Pijush Kanti Das: The boss, the man, the smile and the memories
মনের গভীরে স্মৃতির ভিড়, সে ভিড়ে আজও ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে পীযূষদা
ওপাশের সামনের ডেস্কে বসে আছে ৩০ অনূর্ধ্ব এক যুবক। এক মুখ চাপ দাড়ি। মুখে এক আশ্চর্য গাম্ভীর্য। বয়সের সঙ্গে একটু বেমানান। মন দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছে। মাঝে মধ্যে কাগজ থেকে চোখ তুলে দেখছে কি চলছে উল্টো দিকে। আর উল্টো দিকের ডেস্কে সেদিন বসেছিলাম সহকর্মীদের সঙ্গে আমি। সদ্য সোনার কাছাড়ে জয়েন করেছি। খুব একটা কিছু বুঝে উঠিনি তখনও। তাই ভয়ে ভীত না হলেও ঠিক সহজও ছিলনা সবকিছু। নতুন নতুন খবর লিখছি। তাই ঠিক কতটা খবর হয়ে উঠছে লেখাটা, আর কতটা নিছকই বাক্য সমষ্টি এ সংশয়ে দুরুদুরু বুকে নিজের লেখা কাগজটা তুলে দিলাম সেই চাপ দাড়ি ওয়ালা যুবকের দিকে।সেই যুবকটি আর কেউ নয়, আমাদের সবার প্রিয় পীযূষ কান্তি দাস। বলতে গেলে পীযূষদা’র কাছেই আমার প্রথম হাতে খড়ি সাংবাদিকতার।সোনার কাছাড়ের মালিক রণদা ( রণবীর রায়) পীযূষ দাকে বলেছিলেন খতিয়ে দেখতে, সদ্য সোনার কাছাড়ে যোগ দেওয়া আমাদের কজনের সম্ভাবনা কতটুকু এলাইনে টিকে থাকার। পীযূষদা রোজ বিকেলে একবার করে এসে দেখাশোনা করত। নিউজ লিখতে দিত। হচ্ছে কিনা খতিয়ে দেখত। প্রথম প্রথম বেশ ভয় করত। নিউজ রুমে ঢুকলে মনে হতো, বাপরে এবার কি হবে? কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই দেখলাম সে যেন এক অন্য মানুষ। যেমন সেন্স অফ হিউমার, তেমন অঢেল জ্ঞান, আর তার চাইতেও বেশি আরও জানার আগ্রহ। তখন পীযূষদা যেন ছিল কিছুটা নারকেলের মত। বাইরেটা কঠিন, আর ভেতরে জলে টইটুম্বুর নরম শান্ত ভাব। তারপর থেকে ভয়ডর উবে গেল। কিন্তু পীযূষদা’র মধ্যে এক অন্য ধরনের গাম্ভীর্য ছিল। ঠোঁটের কোণে সব সময় লেগে থাকত এক চিলতে হাসি। চোখের ভাষা ছিল স্পষ্ট। মুখের সঙ্গে সঙ্গে চোখও কথা বলতো।
সিনিয়র হিসেবে যেমন তাঁর কাছ থেকে অনেক সময় অনেক কিছু শিখেছি, জুনিয়র হিসেবে কিন্তু আমরা অনেক আবদারও করতাম। খুব লাগালাগি করতো সবার সঙ্গে, কিন্তু দাদার মত। হ্যাঁ, সহকর্মী হলেও দাদার মতো পাশে থাকতো। মজা, রসিকতা সবটাই চলতো, কিন্তু সঙ্গে তাঁর প্রতি আমার মনে ছিল একটা সমীহ ভাবও। আর সেটা ওর নিজের অর্জন। এমনকি রনদাও পীযূষ’দাকে খুব মানতেন। রণদা কিছু একটা বললে হয়তো অনেকে মেনে নিত কিংবা এর প্রতিবাদ করত না। কিন্তু ব্যাপারটা পছন্দ না হলে পীযূষদা মুখের উপর বলে দিত। আর এজন্যই স্পষ্টবক্তা হিসেবে মনের মধ্যে পীযূষদার জন্য সন্মান বাড়ছিল। আর রণদাও তার সংবাদপত্রের এই সাংবাদিকের কথার খুব দাম দিতেন।
আমি, দেবযানী আমরা যারা দিনের ডেস্কে কাজ করতাম তাদের সঙ্গে রাতের ডেস্কের সাংবাদিকদের খুব একটা যোগাযোগের সম্ভাবনা থাকত না। কিন্তু পীযূষদা ছিল ব্যতিক্রম। দিনের এবং রাতের সাংবাদিকদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনে পীযূষদা’র ভূমিকা ছিল অনন্য।
আজ পীযূষদা নেই। এই চরম সত্যটাকে মন না চাইলেও মেনে নিতে হবে। বিশেষ করে তাঁর অসময়ে চলে যাওয়াকে মেনে নিতে পারছি না আমরা কেউই।খবরটা শোনার পর থেকে অজস্র স্মৃতি মনের ঘরে ভিড় করছে। সেগুলোকে ভেদ করে কিছু লেখা অসাধ্য হয়ে উঠছে, সঙ্গে রয়েছে এক হৃদয় কষ্ট।
দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার জন্য তাঁর সঙ্গে ঠিক সরাসরি যোগাযোগ ইদানীংকালে তেমনটা ছিল না। কিন্তু আমরা এমন একটা সময়ে বাস করি যে যোগাযোগ না থাকলেও যোগাযোগটা হয়েই যায়। সামাজিক মাধ্যমগুলো বড় সুন্দর করে আমাদের বুঝিয়ে দেয়, আমরা সবাই সবার সঙ্গে জুড়ে আছি। তাইতো ফেসবুকে পীযূষদার পোস্ট পড়তে পড়তে ভালো লাগায় মন ভরে ওঠে, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ওপিনিয়ন মোভার্সে তাঁর মন্তব্যগুলো অনেক সময় আমাকে ভাবিয়ে তোলে। এগুলো তাকে ফলাও করে কোনদিন বলিনি। তবু সম্পর্কতো রয়েই যায়। তাই মনে হতো সে তো আছে। সেই ‘আছে’ শব্দটার অর্থ যে কতটা বড়, আজকের এই অসহায় সময় বুঝিয়ে দিল বড় নিষ্ঠুর ভাবে।
আমরা একে অপরের সঙ্গে জুড়ে আছি বলেই গত জুলাই মাসে যখন ওরা স্বামী স্ত্রী পীযূষদা’র কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য দিল্লি গেল, প্রার্থনায় মন বারবার বলেছে ওদের ভালো হোক, ওরা সুস্থ থাকুক। জুড়ে আছি বলেই এ যুগেও ভালোবাসার সুন্দর নজির গড়তে দেখে শান্তশ্রীর জন্য মনের গভীরে শ্রদ্ধা মাখা এক ভালোবাসা অনুভব করেছি। মনে মনে বারবার বলেছি, ওদের ভালবাসার জয় হোক। সুসময় দুঃসময় দুটোতেই শান্তশ্রীর পাশে থাকাটা সার্থক হয়ে উঠুক।
আজ সেই জুড়ে থাকাটা আলগা হয়ে গেল। তবু বিশ্বাস, পীযূষদা বেঁচে থাকবে আমাদের সবার মনে আমাদের মত করে, বেঁচে থাকবে শান্তশ্রীর ভালোবাসায়,বেঁচে থাকবে শিঞ্জিনীর বড় হয়ে উঠায়, বাবার স্বপ্নপূরণে মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোয়।
Comments are closed.