আমার উনিশ আমার একুশ
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু ঝরা
এ ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি।”
আমার উনিশ। আমার একুশ। এ শুধু ক্যালেন্ডারের গায়ে কালো অক্ষরে লেখা দুটি তারিখ নয়। রক্তাক্ষরে লেখা আমাদের বাঙ্গালিদের অভিমান। স্বর্ণাক্ষরে লেখা ইতিহাস। আমার ভায়ের রক্তে রাঙ্গা উনিশ আর একুশ এলেই অনুভূত হয় স্বজন হারানোর ব্যথা। ফেব্রুয়ারি আর মে মাস এলেই শূন্য হয়ে যাওয়া বুকটাতে এক বুক গর্ব এসে পাড়ি জমায়। জানান দিয়ে যায় মাতৃভাষার জন্য দু-দুবার প্রাণ ত্যাগের গর্ব পুরো বিশ্বে বাঙ্গালিদেরই রয়েছে। এমন গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় পৃথিবীতে অনন্য।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাংলাদেশে শুরু হয়েছিল এক রক্তে রাঙ্গা অধ্যায়ের। ঠিক একই ভাবে ১৯৬১ সালের ১৯ মে ১১ জন ভাষা শহীদদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা আসামে সরকারি ভাষার স্বীকৃতি লাভ করে। স্বাভাবিক ভাবেই রক্তস্নাত ১৯ মে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ২১ শে ফেব্রুয়ারির মত আরও একটি গৌরবময় দিন।
বাংলাদেশে বাংলাভাষা মর্যাদা রক্ষার জন্য সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিক, অহিউল্লাহ, আব্দুল আওয়ালসহ আরো অনেকে জীবনদান করেছিলেন। একইভাবে আসামের শিলচরে বাংলাভাষার জন্য যে ১১ জন শহীদ নিজের শেষ রক্তবিন্দু উৎসর্গিত করেছিলেন তাঁরা হলেন কমলা ভট্রাচার্য, সুনীল সরকার, সুকোমল পুরকায়স্থ, কুমুদ দাস, চন্ডীচরণ সূত্রধর, তরণী দেবনাথ, হীতেশ বিশ্বাস, শচীন্দ্র পাল, কানাই নিয়োগী, সত্যেন্দ্রকুমার দেব, বীরেন্দ্র সূত্রধর।
আসলে একুশে ফেব্রুয়ারি আর উনিশে মে একই সুত্রে গাঁথা। দুটি দিনই স্ব স্ব মহিমায় উজ্জ্বল এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হওয়ার যোগ্য।
একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সর্বত্র পালিত। শুধু বাংলাদেশ নয়, এ দিবসটি নিয়ে অহংকার আজ সব মাতৃভাষাপ্রেমীদের। গর্বিত আজ সবাই।জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) ১৯৯৯ সালে এ দিবসের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয়। এর পর থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও দিবসটি পালন করা হচ্ছে। ১৯৫২ সালের এই দিনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে ছাত্র ও যুবসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেমে আসেন রাজপথে।
সেদিন পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিক শহীদ হন।
মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনের দুর্বার গতি সেদিন শংকিত করে তুলেছিল পাকিস্তানি শাসকদের। তাই সেদিন ছাত্র জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালায় এবং আমাদেরই ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গা উঠে একুশে ফেব্রুয়ারি।
এই দিনটির শোকাবহ দিকটিতে আমরা যেমন যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠি তেমনি সালাম জব্বারদের আত্মদানের মধ্যদিয়ে বাংলা ভাষা পেয়েছে অমরতা। এর গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় এ পৃথিবীর বুকে সত্যি অনন্য। তাই বাঙালি হওয়ার গর্বে গর্বিত আমরা একুশ আর উনিশের হাত ধরে।
২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে চিহ্নিত। বাংলাদেশে এদিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সব সরকারি, আধা-সরকারি, বেসরকারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্তশাসিত ভবনগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো একুশের উপর বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। এ ছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলো ব্যাপক কর্মসূচির মাধ্যমে দিনটি পালন করে। তবে শুধু বাংলাদেশেই নয় একুশ জুড়ে উৎসাহ- উদ্দীপনা ভারতবর্ষ তথা সারা বিশ্বের বাঙালিদের মধ্যে দেখা যায়। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়।
আমরা বিশ্বের সব মাতৃভাষাপ্রেমী মানুষ আজ এ দিবসটি নিয়ে গর্বিত, অহংকারে গরিয়ান। ঠিক যেমনভাবে গর্বিত উনিশে মে নিয়ে। দুটোতেই স্বজন হারানোর ব্যথা খুব তীব্র। এখানে কয়েকটা প্রশ্ন এসেই যায়, উনিশে মে কি ২১ শে ফেব্রুয়ারির মত তার উপযুক্ত মর্যাদাটুকু পেয়েছে? আমরা কি কমলা, সুনীলদের ঋণ পরিশোধের ( যা মূলত সম্ভবই নয়) সত্যিকার অর্থে চেষ্টা করেছি? বরাক উপত্যকার বাইরে ভারতবর্ষের কতটা বাঙালি জানে উনিশে মে’র কথা, এগারো শহিদের কথা? এ ব্যাপারে আমাদের ভূমিকা কি সন্তোষজনক? এভাবে চলতে থাকলে হয়ত প্রশ্নের মালা গাঁথা হয়ে যাবে। তবে প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার দায়ও কিন্তু আমদেরই। আমাদেরকেই ভাবতে হবে ১৯ মে শুধু শহিদ দিবস পালনের তারিখ হয়েই থাকবে? না কুমুদ, তরণীদের আত্মবলিদানের সত্যিকার অর্থ খুঁজে নিতে পারব আমরা উনিশের হাত ধরে।
আমরা চাই একুশ আর উনিশ হাত ধরে চলুক। ভৌগলিক সীমার উর্দ্ধে উঠে আমাদের পরিচয় আমরা বাঙালি। আমদের মাতৃভাষা বাংলা।
Comments are closed.