Also read in

Merameri: A ride to nostalgia !

“কিতারে তোমরা একলা একলা পার রায়নি? না আমার আইতে লাগব? দেখো গো সোনা, হাত উৎ পুড়িও না।”
আমাদের প্রিয় সিলেটি উপভাষায় উচ্চারিত এই বাক্য সমষ্টি থেকে অনেকেই হয়তো ক্ষানিকটা আন্দাজ করে নিয়েছেন আজকের লেখার বিষয়টি। সারাবছর রান্নাঘর মুখো না হলেও এই দিনটিতে হাত টাত জ্বালিয়ে সবাই মিলে হইহুল্লোড় করে রান্না করার প্রচেষ্টা-ই মায়েদের চিন্তার কারণ। মেড়ামেড়ি বলে কথা! জ্বললে না হয় একটু জ্বলে গেল হাতটা! তাই বলে মেড়ামেড়ি করার আনন্দ নেব না এমন হতে পারে! হ্যাঁ, বাঙালি সিলেটিদের এক অনবদ্য আনন্দের রাত। এর জন্য থাকে দীর্ঘ অপেক্ষা। আর দীর্ঘ অপেক্ষার পর প্রাপ্তি এক বাঁধনহারা আনন্দ।

পৌষ মাসের সংক্রান্তিতে আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কোন না কোন উৎসব পালিত হয়ে থাকে; কোথাওবা পোঙ্গল, কোথাও লোহরি, বিহু বা মকর সংক্রান্তি । আসলে, এটা ফসল ওঠার পর এক আনন্দোৎসব যেখানে খাওয়া-দাওয়ার একটা মুখ্য ভূমিকা রয়েছে। আমাদের বরাক উপত্যকায় এই মকর সংক্রান্তি তো আছেই কিন্তু এই সংক্রান্তির আগের রাতেও আছে আমাদের এই বিরাট উৎসব! এক বিশেষ রাত! মেড়ামেড়ি! মাঠের মধ্যে বাশ, খড় (নেড়া) দিয়ে তৈরি করা ঘর যাকে বলা হয় মেড়ামেড়ির ঘর। সেই ঘরের বাইরে রান্নাবান্না করে চড়ুইভাতি বা পিকনিকের আয়োজন করা হয়ে থাকে।মকর সংক্রান্তিতে সুস্বাদু পিঠেপুলি খাওয়ার আগের রাতের এই মেড়ামেড়ির আসর বলা যায় উপরি পাওনা। কিন্তু অনবদ্য।

আমাদের ছোটবেলায় এক সপ্তাহ আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত আয়োজন। বাংলা বছরের পৌষ মাসে মকর সংক্রান্তি অনুষ্ঠিত হওয়ার জন্য মেড়ামেড়ির ঘর বানাতে নেড়ার অভাব হত না। কারণ ইতিমধ্যেই ধানক্ষেত থেকে ধান গাছ কেটে ফসল উঠে যায় ঘরে। ধান গাছগুলো শুকিয়ে ছন বা নেড়া হয়ে ক্ষেতে পড়ে থাকে। সেগুলোকে এনে মেড়ামেড়ির ঘর বানানোর আনন্দটা উপভোগ করেননি এমন সিলেটি বাঙালির সংখ্যা কমই হবে। বাঁশ খড় দিয়ে তৈরি ঘরটি কিন্তু ভালোভাবেই মজবুত করে গড়ে তোলা হত।
এমনকি বৈদ্যুতিক সংযোগের ব্যবস্থা করে লাইট জ্বালানো এবং গান শোনার ব্যবস্থা অবশ্যই রাখা চাই।। মেড়ামেড়ির ঘর মাঠে বা উঠোনে বানানোর ফলে পৌষ মাসের শীতে কাবু হয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও বন্ধু-বান্ধব মিলে খাওয়া দাওয়া, হই হুল্লোড়ের আনন্দের উত্তাপ হাড় কনকনে ঠাণ্ডাকে ছাপিয়ে উষ্ণতা প্রদান করে।

সবার কাছ থেকে চাঁদা তুলে বাজার হাট থেকে শুরু করে সব কাজ নিজেরাই করে নিজেদের মতো রান্না করে খাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ সেটা বাঙালি সিলেটিদের কপালেই জোটে। আর এই সংক্রান্তির পিঠে পুলি ও মেড়ামেড়ি সিলেটি সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে তোলার পাশাপাশি এক অনাবিল আনন্দের আসরের আয়োজন করে।

বড় বেলায় এসে ছোটবেলার সেই মেড়ামেড়ির দিনগুলো নিজেদেরকে নস্টালজিক করে তোলার জন্য যথেষ্ট। মন বারবার ছুটে যায় ঐ দিনগুলোতে। এই পরবের আরো একটি চমৎকার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই দিনটিতে ছোটরা যেমন এক দিনেই বড় হয়ে যাওয়ার ভূমিকা পালন করে বা ভান করে, তেমনি বড়দের ভেতরে যে একটা বাচ্চা মন রয়েছে সেটাও যেন এদিন জেগে উঠে। তাই ছোটরা তো বটেই এমনকি বড়দেরও মেড়ামেড়িতে পিকনিক করতে দেখা যায়।

মেড়ামেড়ির ঘরের সামনে মাটি খুঁড়ে তিনটি ইটের সাহায্যে তৈরি করা চুলোতে রান্না করার আনন্দটা ছিল অপরিসীম। তবে মূল রান্নার আগে অবশ্যই একবার চা খাওয়া জরুরি। সঙ্গে ডালমুট, পাকোড়া, ঝাল মুড়ি কত কি! এরপর শুরু হতো মূল রান্নার পালা। নানা মুনির নানা মত গ্রহণ করে শেষ পর্যন্ত যে রান্নাটি সম্পূর্ণ হত তা যদি কেউ কাগজে-কলমে রেসিপি লিখে রাখত তবে আজকের দিনে সঞ্জীব কাপুরও বোধহয় হার স্বীকার করে নিত; এমনই অদ্ভুত সেই রেসিপি। আমাদের মত যারা বাড়ির উঠোনেই মেড়ামেড়ির ঘরের ব্যবস্থা করত তাদের রান্নার মধ্যে মধ্যে কতবার যে বাড়ির ভেতরে এটা ওটার জন্য মায়ের কাছে ছুটতে হতো তার হিসাব করা মুশকিল। মায়েদেরও কি আর শান্তি ছিল? বারবার মুখোর দিয়ে দেখতেন, ঠিক আছে তো? কোথাও কোন অঘটন ঘটছে না তো?

রান্নার ফাঁকে ফাঁকে ভেতরে গিয়ে মুখোর দেওয়ার কাজ বাচ্চাদেরও কম ছিল না। আর এক্ষেত্রে কারণ ছিল চুপিসারে মা মাসিদের তৈরি করা পিঠে পুলি চোখের আড়ালে নিয়ে আসা। চাইলেই যেখানে পাওয়া যায়, সেখানে পিঠে চুরি করার মধ্যে যে আনন্দ, সে কি আর বিশ্বজয় থেকে কিছু কম! তবে আরেকটি ব্যাপার ছিল খুবই মজাদার, যারা কখনো সখনো মাকে সাহায্য করতে গিয়ে একটু-আধটু কাজ শিখেছে তাদের কিন্তু, এই পিকনিকে খুবই দাম। আর তারাও বিদ্যা জাহির করতে খুবই সতর্ক। সেই কাঁচা, আধা পাকা হাতের তৈরি রান্না হয়তোবা কখনো প্রচণ্ড সুস্বাদু, নয়তোবা ‘পাতে’র একদিকে মাংস আর অন্যদিকে গড়িয়ে যেত ঝোলের বন্যা। কিন্তু কোনো অভিযোগ নেই। পরম তৃপ্তিতে মাংসের ঝোলে সাঁতার কাটতে কাটতে চলত খাওয়ার আনন্দ।

অপরিপক্ক হাতে রান্না করা, সঙ্গে অফুরন্ত কথার ফুলঝুরি, ক্যাসেটে বাজানো গানের সঙ্গে নাচ আর মাঝেমধ্যে এটা ওটা মুখে পুরার মধ্যে দু একবার আশে পাশে চলা আরো মেড়ামেড়িগুলো ঘুরে দেখে আসা চাই নিয়ম করে।

আগের দিনে এই পিকনিকের সাথে পাল্লা দিয়ে দুষ্টুমিও চলত, যদিও সেরকম আজকাল আর দেখা যায় না। কারো বাড়ির পাঁচিল টপকে ফল-সবজি, মুরগি চুরি পর্যন্ত করা হত। কারোর বাড়ির গেট খুলে নিয়ে দূরে অন্য কোন বাড়ির গেটে বসিয়ে দেওয়া হত। সকালে উঠে এসব দেখে গুরুজনেরা গেইট খুঁজতে বেরোতেন সাথে সস্নেহে মাফ করে দিতেন। এখন শহরাঞ্চলে এমনটা ভাবাই যায়না।এখন মাঠও নেই, আর বাড়ির উঠোনেও জায়গা নেই। আর হয়তবা আজকালকার দিনের বাচ্চাদের সময়েরও অভাব। সঙ্গে খড়ের অভাব। এখন খড়ের অভাবে তাবু খাটিয়ে মাইক বাজিয়ে এই পিকনিকের মেজাজ আনা হয়।সবমিলিয়ে উৎসাহেও হয়ত ভাটা পড়েছে।

অথচ অতীতের হাত ধরে মেড়ামেড়ির দিনের কথা ভাবলে বুড়োদেরও চোখ চকচক করে উঠবে সেদিনের আনন্দানুভূতিতে।
মজাটা এ দিনেই কিন্তু শেষ নয়। পরেরদিন সকাল অব্দি গড়ায় সেই আনন্দের রেশ। চলে প্রতিযোগিতা কার আগে কে স্নান করবে! এরও দু দিক রয়েছে। এক, পৌষ মাসের সকালের ঠান্ডা উপেক্ষা করে কে সবচেয়ে প্রথমে স্নান করার সাহস দেখাতে পারে! আর দুই, যে প্রথমে স্নান করবে, তারই অধিকার থাকবে মেড়ামেড়ির ঘরে আগুন ধরানোর। সে কি প্রতিযোগিতা! মনে হলেই শিহরণ জাগা অবশ্যম্ভাবী। কনকনে ঠাণ্ডায় স্নান করে আগুন পোহানোর পর শুরু হত পিঠেপুলি খাওয়া।

মেড়ামেড়িতে যেমন অফুরান আনন্দের আসর বসে, তেমনি একা নয়, সে আনন্দ সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার মধ্যেই রয়েছে পরম আনন্দ। এখন যদিও এ আনন্দে কিছুটা ভাটা পড়েছে, সময়, পরিস্থিতির শিকার হয়ে উৎসাহে জং ধরেছে কিন্তু এখনও অনেকেই জিইয়ে রেখেছেন শুধু সিলেটিদের জন্য এই বিশেষ আনন্দের আসর।

Comments are closed.