদের যত্র তত্র মূত্র ত্যাগের সুবিধায় চত্তর একে বারে ম’ম। সাথে দেশি মদের গন্ধের ককটেল, শীতের ধোঁয়াসা, ঘোলাটে হ্যালোজেন, পুলিশ, আর শয়ে শয়ে মানুষ। আমাদের বাস এল, ভিড় ঠেলে পুলিশের সাহায্য নিয়ে কোনোমতে চড়লাম। চালক ছাড়া পুরো বাস রমণীরত্নে ঠাসা। ভিড় ঠেলে, অবিরাম হর্ণ বাজিয়ে মোটামুটি যখন চলতে শুরু করেছে চতুষ্পদ, অমনি জনতা একটা হর্ষধ্বনি দিল। এরা দেয়, যত বার বাস যায় আসে। শীতের রাতকে একটু উষ্ণ করে এই ধ্বনি। ঠিক তখন ই একটা লোক বাসের পিঠ চাপড়ে বলে উঠল বাগান শ্রমিকের উচ্চারনে…

” যাও যাও। সারাদিন দেশ চালায়েছ। এখন যায়ে সংসার চালাও।”

খুব হাসলাম সবাই। মানুষটাকে দেখা গেলো না ধুসর রাতে, শুধু কালো জ্যাকেটের অংশ আর একটা থ্যাবড়ানো পরিশ্রমী হাতের তেলো দেখলাম এক ঝলক। বাস চলছে হেচকি খেয়ে খেয়ে, প্রচন্ড যানজট। গলা নেই, পাশের জনের সাথে কথা বলতে পারি না। তাই নিজের সাথেই সই। বড় কানে বাজছিল কথাটা। দেশ আর সংসার চালাবার ক্ষমতা রাখি আমরা সমানতালে ? একজন প্রায় নিরক্ষর লোক এই ক্লান্ত রাতে শিলমোহর দিল এমন শংসাপত্রে। তাবড় তাবড়দেরও তো কষ্ট হয় এমন বলতে। বিশ্বাস করা তো দূর অস্ত। আর বললেও ‘কিন্তু’ ”পরন্তু” ছাড়া নয়। ভাবলাম কিসের ট্যাগ লাইনের সাথে খাপে খাপে মিল হতে পারে এই চাষাড়ে বানীর? “বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও ” ? নাকি অনেক আগে বাজাজ স্কুটারের অ্যাডে যে বলত… “বুলন্দ ভারত কি বুলন্দ তসবির’? অথবা ” ফুল বনে অংগারে” ? হাসি পেল এবার। পুরো বাবার মেয়ে হয়েছি। সুযোগ পেলেই মেলোড্রামা চালু। রাস্তার দুপাশে প্রায় মেলা বসেছে। প্রচুর অস্থায়ী খাবার দোকানে চা ঘুগনী, রুটি, ভাত, আমিষ নিরামিষ বিক্রি হচ্ছে প্রচুর । লোকের অভাব নেই। সব দোকানে প্রচুর কাগজের মালা ঝুলিয়ে রাখা। জয়ীদের পরানো হচ্ছে সকাল থেকেই। কি চমৎকার রং সেগুলোর, লাল, গোলাপি, সাদা, রং বাহারি। শনি ঠাকুর রংয়েরও আছে দেখলাম। এমন নীলেরও কাস্টমার আছে তবে! কিন্তু আমায় তো ‘দেশ’ আর ‘সংসার’ পেয়ে বসেছে। প্লেব্যাক করা মন ক্লাশ নাইনের রবিবারের এক দুপুরে গিয়ে থামল। প্রাদেশিক সিনেমা দিত দূরদর্শনে। তার আগে ‘ মুকবধির সমাচার ‘। অনেকগুলো সংকেত বেশ রপ্ত করেছিলাম। সিনেমা শুরুর আগে গল্পটা বলা হত। ‘আইয়াপ্পার ওউর থাংকুমণি এক হি গাও মে রেহেতে হ্যায় ‘ বলে কিছু নাম ঠিকানা আর একটা প্যাঁচানো গল্প বলে শেষে আবার সাসপেন্স ধরে রেখে বলা হত ‘ অব আগে দেখিয়ে ক্যায়া হোতা হ্যায়’। নব্বই শতাংশ ছবি এক কথায় বোরিং লাগত। অন্ধকার, দারিদ্র, কষ্ট, হাড় জিরজিরে বাচ্চা, কঠিন সাবটাইটেল সব মিলিয়ে ঠিক সুবিধা করতে পারতাম না ব্যাপার টা। তবু বসে থাকতাম, পড়া ভাগা যায় যে। বাবা লোক টা বড় জ্বালাতেন। অতিনাটকীয় ভংগিমায় শেক্সপিয়ার নকল করে বলতেন, “Tell me daughter Juliet, have you decided to waste your precious time in all these nonsense? তারপর প্রায় ধরপাকড়ের পর্যায়ে গিয়ে আমাকে নিয়ে বসবেন। তখন যদি আজকের এই দেহাতি উক্তি ভাবসম্প্রসারণ হিসেবে কোনো এক টেস্ট পেপারে থাকত? শুরুতেই বাবা বলতেন, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র ছাড়া হবে না। তাদের বিখ্যাত লাইন ঢোকাতে হবে। “আমি নারী আমি মহিয়সী আমার সুরে সুর বেঁধেছে জ্যোৎস্না বীণার নিদ্রা বিহীন শশী। ” এই লাইন পেয়ে বাবা খুব খুশি। “তবে শুধু আলতো শব্দ নয়। শক্ত কিছু চাই। লিখ, নারীর শুধু নারী হয়ে থাকলে হবে না, বীর্যে পুরুষ হতে হবে। তবেই ঘরে বাইরে সমান ভাবে তাল মিলবে।” আমি তখন বলব,” কেনো? রূপে নারী, বীর্যেও নারী হলে কি অসুবিধা?” বাবার প্রশ্রয় আর প্রশংসার হাসি তখন উপহার। এইবার তিনি ফর্মে আসবেন পুরো। বলবেন, “পোর্শিয়া আমার প্রিয় চরিত্র। মাইকেলের প্রমিলা ও। পোর্শিয়ার, I am Cato’s daughter, Brutus wife, অথবা প্রমিলার সেই বিখ্যাত উক্তি রাবন শ্বশুর মম মেঘনাদ স্বামী, আমি কি ডরাই সখী ভিখারি রাঘবে? এসব তারা বলেছেন ঠিকই কিন্তু নিজেদের পরিচয় তারা আলাদা করে গড়েছেন। এখানেই স্বার্থকতা। শুধু ভ্যানেটি ব্যাগ নিয়ে চাকরি করলেই নারী স্বাধীন হয় না। স্বাধীনতার অনুভব অন্তরে না হলে সব পুস্তকে স্থাপিত বিদ্যার মত। ”
আমার আর তর সয় না। আমি বলব, “আর কত লিখব? শেষ করি? ” বাবা বলবেন, ” শেষ লাইন টা রবীন্দ্রনাথ দিয়ে হোক….” যাব না বাসর কক্ষে বাজায়ে কিংকিণী অথবা নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেনো নাহি দিবে অধিকার, হে বিধাতা? ” এই ভাবে দুই পাতা শেষ হতে হতে দুপুরটা আমার হাতছাড়া। এইবার বাবা যদি “সঞ্চয়িতা ” হাতে নেন, তবে আমি বুঝব আমার ছুটি কারণ এবার তিনি নিজেকে নিজেই পড়াবেন। কখনো ভাবালু, কখনো উত্তেজিত তিনি একটার পর একটা পড়ে চলবেন সাথে উচ্চস্বরে এক্সপার্ট কমেন্টের বর্ষা চলবে। যেমন, মঞ্জুলিকার দু:খ এবং তার বাবার স্বার্থপর মনোভাব রবিঠাকুর থেকে পড়ে চিরদিনের ব্রাহ্মন্যবাদ, গুরুবাদ সমালোচক আমার বাবা নিজের ইমোশন ধরে রাখতে না পেরে চিৎকার করবেন, ” হাল্লার হালা বাবন ( ব্রাহ্মণ) হকল! হাল্লার হালা কুলীন বেটাইন ( পুরুষ) !” এবার তাক থেকে নামাবেন নীরদ চৌধুরী, বুদ্ধদেব বসু, আরো অনেকেই। এই নাটক পর্ব চলা কালীন আমি ভোঁকাট্টা। উঠোন থেকে শুনতে পাব চলছে বাবার পড়া. ..”পূণ্য জাহ্নবীর তীরে সন্ধ্যাসবিতার বন্দনায় আছি রত। কর্ণ নাম যার।”….
ডাক বাংলো এসে গেছে। এবার নামতে হবে। জীবন সাথী শকট নিয়ে খাঁড়া । বাড়ি এলাম এবং দেখলাম দুই কন্যার সহযোগিতায় তাদের বাবা রেঁধে রেখেছেন গরম ভাত, আলুভাজা আর লম্বা ঝোল, রুই মাছের।
একই দিনে আরো একবার আমার সব নর্মাল লাগল । তূলাদন্ডের দুটো দিক সমান সমান। আবারও ফেয়ার অ্যান্ড ল্যাভলীর হাসি মাখা মিষ্টি মেয়ের চাহিদা পূরন… equal equal.

ছড়িয়ে পড়েছি। গুছিয়ে নিয়ে নিজেকে শেষ করি এবার। তার আগে আমার ধন্যবাদ দেবার ছিল, কিছু চাইবার আর দু তিনটে প্রশ্ন করারও। শিশুকালে শিশু শব্দের যে লিঙ্গ ভেদ নেই বোঝার বয়স হবার আগে থেকেই প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ কথা ও কাজে , জল্পনা কল্পনায় জানা হয়ে গিয়েছিল আমি দাদার চেয়ে বেশি আদর পেলেও, দাদারা যা পায় আমি পেতে পারি না। সময়ে বুঝেছি সেগুলো চাইতেও নেই। নির্ভয়া, কামদুনি, তিনমাস থেকে সাতাত্তর মেয়ে হবার মূল্য চোকাতে দেখেছি। নেহা বাগতিদের জাস্ট গুম হতে দেখেছি। প্লাস্টিকে জড়ানো অগুনতি অপরিনত কণ্যাভ্রূণের ট্রিট পেয়ে উল্লসিত কুকুরদের টানাটানি দেখেছি টিভির পর্দায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে মেয়ে সন্তান হওয়ায় মুষড়ে পড়তে দেখেছি। পরপর দুটো মেয়ে হওয়ার অপরাধে স্বামীর তার স্ত্রীকে তালাক দিতে দেখেছি। “বাঁজা হবার চেয়ে মেয়ে জন্ম দেওয়াও ভালো” এমনও শুনেছি। পড়ায় ভালো মেয়েকে বসিয়ে রেখে আকাঠ মুর্খ ছেলেকে জোরে শহরে পাঠিয়ে পড়াতে দেখেছি। কারণ বাঁকা হলেও আংটি তো সোনার। ছেলে না হবার দু:খ পোষাতে মেয়েকে শার্ট প্যান্ট পড়িয়ে চুল ছাটিয়ে পরম উৎসাহে ছেলে বানিয়ে বেচারির শৈশবে অনধিকার প্রবেশ করতে দেখেছি। বংশ রক্ষা যে মেয়েরাও করে কারণ তাদের শরীরেও বাবা মায়ের সমান সমান জিন, পণ্ডিত সমঝদারকেও বোঝাতে অক্ষম হয়েছি। দশভুজার অঞ্জলি প্রদানে ‘ভার্যাং মনোরমাং দেহি,’ ‘পুত্রং দেহি,’ ইত্যাদি মন্ত্রের মেয়েদের বলার কি যুক্তি থাকতে পারে এই নিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করব না বললে পুরুষ পুরোহিতের কোনো বিরোধ না থাকলেও শিক্ষিতা গৃহিণী বেজায় চটেছেন। দুই মেয়ে হবার পর আত্মীয়দের উপযাচক হয়ে আংগুর ফল টকের গল্প হামেসা শুনতে হয়েছে। ” আজকাল মেয়েরাই ভালো। মা বাবাকে দেখে।” যেন সন্তান উৎপাদন marginal utility থিওরিকে সার্থক করতেই। ছেলেদের “ফিক্সড ডিপোজিট” আর মেয়েদের “ডিমান্ড ড্রাফট ” কত সাদা টাইএর চাকুরেদের বলতে শুনলাম। ” দুই মেয়ে? ছেলে নেই?” শুনে শুনে ক্লান্ত হয়েছি। দুটো লাইক কমেন্ট বদন পুস্তকে বেশি পেলে ঠোঁট টিপে “মহিলারা একটু বেশিই পায়” কত কত বার ঘুরিয়ে শুনতে হয়েছে । রাত ১২ টার পর অনলাইন থাকলে কত গার্জিয়ান স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে জানতে চান, “কি কর এতো রাতে?” যেন তিনি বা তারা যে এই দুপুর রাতে পূন্যশ্লোক হনুমান চালিশা পাঠ করছেন তাতে আমার “অনলাইন ” মস্ত বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জন্ম থেকে মৃত্যু মেয়েদের সকল ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুষ্ঠান, ক্রিয়াকাণ্ড, মন্ত্র তন্ত্র যা তাদের জন্য অন্য কেউ করবে তাতে কাটছাট দেখি শাস্ত্র সম্মত ভাবেই। আর তাদের করার নিয়ম নীতিগুলো ষোলো আনার জায়গায় আঠারো আনা। মজাটা হল এত সব দেখেশুনেও ক্ষেপে যাইনা, সেই দম নেই। বরং যা আশৈশব ঘৃনা করেছি সেই বেড়ি গুলো মেয়েদের পড়াই, কখনো বাধ্য হয়ে, কখনো সংস্কার বশত। সদা আতংকিত, সদা সাবধান থাকি। ক্লাশ ফোরের মেয়েকে প্রাণান্ত হয়ে good touch, bad touch এর ব্যবধান বোঝাতে গেলে সে যখন নিষ্পাপ চোখে হাবার মত তাকায় নিজেই নিজের কাছে ছোট হই। ‘After all মেয়ে তো ‘ এই জাতীয় লাইন অনায়াসে বলি আজকাল। ভিতরে কার মাথাটা বড় হেট হয় নি:শব্দে, টের পাই।

তবে আরোও একটা পিঠও দেখেছি ছবির। হাসপাতালে শুয়ে আছি, খুড়শ্বশুর এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “বেশ করেছিস! তুই আমার সবচেয়ে বুদ্ধিমতী মেয়ে। আমার মা কি বলতেন জানিস? যে বেটি সেয়ানা, ঝি বিয়ায় আগুয়ানা।” স্তোক ছিল না, সান্ত্বনা পুরস্কারও নয়। ভালোবাসা অনুভব করা যায়। সেই আর্মি লোকটা যে আমার ছোট্ট মেয়েকে অযাচিত ভাবে আপেল দিতে গেলে আমি প্রথাগত আর্মি ভীতিতে কিছুটা আড়ষ্ট হলে সে বলেছিল, “ঘাবড়াইয়ে মত। ইতনে ভি বুরে নেহি হ্যায় হম। মেরা বাচ্চা আপকি বেটি জিতনা হ্যায়। সাল ভর সে দেখা নেহি ।” ছাত্রীদের এবং অবশ্যই ছাত্রদেরও দরকারে দৃঢ় হতে, স্পষ্ট ‘না’ উচ্চারণ করতে শুনেছি। বাবার সাথের খুনসুটির গল্প যখন বরাত জোরে হঠাৎ পাওয়া দাদাকে বাখান দিচ্ছি, তিনি বলেছেন, ” শুধু বাবা! মায়ের কথা বলতে নেই ? হ্যা, তাদের তো আবার thank less job। সংসার, সমাজ, দেশ কারুর GDP তে সেগুলো যোগ হয় না।” মা, বাবা, জীবনসঙ্গী, পিসু পিসি, দাদা, বৌঠান, আমার ছাত্র ছাত্রী, শিক্ষক শিক্ষিকা, আত্মীয় অনাত্মীয়, চেনা অচেনা, কুড়িয়ে পাওয়া, ভাগ্যজোরে পাওয়া, যারা স্থানে অস্থানে, কালে ভদ্রে বা প্রতিনিয়ত বুঝে না বুঝে বলেছেন, সাহস দিয়েছেন, সম্মান করেছেন, ভালোবেসেছেন মানুষ বলে আবার মেয়েমানুষ বলেও —সকলকে আজকের দিনে আমার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা।
পাপ করলে মেয়েজন্ম হয়, আর মেয়েরা মিষ্টি মুখের বিষের কলস, নখী শৃঙ্গির পরের মারাত্মক জীব, ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্য্যা’, ‘ক্ষেত্র যার পুত্র তার’, গর্ভে সন্তান ধারনেই নারী জীবনের একমাত্র পূর্ণতা এসব যে মিথ্যে ,যারা তৈরি করেছেন তাদের কাপুরুষতা, নপুংসতার ধারাবিবরণী এই মানুষগুলোর জন্যই এমন সব সত্যের কাছাকাছি যেতে পেরেছি আমি। লক্ষ্মী, ষষ্ঠী এমন আরো দেবীদের পাঁচালি যে আসলে এক দেবী নারীর সামনে আর এক নারীকে বসিয়ে সুর ধরে বই পড়িয়ে পুরো মেয়ে জাতকে অপমান করার ফন্দি সেই বুদ্ধির বোধ হবার সাহস আমার এদের জন্যই হয়েছে।

আর আজকের দিনে সেই গণনার রাতের অপরিচিত অনামী পরুষ যিনি সমস্ত নারীজাতিকে প্রভূত সম্মানিত করেছিলেন তাঁকে আমার আজীবনের আমর্ম শ্রদ্ধা। যেখানেই আছেন তিনি ভালো থাকুন।

এবার চাইবার পালা। দিবস গেলে ব্যথার প্রদীপ জ্বলবে জেনেও আবার নারী হতে চাইব। জীবনের ওপারে জীবন থাকে যদি তবে আবার, প্রতিবার, বারবার মানবী হতে চাই, সকল দোষ ত্রুটি, গুণ, মান অপমান নিয়ে… পরিপূর্ণা।

এবারে প্রশ্ন।
আজকের দিনটা যেমন কেবল মাত্র নারীদের , বৎসরের আরো একটা দিন পুরুষদের জন্য ও আলাদা আছে জানি। ৩৬৫ দিন থেকে দুটোদিন বাদ দিলে থাকল ৩৬৩ দিন। বাকীথাকা দিন গুলো কাদের তবে? নাকি প্রাকৃতিক ভাবে দিনগুলো দু-পক্ষের ই সমান সমান? ব্যাপারটা কি সেই নর্মাল শিবঠাকুরটির মত যিনি আধাআধি পুরুষ নারীতে ভাগ হয়ে আছেন, আবার সবটা একসাথে হয়ে প্রকৃতি পুরুষের সীমানা পেরিয়ে ফুটে ওঠেন একটি পরিপূর্ণ বিমূর্ত স্বত্বায় যা সত্য শিব এবং সুন্দর যেখানে লিংগ ব্রহ্মান্ডের কেন্দ্রীভূত প্রতীক, পুরুষাংগের নয় …………?

Equal equal হবার লড়াইটা এবং equal equal কোনোভাবেই মেনে না নেওয়ার প্রবণতাটা কি তবে প্রাকৃতিক প্যারাডক্স? ধন্দ মূলক সমাজবাদ ?

Comments are closed.