Also read in

Malegarh decked up to pay tribute to the martyrs of Sepoy Mutiniy

স্বাধীনতার ৭২ বছর পরে সেজে উঠেছে মালেগড়, সিপাহী বিদ্রোহের স্মৃতিবিজড়িত মালেগড়

সাজ সাজ রব, এবার সেজে উঠেছে সিপাহী বিদ্রোহের রক্তমাখা ভূমি মালেগড় । দেশের ৭৩তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের খাতায় সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী সিপাহী বিদ্রোহের রণভূমি লাতুর মালেগড় টিলাকে । শতবর্ষের বেশী সময় অন্ধকারে থাকলেও এবার আলো পৌঁছেছে শহীদ টিলায় । ৭৩তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন উপলক্ষে অন্ধকার থেকে আলোর রশ্মি পড়েছে ২৬ বীর শহীদের রক্ত বিজড়িত পুন্যভূমিতে । তিনদিনের জন্য আলোকসজ্জায় সাজিয়ে তোলা হয়েছে গোটা মালেগড় টিলাকে । স্বাধীনতা দিবসে জেলা প্রশাসন, ০৭ নং সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনী, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পাটকাই ট্রেকার্স সহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সহযোগিতায় আয়োজন করা হয়েছে বিশেষ অনুষ্ঠানের । পতাকা উত্তোলন কার্যসূচী সহ অনুষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনীর কুচকাওয়াজ সহ বিভিন্ন প্রদর্শনী ।

রক্তমাখা অধ্যায়ের সাক্ষী বহন করা মালেগড় কিন্তু বরাবরের অবহেলিত রণভূমি । স্বর্ণাক্ষরে লিখে থাকার পরিবর্তে উপক্ষিত ইতিহাসে । এতদিন কিন্তু আলো পড়েনি সেখানে; দেশ মাতৃকার শৃঙ্খলমোচনে মহাবিদ্রোহের শহীদদের স্মৃতিতে রয়েছে নামমাত্র সমাধি । এপারে লংগাই, ওপারের সোনাই নদীর তীরে ভারত বাংলা আন্তর্জাতিক সীমান্তে নীরবে নিভৃতে শায়িত ২৬ বীর শহীদ । মহাবিদ্রোহের ১৬২ বছর হলেও, দেশের স্বাধীনতার বাহাত্তর বছর কিন্তু কম কথা নয় ।

 

তবে এবারে সত্যি সাধুবাদ রাজ্য সরকারকে, বিশেষ করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে । ইতিহাস খ্যাত শহীদ ভুমিকে পর্যটনের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করে বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যেগে খুব শীঘ্রই নতুন সাজে সেজে উঠবে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সাক্ষী শহীদভূমি, জেগে উঠবে চির অবহেলিত পুণ্য ভূমি । দাবি কিন্তু আমাদের দীর্ঘদিনের। আলোহীন সমাধির নিস্তব্ধতা থাকা মালেগড়ে হোক গবেষণা কেন্দ্র, পর্যটনের মানচিত্রে অন্তভুক্ত করা হউক এই আশা সর্বকালের । বীর বাহাদুর সৈনিকের রক্তে রাঙানো ঘাসে শহীদ স্মারকে প্রতি বছর শহীদ শ্রদ্ধাঞ্জলী আয়োজন করা হউক এই প্রত্যাশা সবদিনের । এবারের স্বাধীনতা দিবসে জেলা প্রশাসনের স্বাধীনতা দিবসের সুচিপত্রে মালেগড়কে অন্তভুক্ত করা হয়েছে । এইতো কদিন আগে কার্গিল বিজয় দিবস বিএসএফের তরফে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়েছে মালেগড়ে । ভারত কেশরী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির আত্মবলিদান দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন হয় মালেগড়ে, বর্তমান শাসক দলের পক্ষ থেকে । আর ১৮ ডিসেম্বর তো শহীদ শ্রদ্ধাঞ্জলী । এখানকার স্থানীয়দের কাছে শহীদ দিবস ।

 

দিনটা ছিল ১৮৫৭ সালের ১৮ই ডিসেম্বর । শীতের সকালে সম্পূর্ন কুয়াশাচ্ছন্ন, বন্য পাখির কিচিরমিচির শব্দে নিদ্রারত পৃথিবী । পাশে ধীর গতিতে নিঃশব্দে বয়ে যাচ্ছে লংগাই নদী । জনবসতি শূন্য, দিনটা রবিবার হলেও লাতুর বাজার তখন কিন্তু তেমনটা প্রানবন্ত হয়ে উঠেনি । দুই একজন কৃষক হালচাষের জন্য ধানক্ষেতের উদ্দেশ্য রওয়ানা হয়েছেন সবেমাত্র । লাতু মালেগড়ের পূর্ব প্রান্তে কুয়াশায় ঢাকা আকাশে যখন ভোরের সূর্যোদয় হচ্ছিল ঠিক তখনই সূর্যের লাল রঙের সঙ্গে ২৬ বীর শহীদদের রক্তে মিলেমিশে একাকার হয়েছিল মালেগড় টিলার ঘাস ভেজা সবুজ মাটি । ভারতবর্ষের সিপাহী বিদ্রোহের যে রক্তমাখা অধ্যায় সেই অধ্যায়ের সঙ্গে মালেগড় সহ বরাক উপত্যকা জুড়ে আছে। সেই অধ্যায়টির প্রসঙ্গ আজ ও অধিকাংশ সাধারণ মানুষের কাছে অজ্ঞাত । জাতপাতকে দূরে রেখে সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল নিদর্শন মালেগড় । ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ ছিল ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন । যার সূচনা ১৮৫৭ সালের ২৯ শে মার্চ ব্যারাকপুরে । বীর সিপাহী মঙ্গল পান্ডের নেতৃত্বে । বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ছিল এনফিল্ড রাইফেল । উত্তর ভারত, পশ্চিমবঙ্গ, মধ্য ভারত গর্জে উঠেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে । দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে নিয়োজিত থাকা দেশীয় সিপাহীদের মধ্যে । বিদ্রোহের ঢেউ আঁছড়ে পরে তখনকার চট্রগ্রাম ( বর্তমান বাংলাদেশ) বন্দরে । চট্রগ্রাম বন্দরে তখন নিয়োজিত ৩৪ নেটিভ ইনফ্রেনটি । ব্যারাকে অবস্থানরত ছিল তিন শতাধিক সিপাহী । ১৮ নভেম্বর দেশীয় সিপাহীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করলে প্রথম পদক্ষেপে বীর সিপাহী চট্রগ্রাম কালেক্টর কার্যালয় হামলা চালিয়ে জেলবন্দী দের মুক্ত করেন । কোষাগার থেকে লুঠ করেন তাঁরা ২,৭৮,২৬৭ টাকা সহ তিনটি হাতি, অস্ত্রসস্ত্র, গোলা বারুদ । কুমিল্লা হয়ে সিপাহীরা পৌঁছে ত্রিপুরা রাজ্যে । ৩৪ নং নেটিভ ইনফ্রেনটির ত্রিপুরায় অবস্থানের খবর ব্রিটিশের কাছে পৌঁছে দেয় দেশদ্রোহি বিশ্বাসঘাতক । দুর্গম পাহাড় অতিক্রম করে দেশীয় বিদ্রোহী পদাতিক বাহিনী অবস্থান করে লংগাই নদীর তীরের উঁচু টিলায় । এদিকে ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে তথ্য ছিল যে বিদ্রোহীরা প্রতাপগড়ের (পাথারকান্দি) গভীর জঙ্গলে আস্তানা গেড়ে আছেন । সেই হিসাবে সৈন্য সামন্ত নিয়ে সিলেট থেকে ৩৬ ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে ১৭ ডিসম্ভর বিকালে এসে প্রতাপগড়ে ঘাঁটি গেড়েছিলেন ব্রিটিশ মেজর বিং । গুপ্তচররা ব্রিটিশ মেজরের কাছে খবর পৌঁছায় যে, বিদ্রোহী সিপাহীরা ২৮ মাইল উত্তরে থাকা লাতু এলাকায় স্ত্রী পুত্র দের নিয়ে নতুন ঠিকানায় আছেন । খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাতের অন্ধকারে সেখান থেকে যাত্রা শুরু করে ১৮ ডিসেম্বর ভোরে সেখানে গিয়ে পৌঁছয় মেজর বিং নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ বাহিনী । সঠিক ভাবে অবস্থান নেওয়ার আগেই ব্রিটিশ বাহিনীর উপরে বীরবিক্রমে ঝাপিয়ে পড়েন দেশীয় সিপাহীরা । চার জন ইংরেজ অনুগত সেনার পাশাপাশি যুদ্ধে নিহত হন মেজর বিং । মালেগড়ের পবিত্র মাটিতে শহীদ হন ২৬ বীর শহীদ দেশীয় সিপাহী । এদের মধ্যে জনাকয়েকের নাম জানা গেলেও বাকি তথ্য আজ ও অজ্ঞাত । দেশীয় সিপাহীদের সমাধিস্থ করা হয় মালেগড় টিলায় । ভয় আতঙ্কে শঙ্কিত হয়ে উঠে তখন সুরমা উপত্যকা, নিঃশব্দে নিস্তব্ধ হয়ে উঠে লাতু এলাকা । আত্মগোপন করে থাকা কোন বিদ্রোহীকে আশ্রয় বা থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে- গ্রামের মানুষদের ভয় দেখাল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি । হ্যাঁ, এটাই রক্তে রাঙানো ১৮ ডিসেম্বর ১৮৫৭ সাল । ভারত বাংলার আন্তর্জাতিক সীমান্তে লাতু গ্রাম । সেসময় অভিভক্ত শ্রীহট্ট জিলার (সিলেট) ব্যবসায়িক কেন্দ্র ছিল লাতু । কাছাড় এবং শ্রীহট্ট জিলার সীমায় থাকা লাতুর কাছে মালেগড়ের নিচেই বয়ে গেছে লংগাই নদী । ওপারে গিয়ে নামধারন করেছে সোনাই । লাতু বাজার কাছেই সেই লংগাই নদী । আর তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সেই ঐতিহাসিক টিলা । তখনকার জমিদার উঁচু টিলায় গড় বানিয়ে মালখানা মজুত রাখতেন, আর বিদ্রোহী সিপাহীরা কোষাগার লুঠ করে এনে এখানেই মজুত রেখেছিলেন । সেই মাল ঘর থেকেই মালেগড়ের নামকরণ । ব্রিটিশ সরকারের বহু নথিতে মালেগড় রনের বিভিন্ন তথ্য পাওয়া গেলেও আক্ষেপের বিষয় অসমের ইতিহাসে মালেগড়ের যুদ্ধের অধ্যায়ের কথা উল্লেখ নেই । বরাক উপত্যকায় সিপাহী বিদ্রোহের প্রভাব সম্পর্কে আবার অনেকে গবেষনা করেছেন । লোক কথা এবং জঙ্গিয়ার গীত খ্যাত লোক গীতিতে বিদ্রোহের প্রভাব বর্ননা করা হয়েছে । বিদ্রোহের সময় কাছাড় জেলার পুলিশ অধীক্ষক হিসাবে কর্মরত থাকা রবার্ট স্ট্রিয়ার্টয়ের চিঠি পত্র অনুসন্ধান করে ইতিহাসবিদ সুজিত চৌধুরীর সংকলন করা ‘দ্যা মিউটিনি পিরিয়ড ইন কাছাড়’ গ্রন্থ হচ্ছে প্রামাণ্য এবং নির্ভরযোগ্য দলিল । তবে কিভাবে এবং সঠিক কোথায় যুদ্ধে নিহত ব্রিটিশ বাহিনীর সেনাদের সমাধি দেওয়া হয়েছে তার কোন তথ্য আজ পর্যন্ত জানা যায়নি । এখানকার বয়ঃজেষ্ঠ্য নাগরিক প্রয়াত আব্দুল মুকিত চৌধুরীর কাছ থেকে জানা গেছে যে, মালেগড় টিলায় সমাধিস্থ করা হয়েছিল দেশীয় সেনাদের । তাঁর সাত বছর বয়সে মালেগড় টিলায় খনন কার্যের সময়ে তিনি উদ্ধার করেছিলেন যুদ্ধে ব্যবহার হওয়া পিস্তল, লোহার গোলা । সেখানে উদ্ধার হয়েছিল বুট জুতো সহ দুইখানা তরোয়াল । কিন্তু সরকারী ভাবে উদ্ধার হওয়া অস্ত্র গুলি সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করা হয়নি আজ ও । যারা দুশো বছর রাজত্ব করা পরাক্রমশালী ইংরাজ সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম রুখে দাঁড়িয়েছিল তাঁদের দেশের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে এদের স্মরণ করা আমাদের নেহাত কর্তব্য । বলা বাহুল্য, মালেগড়কে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসার জন্য প্রশংসার যোগ্য কিন্তু সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনী । দেশসেবার পাশাপাশি সামাজিকতা এবং মালেগড়ের রক্ষণাবেক্ষনে যথেষ্ট অবদান রয়েছে সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনীর । সঙ্গে প্রশংসা করতে হবে স্বেচ্ছাসেবী সংঘটন পাটকাই ট্রেকার্সের । ৭৩তম স্বাধীনতা দিবসের পুন্য লগ্নে এখানকার মানুষের সরকারের কাছে একটাই দাবি, খুব শীঘ্রই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা পর্যটনমন্ত্রীর হাত ধরে মালেগড়ে গড়ে উঠুক পর্যটন কেন্দ্র, মালেগড়ের পাশে যদি ভারত-বাংলা চুক্তি মতে সীমান্ত হাট গড়ে উঠে তাহলে দিন দিন এতে বাড়বে পর্যটকের সংখ্যা, বাড়বে সরকারের রাজস্ব, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে উন্নত হবে সীমান্ত এলাকা । গৌরবময় অধ্যায়ের কথা জানবে গোটা দেশ, জানবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ।

তথ্যসূত্র :
মহাবিদ্রোহের রণধ্বনি
দৈয়াঙর পরা বরাক পারলৈ

দ্যা মিউটিনি পিরিয়ড ইন কাছাড়

Comments are closed.