"Let me not pray to be sheltered from dangers" a tribute to Rabindranath Tagore
রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসেন না এমন বাঙালির দেখা মেলা ভার! আসলে রবীন্দ্রনাথ আমাদের রক্তে, আমাদের মজ্জায়, আমাদের অন্তরে, আমাদের হৃদয় সিংহাসনে! সেই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কিছু লিখতে চাওয়া এক মস্ত বড় ব্যাপার! ছোটবেলা প্রায়ই একটা স্বপ্ন দেখতাম। স্বপ্নটা খুব একটা প্রাসঙ্গিক নয়, কিন্তু তবুও উল্লেখ করছি। স্বপ্নে আমি ছোট্ট ঠাকুর রামকৃষ্ণকে সাজিয়ে দেবার চেষ্টা করছি। ঠাকুর এদিক ওদিক পুরো বাড়ি জুড়ে ছোটাছুটি করছেন। কিছুতেই হাতের নাগালে আসছেন না। ঠাকুর কে ধরা, ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসা, এনে সাজিয়ে তোলা সে কি আর আমার সাধ্যির? এখানেও যেন একই অবস্থা! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে কিছু লিখতে যাওয়া কি আর চাট্টিখানি কথা?’ সেতো মস্ত ব্যাপার!! কিন্তু আমার তেমন একটা চাপ নেই। কারণ ওজনদার শব্দসমষ্টিতে বিখ্যাত সব প্রবন্ধ লেখার কোন প্রচেষ্টা নয়। রবীন্দ্রনাথ তো আমাদের প্রাণেরই একজন! খুব কাছের মানুষ! প্রাণের রবিঠাকুরকে নিয়ে মনের অনুভূতি প্রকাশের প্রচেষ্টা মাত্র!
তাই যখন সঞ্চয়িতা হাতে নিয়ে কবিতায় কন্ঠ মিলাই, মনে হয় যেন পাশে বসে সেই কাছের মানুষটি বড় যত্ন করে কবিতার ভাবার্থ বুঝিয়ে দিচ্ছেন! প্রাণের মানুষ বলেই তো রবি ঠাকুরের জন্মদিন বাঙালির কাছে উৎসবের থেকে কোন অংশে কম নয়। বাঙালি আর কিছু জানুক না জানুক, ‘পঁচিশে বৈশাখে’র মানেটা বড় স্পষ্টভাবে জানে, বাংলা ক্যালেন্ডারের তারিখ নিয়ে মাথা না ঘামালেও পঁচিশে বৈশাখ মনে রাখতে অসুবিধা হয় না।
আমাদের ছোটবেলায় ২৫শে বৈশাখের আয়োজন শুরু হয়ে যেত অনেকদিন আগে থেকে। পাড়ায়, স্কুলে, কলেজে। সর্বত্র। আমাদের পাড়ায় এ আয়োজনে দলটা কিন্তু ছিল বেজায় বড়। নাচ গান ছাড়াও বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে আমরা মঞ্চস্থ করতাম রবীন্দ্রনাথের নাটক। কখনো কখনো আবার রবীন্দ্রনাথের ‘জুতো আবিষ্কার’, ‘অভিসার’, ‘নিষ্কৃতি’ ইত্যাদি মঞ্চস্থ করতাম। আমাদের পাড়ার ‘নীলিমাদি’ বলে এক দিদি এই অনুষ্ঠানগুলো মঞ্চস্থ করানোর দায়িত্বে থাকতেন। উনার বাড়িতে এক মাস ধরে চলত মহড়া। প্রথম যেদিন নাটকের চরিত্রগুলো বাছাই হত, তখন দুরু দুরু বুকে বসতাম, কোন্ চরিত্র ভাগ্যে জুটবে। মনে মনে প্রার্থনা করতাম অভিনয়ের সুযোগ থাকে এমন ভালো চরিত্র পাওয়ার জন্য। স্কুল থেকে এসে লক্ষী মেয়ের মত খেয়ে দেয়ে হোমওয়ার্ক করে দে দৌড় রিহার্সেলে। অনুষ্ঠান থেকেও আকর্ষণীয় হয়ে উঠত এই রিহার্সাল। এ শুধু আমাদের পাড়ার চিত্র নয়, বেশিরভাগ পাড়ায়ই অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো বড় আন্তরিকভাবে।
অনুষ্ঠানের দিন তো সে কি হুলুস্থুল! তবে বৈশাখ মাসে বিভিন্ন জায়গায় একই সঙ্গে অনুষ্ঠান থাকতো বলে পাড়ার অনুষ্ঠানটা অনেক সময়ই অন্য কোন দিনে করা হতো। পঁচিশে বৈশাখের দিন সকালে রবীন্দ্রনাথের পায়ে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে আমাদের দিনের শুরু হতো। ছোট্ট পরিসরে পাড়ার ক্লাবের রবীন্দ্রনাথকে পুষ্পাঞ্জলির মাধ্যমে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করতে বেশি ভালবাসতাম । আসলে “নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়”। সব দিকে রবীন্দ্র সংগীতের সুর উৎসবের মেজাজটা বেশ ভালোভাবেই ধরে রাখত।
আর থাকতো বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতা। স্কুলের মাধ্যমে নাম দিয়ে আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা চাই-ই চাই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যখন আবৃত্তি করতে স্টেজে পা রাখতাম তখন ঠকঠক পা কাঁপতো, যেন কেউ কর্তাল বাজাচ্ছে। দুরু দুরু বুকে কে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। অথচ গলার স্বরে কিংবা মুখের অভিব্যক্তিতে তা মোটেই বোঝানো যাবে না! একইভাবে প্রতিযোগিতা শেষে যখন ফলাফল ঘোষণা করা হতো, তখনো একইভাবে বুকের ভিতরে হাতুড়ি পেটানো চলত। বঙ্গ সাহিত্যের প্রতিযোগিতাগুলোতে পুরস্কার প্রাপ্তির কথা জানা গেলেও পুরস্কারটি হাতে পাওয়া যেত নজরুল জয়ন্তী অনুষ্ঠিত হওয়ার পর। তখন রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুলজয়ন্তী ও সুকান্ত স্মরণ অনুষ্ঠান- তিনটিতেই বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা চাই!
রাতে জেলা গ্রন্থাগার ভবনে রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখার বায়না পূরণ করতে হতো অভিভাবকদের। আরো কিছু বড় হওয়ার পর সেই অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণ করলেও রবীন্দ্রনাথকে যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই বাড়িতে একান্ত নিজস্ব পরিসরে কবিগুরুর জন্মদিন পালন করেছি বরাবর। খুব ভালো ভাবেই বলতে পারি, এ শুধু আমি নই, বাঙালির ঘরে ঘরে কবিগুরুর জন্মদিন পালন করা হতো নিজের মতো করে। ঘরের কোনায় ছোট্ট একটি টেবিল রেখে টেবিল ক্লথ বিছিয়ে পরম যত্নে রাখতাম রবীন্দ্রনাথের ফটো। গলায় সাদা ফুলের মালা, যা নিজেই গাঁথতাম। টেবিলটাকে সাদা ফুল দিয়ে সাজিয়ে তুলতাম, ধুপ ধুনো সামনে দিয়ে টেবিলের নিচে মেঝেতে আসন করে বসতাম রবি ঠাকুরের দিকে মুখ করে। হাতে তুলে নিতাম সঞ্চয়িতা। আপন মনে একটার পর একটা আবৃত্তি করে চলতাম। শ্রোতা নেই একজনও। শ্রোতা শুধু আমি আর যার সামনে বসে কবিতা পাঠ করছি সেই কবিগুরু। ‘গঙ্গা জলে গঙ্গা পূজা’ উদাহরণটা বোধ হয় রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য। জীবনের প্রতিটি স্তরে প্রতিটি পর্যায়ে যেমন রবীন্দ্রনাথ তাঁর অফুরন্ত ভাণ্ডার নিয়ে আমাদের সঙ্গে রয়েছেন, ঠিক তেমনি রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানাতে, রবীন্দ্র স্মরণে রবীন্দ্র সংগীত রবীন্দ্র নৃত্য রবীন্দ্র সাহিত্যই আমাদের ভরসা।
আসলে পঁচিশে বৈশাখে আমরা ডুবে থাকতাম রবীন্দ্র রসে। আর সবচাইতে ভালো লাগার বিষয় ছিল এই রবীন্দ্রজয়ন্তীতে বাছবিচার না করে আমরা সবাই অংশগ্রহণ করতাম। ‘বর এসেছে বীরের ছাঁদে, বিয়ের লগ্ন আটটা’ বলার মধ্যে কোনও সঙ্কোচ নেই। ছোট ছোট বাচ্চারা একজন পরে একজন কবিতা পাঠ করত। কারণ রবীন্দ্রনাথ কারোর একার নন, রবীন্দ্রনাথ সবার।
পাড়ায় ছোটদের নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে নিজেও নাটক করানোর সাহস করেছি। যোগ্যতা হয়তো ছিল না, কিন্তু উৎসাহ ছিল। ক্ষমতা হয়তো ছিল না,কিন্তু কিছু করার তাগিদ ছিল। আসলে সেই যে বললাম রবীন্দ্রনাথ তো আমাদেরই একজন, তাই হয়তো ভেতর থেকে তাড়নাটা আসে আপনাআপনি। উপস্থাপনা উল্লেখ করার মতো না হলেও এই যে সবাই মিলে রবীন্দ্রনাথকে ভালোবেসে কিছু একটা করার তাগিদ সেটা আজকের সময়ে কতটা? আজকের এই ক্যারিয়ার সর্বস্ব জগতে হয়তো এসবকে সময় নষ্টের তালিকায়ও ফেলা হতে পারে। কিন্তু অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর আমরা যে অনাবিল আনন্দের সন্ধান পেতাম, সে আনন্দের খবর কি ওদের জানা আছে?
বর্তমানে প্রবাসে( বিশেষভাবে হিন্দি অধ্যুষিত এলাকায়) থাকার সুবাদে রবীন্দ্রজয়ন্তীতে তেমন কিছু করার সুযোগ হয়তো পাইনা। কিন্তু সারা বছর ধরে আমাদের চিন্তায়,আমাদের মননে, আমাদের প্রতিদিনের কাজে যার উপস্থিতি আমরা উপলব্ধি করি, সেই রবি ঠাকুরের জন্মদিনে সারাদিন ধরে আমাদের মননে, আমাদের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ ঘোরাঘুরি করবেন, সেটাই স্বাভাবিক।
তাই কোনও আয়োজনের প্রয়োজন নেই। নাই বা হলো অনুষ্ঠানের ঘনঘটা! ভালবেসে মন-প্রাণ প্রাণ ঢেলে একটা রবীন্দ্র কবিতা আবৃত্তি কিংবা রবীন্দ্র কাব্য পাঠও হতে পারে রবীন্দ্র স্মরণ, হতে পারে প্রিয় কবির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য!
Comments are closed.