Here is the second part of the exclusive interaction with Subha Prasad Nandi Majumdar
পৃথিবীর সমস্ত কাঁটাতার উঠে যাক, এটাই আমার স্বপ্ন: শুভপ্রসাদ
এই সাক্ষাৎকারের আগের অংশটা পড়তে হলে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন
কিছু মানুষের ক্ষেত্রে ভূমিকার প্রয়োজন গৌন হয়ে যায়, যখন তার নামই ভূমিকার দায়িত্ব পালন করে। সেরকমই একজন শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার। বরাক উপত্যকার সংগীত জগতেতো বটেই বৃহত্তর বাংলায়ও এক সুপরিচিত নাম। সংগীত ও শিলচর অন্তপ্রাণ, অমায়িক হাসির অধিকারী শুভপ্রসাদ এর সঙ্গে আলাপচারিতায় একদিকে যেমন সংগীত নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন ছিল, তেমনি তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ, রাজনৈতিক স্বপ্নের কথা জানতে পারলাম, জানতে পারলাম শিলচরের প্রতি তার অপরিসীম টানের কথা। একইভাবে আলাপচারিতায় স্থান পেল এনআরসির বিভিন্ন দিক, শুনতে পেলাম কালিকার না জানা কিছুকথা। সবমিলিয়ে কথায় কথায় সময় গড়িয়ে গেল অনেকটা।এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটির শেষাংশ আজ দেওয়া হল।
সঙ্গীতের পাশাপাশি ছাত্রনেতা হিসেবে একসময় খুব জনপ্রিয় ছিলে। তখন অনেকেই ছাত্র আন্দোলনকে পরবর্তীকালের সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের প্রস্তুতিপর্ব বলে ভেবেছে। কিন্তু পরবর্তীতে রাজনীতিতে তোমাকে তেমন করে পাওয়া যায়নি কেন?
রাজনীতি বলতে যদি দলীয় রাজনীতি বোঝায়, মানে ইলেকশনে দাঁড়ানো বোঝায় , তাহলে সে ধরনের রাজনীতি আমি করি না। অন্যথায় আমি প্রতিনিয়ত, সর্বক্ষণ রাজনীতির মধ্যেই আছি। আমার মননে, আমার গানে সর্বক্ষণ রাজনীতির ছায়া রয়েছে। রাজনীতি কথাটাকে আমি অনেক গভীরতর এবং ব্যাপকতর হিসেবে বিবেচনা করি। এই যে আমি জীবনকে কিভাবে দেখি, সেটাও আমার রাজনীতির শিক্ষা।এমনকি আমি নির্বাচনের প্রচারেও থাকি।আমার একটা মতাদর্শ আছে।
এমএলএ হওয়া কিংবা এমপি হওয়ার জন্য যে রাজনীতি, সে তো খুব সংকীর্ণ রাজনীতি। রাজনীতি মানুষের মতাদর্শ হতে পারে, কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষা হতে পারে না। রাজনীতি উচ্চাকাঙ্ক্ষা হতে পারে ওদের কাছেই, যারা একে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে। আমার রাজনৈতিক স্বপ্ন রয়েছে, কিন্তু কোনও রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। আর আমার রাজনৈতিক স্বপ্নটা হচ্ছে, পৃথিবীটা বদলে যাক। পৃথিবীর সমস্ত কাঁটাতার উঠে যাক। যার দু’বেলা অন্ন জোটে না তার মুখেও যেন হাসি ফুটে। এই যে হিন্দু, মুসলমান, বাঙালি, অসমিয়া এগুলো সব উঠে যাবে। বৈচিত্র্য থাকবে কিন্তু বিভেদ থাকবে না।
বর্তমানে অসমের বাঙালিদের একটা জ্বলন্ত সমস্যা হচ্ছে এনআরসি। সরকার আদালতের দোহাই দিয়ে বসে আছে আর প্রতীক হাজেলার মাধ্যমে নতুন নতুন শর্ত আরোপ করছে। এই অবস্থায় কোনও গণআন্দোলন গড়ে উঠছে না। সবটাই যেন ব্যক্তিগত পর্যায়ের লড়াই। এ থেকে উত্তরণের পথ কি হতে পারে?
আসামে বারে বারে আইন বদলানো হয়েছে, তা শুধুমাত্র একটা নির্দিষ্ট ভাষাগোষ্ঠীকে মাথায় রেখে, ওই ভাষাগোষ্ঠীকে কিভাবে সমাজে খাটো করা যায় কিংবা নিয়ন্ত্রিত করা যায়। এটা তো এক ধরনের অবমাননা। কিন্তু তার পরেও যে আইন রয়েছে, সংবিধান রয়েছে তার মাধ্যমেও এনআরসি পরিপূর্ণভাবে তৈরি করা হচ্ছে না। নানা ধরনের রাজনৈতিক চাপ রয়েছে। প্রতীক হাজেলা তো একজন সরকারি আধিকারিক মাত্র। তার কি ক্ষমতা রয়েছে যদি তার পেছনে রাজনৈতিক মদত না থাকে? আমাদের দেশে যে আইন রয়েছে, বলা যায় ১৯৫৫ সালে আইন সংশোধন করার পরও যা আছে তা যদি মেনে চলি, তাহলে তাতেও ভারতের কারোর নাম বাদ যাওয়া উচিত নয়।
আর অনুপ্রবেশ শব্দটাই একটা রাজনৈতিক কথা।
তুমি বলতে চাও, ভারতে অনুপ্রবেশ ঘটছে না?
আমাকে তুমি বল,পৃথিবীর কোন্ দেশ থেকে আর এক দেশে যায় না লোক? আরব থেকে ইউরোপ এ মানুষ যায়, আফ্রিকা থেকে মানুষ আমেরিকায় যায়। তাই কোন জায়গা থেকে মানুষ যায় না? নেপাল থেকে কি মানুষ আসছে না? মানব সভ্যতায় আদিকাল থেকেই মানুষ এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যায়। এই যাওয়ার মধ্যে একটা অপরাধ যুক্ত করে দেওয়া, এটা কোনও ভাবেই হতে পারে না। যে মানুষগুলো বাংলা থেকে নিরাপত্তার জন্য এদেশে এসছে, সেই মানুষগুলির মানবাধিকারের কথা ভাববো না? যে এদেশে একাত্তর সালে এসেছে, তিন পুরুষ ধরে এখানে থাকছে তার সে সন্তানদের কথা আমরা ভাববো না? প্রতিটি মানুষের মানবাধিকার তো সুনিশ্চিত করতেই হবে। এই লড়াইটা এই মুহূর্তে রাস্তায় চিৎকার দেওয়ার লড়াই নয়। এই মুহূর্তে লড়াইটা অনেক বেশি আইনের লড়াই। যে ৪০ লক্ষ মানুষের নাম বাদ পড়েছে তারা গরিব,অসহায়। তাই এই অসহায় মানুষগুলোকে সর্বোচ্চ আইনি সাহায্য, আর্থিক সাহায্য দেওয়া আমাদের সবচাইতে জরুরি।
এটার জন্য তারা যেন সর্বস্বান্ত হয়ে না যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। আর এটা নিয়ে যে রাজনীতি চলছে সেটার বিরুদ্ধেও সোচ্চার হওয়া দরকার।
সারা দেশের ক্ষেত্রে এনআরসির জন্য একটা আইন, সেখানে ভোটার লিস্টে যাদের নাম রয়েছে সবার নাম উঠানো হয়েছে, কারোর সম্পর্কে যদি কোনও সন্দেহ থাকে তাহলে সেই মানুষটার বিরুদ্ধে বিচার করা হয়েছে। অথচ আসামে সবাই সন্দেহের আওতায় রয়েছেন। সবাইকে প্রমাণ পত্র জমা দিতে হবে।
দশটা ভারতীয়ের নাম সুনিশ্চিত করতে গিয়ে যদি দু একটা বিদেশি নামও ঢুকে, তাতেও কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। কিন্তু প্রত্যেকটি বিদেশিকে তাড়ানোর জন্য যদি এক লক্ষ ভারতীয়ের নাম বাদ যায়, তবে সেটা মানা যায় না। কারণ যার নাম বাদ পড়বে, সে কোথায় যাবে তার সন্তান বউ বাচ্চাদের নিয়ে?
আইনের প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে একটাও নিরপরাধ
যেন দণ্ডিত না হয়। এ জন্য একটা অপরাধীকেও ছাড়া যেতে পারে।
বাংলাদেশ থেকে সব চাইতে বেশি অনুপ্রবেশকারী আসামে ঢুকেছে বলে বলা হচ্ছে। এটাতে তুমি কি বলবে?
তাই যদি হয় তাহলে আমাদের পুলিশ কী করছে? বিএসএফ কি করছে? সরকার কি করছে?
এই যে ৪০ লক্ষ মানুষ বাদ পড়েছে, একই বাড়ির ভাইয়ের নাম আছে বোনের নাম নেই। তাহলে কি ধরে নেব ভাই ভারতীয়, আর বোন ভারতীয় নয়? এটা তো সম্ভব না।
আমাদের আসামের দুটো সমস্যা রয়েছে। একটা হচ্ছে হিন্দু- মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা এবং অন্যটি অসমিয়া-বাঙালির মধ্যে। কেউ ভাবছে হিন্দু মুসলমানকে উস্কানি দিয়ে অসমিয়া বাঙালি ব্যাপারটা চাপা দিতে পারবে। আবার কেউ ভাবছে অসমীয়া বাঙালিকে উস্কানি দিয়ে অন্যটা চাপা দিতে পারবে।এটা আসলে হয় না। আরেকটা কথা আমি এখানে বলতে চাই, বাঙালির মধ্যে অর্থাৎ হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যে সামাজিক দূরত্ব রয়েছে, সে দূরত্বটা যদি না থাকতো বাঙালি হিসাবে আসামে আমাদের এ দুরবস্থা হত না।
তোমার কর্ম ক্ষেত্রে একটা দুঃখজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ঘটনাটা আমরা অনেকেই জানি। এখানে আমি জানতে চাইছি,ওই পরিস্থিতিতে রুখে দাঁড়াবার এত শক্তি কোথায় পেয়েছিলে ? আর ওই ঘটনার পজিটিভ এবং নেগেটিভ প্রভাব কি হয়েছিল বলে তোমার মনে হয়?
এই ঘটনাটি ঘটার পর বুঝতে পারলাম, আমি একজন গানেরই, বিশেষ ভাবে রবীন্দ্র সংগীতেরই মানুষ। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি,একটা দেশের মধ্যে এক ফুটপাতবাসীও যেমন একজন নাগরিক তেমনি, কোটিপতিও একজন নাগরিক। সেরকমই গানের জগতে কিংবা রবীন্দ্র সংগীতের জগতে অনেক বড় বড় ব্যক্তিরাও রয়েছেন, যারা আমার তুলনায় কোটিপতি এবং আমি হয়ত নিতান্ত একজন ফুটপাতবাসী। কিন্তু নাগরিকত্বের প্রশ্নে যেমন কোটিপতি এবং ফুটপাতবাসী সমান, আমারও মনে হয়,আমার নাগরিকত্ব অন্য কোথাও নেই শুধু গানের মধ্যে বিশেষভাবে রবীন্দ্রনাথের গানে।
ঘটনাটা আসলে আমাকে কেন্দ্র করে ছিল না।আমার ক্যাম্পাসের একটি পরিবারের ওপর আক্রমণ হয়েছিল, আমি তার প্রতিবাদ করেছিলাম। তারপর সে পরিবার থেকে ঘুরে আমার উপরে আক্রমণটা কেন্দ্রীভূত হয়ে গিয়েছিল।
বাড়ি থেকে বেরুনোর পর ওরা যখন গাড়ি থেকে নেমে আমাকে মারতে শুরু করে তখন পাড়ার লোকেদের কোনও ভ্রুক্ষেপ ছিল না। তারা পাশ দিয়ে নির্বিকারে হেঁটে চলে যায়। মার খাওয়ার পর আমার প্রথম অনুভূতিটা ছিল, এটাকেই কি মার বলে? এটার জন্য কি অনেকে আত্মসমর্পণ করে নেয়? এ তো সহ্য করা অসম্ভব নয়। এটার জন্য কেন মানুষ এত ভয় পায়?
এরপর আমার মনে হয়েছিল, পৃথিবীতে যত মানুষ অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে, মার খেয়েছে সেই বিশাল প্রতিবাদী মানুষের মিছিলের শেষে আমিও একটা জায়গা পেলাম।
যখন ওরা আমাকে মারছিল তখন আমার ভেতরের আমি গুনগুনিয়ে উঠল “আমার এই দেহখানি তুলে ধরো, তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো……”। মনে হলো সভ্যতার দেবালয়ে দেহটাকে প্রদীপ করে দিচ্ছি। তারপর যখন আমি অনশনে বসলাম, তখন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে আমার প্রতিক্রিয়া জানতে চায়।আমি বললাম, এই মুহুর্তে আমার রবীন্দ্রনাথের গানের লাইনই মনে হচ্ছে ‘যখন থাকে অচেতনে এ চিত্ত আমার/ আঘাত সে যে পরশ তব সেই তো পুরস্কার’। গোটা ঘটনাটায় আমি বারবার আশ্রয় পেয়েছি, শক্তি পেয়েছি, ভরসা পেয়েছি, আলো দেখেছি রবীন্দ্রনাথের কাছে। ফলে আমি যা করতে পেরেছি তার জন্য আমার রাজনৈতিক মতাদর্শ কিংবা রাজনীতির আশ্রয় থেকে আমার গান, আমার রবীন্দ্রনাথ, আমার রবীন্দ্র সঙ্গীত আমাকে অনেক বেশি ভরসা জুগিয়েছে। কিন্তু এটাও ঠিক, ওই ঘটনাটা না ঘটলে আমি নিজেকে আবিষ্কার করতে পারতাম না।
ঘটনার পর আমি কখনও দাবি করিনি ছেলেগুলোকে পুলিশ ধরুক কিংবা ওদের জেলে ঢোকানো হোক। কারণ তারা জেলে গেলে পুরোপুরি অপরাধী বনে যাবে। সবাই বলেছে আমার দার্শনিক কথা কেউ বুঝবে না।কিন্তু আমি চাইছিলাম যারা আমাকে মেরেছে তারা এসে আমার কাছে ক্ষমা চাক।তাদের কাছ থেকেই জল পান করে আমি অনশন ভাঙতে চেয়েছিলাম।এবং শেষ পর্যন্ত সেটাই ঘটলো। ৩৪ ঘন্টা অনশন করার পর এই ছেলেগুলি ওদের মা-বাবা, পাড়ার মানুষ দোকানদার, সব মিলে কয়েকশো মানুষ আসে ক্ষমা চাইতে। ছেলেগুলি যখন হাসপাতালের ঘরে ঢুকে, তখন দেখলাম যে ছেলে গুলি কয়েক ঘণ্টা আগে চোখে প্রচণ্ড জিঘাংসা নিয়ে আমাকে মেরেছিল, সেই ছেলেগুলির চোখের মধ্যে অদ্ভুত একটা ভালোবাসা। আমাকে এসে যখন ওরা জড়িয়ে ধরে, আমার মনে হয়েছে ১০০০ তানপুরা বেজে উঠেছে, কয়েক লক্ষ সেতার একসঙ্গে বেজে উঠেছে, অসংখ্য পাখি ডেকে উঠেছে।আমার জীবনের এর চেয়ে বড় সুখের মুহূর্ত,আনন্দের মুহূর্ত আর কিছু নেই। ওদের কাছেই আমি প্রথম জল পান করি।
ওই সময় শিলচরের মানুষ, বাংলাদেশের মানুষ, পূর্বাঞ্চলের মানুষ, কলকাতার মানুষ সবার সহমর্মিতা পেয়েছিলাম, আমার প্রতি ওদের ভালোবাসা অনুভব করতে পেরেছিলেম। তাই এটার কোনও নেতিবাচক দিক নেই।এটি আমার একটা গৌরবময় অধ্যায়।
তুমি তো দেশে, বিদেশে অনেক জায়গায় অনুষ্ঠান করেছ।কোথায় অনুষ্ঠান করে সবচেয়ে ভালো লেগেছে এখন পর্যন্ত?
নিশ্চয়ই শিলচর। শিলচরে কোন অনুষ্ঠান ভালো হলে মনটা ভালো হয়ে যায়। আবার শিলচরে যদি একটা অনুষ্ঠান করতে গিয়ে ঠিক মত হয় না, তাহলে সেটা ব্যথা হয়ে মনের মধ্যে থেকেই যায়। কারণ শিলচরই তো আমাকে তৈরি করেছে।
শিলচরকে কতটুকু মিস করো?
আমারতো সারা শরীরে শিলচরের বাতাস, মাটির গন্ধ লেগে রয়েছে।
শিলচরে আমি যে কোনো ছুতো ধরে যেতে পারি এবং বছরে অনেক বার যাইও। তাই মনে হয় অন্তত মৃত্যুটা যেন আমার শিলচরে হয়। যদিও একান্ত ব্যক্তিগত কথা, তবু বলতে ইচ্ছে করছে। আমি আমার মেয়েকে বলেছি, মৃত্যুর পর যেন বরাক নদীর হাওয়া আমার শরীরে লাগে।
কালিকাকেও একই কথা বলেছিলেম। সে আবার রসিকতা করে বলেছিল, কে আগে যায় দেখ!!
এই শরৎকালটা এলে শিলচরের জন্য খুব মন খারাপ হয়।নীল আকাশ, সোনালী রোদ…..এ নিয়ে আমি একটা গানও লিখেছিলাম।
“মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বৃষ্টি হলো শেষ।
কাজের বেড়ি ছিড়ে এলাম, বাড়িতে শেষমেশ।
বাড়ি মানে ছোট্ট শহর, বরাক নদীর গায়
সারা বছর যে নদীটা স্বপ্নে ডাক পাঠায়।
বাড়ি মানেই পথের মোড়ে চেনা মুখের হাসি,
দুঃখে সুখে জানিয়ে দেওয়া তোমায় ভালোবাসি।”
যখন শিলচর ছেড়ে বাধ্য হয়ে কলকাতায় এসেছিলাম, তখন আমার এই শিলচর ছেড়ে যাওয়া নিয়ে পত্রপত্রিকায় অনেকে লিখেছিলেন । সব শেষ করে যখন আসি, তখন বন্ধুদেরকে মোবাইলে মেসেজ করেছিলাম, নদিয়া ছাড়িয়া যাব, পরের মাকে মা বলিব, জানবে লোকে নিমাইর কেহ নাই……। পরে মেয়েকে বলেছিলাম, দেশভাগের পর যখন মা-বাবারা সিলেট ছেড়ে এসেছিলেন, তখন তাদের অনুভূতিটা কি ছিল, এখন বুঝতে পারছি।
শিলচরের কিসের কিসের জন্য মন টানে শুনলে অবাক হবে।একদিন আমি আর প্রসাদ যাদবপুরের সন্তোষপুরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, হঠাৎ প্রসাদকে আমি বললাম, এখানে একটা জিনিস খেয়াল করেছো? এখানে গরুর গোবর নেই। প্রসাদ উত্তর দিল, হ্যাঁ তো এখানে গরু নেই, রাস্তায় গোবর নেই। দুজনে হাসলাম। শিলচরের মত গরু নেই, গোবর নেই বলে আমরা মন খারাপ করছি। শিলচরের জন্য মন কেমন করার অনেক কারণ সামনে এসে যায়। একদিন প্রসাদ কে বললাম, শিলচরে যে এত ‘পেক’ হয় সেটাতো কলকাতায় নেই। কলকাতায় আছে কালো নোংরা। পেক আর নোংরা মোটেই এক নয়। ‘পেক’ মানে জল আর মাটির অনাবিল যে মিশ্রণ সেই কাদার জন্যও মন খারাপ হয়ে যায়। প্রসাদ আমাকে বলতো: শুভদা, কাদা আর গোবরের জন্য আমাদের মন খারাপ হচ্ছে। আমাদের অস্তিত্বে শিলচর কিভাবে জড়িয়ে আছে তাতেই বোঝা যায়।
শিলচর তো প্রায়ই যাও, তোমার কৈশোর-যৌবনের শিলচর আর এখনকার শিলচরের মধ্যে ফারাকটা কি?
শিলচরে মনে হয় খুব ভিড় হয়ে গেছে। ভীষন জ্যাম হয়ে যায়। প্রত্যেক বছর যখন যাই, তারপরে আবার যখন যাই, এই দুই যাওয়ার মধ্যে অনেককে হারিয়ে ফেলি। অনুরূপাদি চলে গেলেন, অনন্ত দেব চলে গেলেন,কৃষ্ণা চলে গেল,একজনের পর একজন চলে যাচ্ছেন। প্রত্যেকবার যাওয়ার পরে দেখি হারিয়ে ফেললাম কাউকে না কাউকে,এটা আমাকে খুব ধাক্কা দেয়।
আরো কিছু পরিবর্তন হয়েছে।কিন্তু তোমার নিজের শরীরে যদি কোথাও কাটা থাকে, তুমি ঢেকে রাখবে অন্যের কাছে। সব পরিবর্তন আমার ভালো লাগছে না, কেমন যেন বদলে যাচ্ছে অনেক কিছু। তবু বলতে ইচ্ছে করছে না, হয়ত শিলচরের প্রতি যে আমার একটা বিশেষ মায়া রয়ে গেছে, সেটার জন্যই।
Comments are closed.